ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ফেসবুকে প্রতারণা ॥ ১২ বিদেশী গ্রেফতার

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ৫ মার্চ ২০১৬

ফেসবুকে প্রতারণা ॥ ১২ বিদেশী গ্রেফতার

স্টাফ রিপোর্টার ॥ খুলনার একটি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা সালেহার (ছদ্মনাম) সঙ্গে ফেসবুকের মাধ্যমে পরিচয় ঘটে ব্রিটিশ নাগরিক স্কট মুরের। ফেসবুকেই তাদের ঘনিষ্ঠতা ও বিশ্বস্ততা গড়ে ওঠে। হঠাৎ সাইফুল নামের একজন সালেহাকে মোবাইল ফোনে জানান- লন্ডন থেকে স্কট মুর বেশ কিছু উপহার সামগ্রীর একটি পার্সেল পাঠিয়েছেন। সেটা হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে খালাস করতে ৬০ হাজার টাকা লাগবে। সালেহা কিছুটা সন্দেহ সংশয়ের মাঝেও টাকা পাঠিয়ে দেন সিটি ব্যাংকের একটি এ্যাকাউন্টে। তারপর তিনি শাহজালাল বিমানবন্দরে গিয়ে দেখেন কোন পার্সেল আসেনি। সবই প্রতারণা। বাধ্য হয়েই ছুটে যান পাশের র‌্যাব-১ অফিসে। রহস্যটা উন্মোচন হয় তখনই। সালেহার মতো এমন অনেক নিরীহ নারী-পুরুষ ফেসবুক প্রতারণার শিকার হওয়ার কাহিনী বেরিয়ে আসে। এ ঘটনার সূত্র ধরে বৃহস্পতিবার রাতে রাজধানীর উত্তরাসহ বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব একের পর এক ১৪ জন দেশী-বিদেশী প্রতারককে আটক করে। গ্রেফতারকৃত আন্তর্জাতিক প্রতারকচক্রের সক্রিয় এ ১২ জন বিদেশী নাগরিক হলেন- নাইজিরিয়ার আইব্যা (৩০), কেসি (৩০), এ্যাডউইন (৩৫), ইমনোয়ার (৩৩), কসমডস আলকুজমুজিন ওকিউলিজি (৫১), জোসোয়া (২৭), ইব্রাহিম (২৭), বিসেন্স (২৯), কঙ্গোর জাসোনামা (৪১), ক্যামেরুনের ওসমান (২৯), সানজো (৩৬) ও আনট প্রিজো (৪২)। তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, ওয়াইফাই (রাউটার), ডিভিডি, পাওয়ার ব্যাংক, পাসপোর্ট এবং ডলারসহ বাংলাদেশী টাকা উদ্ধার করা হয়। এসব দ্রব্যাদি, ডলার এবং বাংলাদেশী টাকা তারা বিভিন্ন প্রতারণামূলক কাজে ব্যবহার করত। তাদের এখন জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। শুক্রবার বিকেলে র‌্যাব-১ অফিসে তাদের সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়। এ সময় এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় এই চক্রের সব অজানা কাহিনী। এদের সম্পর্কে অনুসন্ধানে জানা যায়, আর্থিকভাবে সচ্ছল তরণ-তরণীদের অভিনব পন্থায় বন্ধুত্ব বা প্রেমের ফাঁদে ফেলে টাকা পয়সা আত্মসাত করাই ছিল চক্রের টার্গেট। এ প্রক্রিয়ায় অনায়াসে বিভিন্ন কৌশলের পরিবর্তন করা হয় যাতে করে বিশ্বাসযোগ্য করা যায়। সালেহা তেমনই একজন ভিকটিম। খুলনায় বসবাসরত সালেহা একটি প্রাইভেট কোম্পানির চাকরিজীবী। তার মতো আরও ক’জন ভিকটিম হচ্ছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত এক মহিলা ডাক্তার, রাঙ্গামাটির একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষিকাসহ আরও অনেকে। র‌্যাব জানায়, হোয়াইটস এ্যাপ, ভাইবার, ট্যাঙ্গো এবং অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতারকরা সম্পর্ক গড়ে তোলে। বিশ্বাস ও ঘনিষ্ঠতা যখন চরমে ওঠে তখনই প্রতারণার ফাঁদে ফেলে আদায় করে নেয় নগদ টাকা পয়সাসহ অন্যান্য জিনিসপত্র। ব্ল্যাকমেইলও করা হয় যুবতীদের। সতী সাধ্বী গৃহবধূ ও নারীদের ফাঁদে ফেলে সর্বনাশ করা হয়। ভিকটিম সালেহা সম্পর্কে র‌্যাব জানায়, প্রথমে ফেসবুকের মাধ্যমে স্কট মুরে ছদ্ম নামে ব্রিটিশ নাগরিক পরিচয়ে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলে। বন্ধুত্বের দাবি নিয়েই স্কট মুরে লন্ডন হতে কিছু উপহার সামগ্রী বিমানযোগে ঢাকা পাঠিয়েছেন বলে সংবাদ দেন। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে ০১৬২৯৩৫৮১৬৮ নম্বর ফোন হতে সালেহাকে জানানো হয় এ সব উপহার সম্পর্কে। সাইফুল নামের এক ব্যক্তি নিজেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ঢাকা কাস্টমস্ হাউস অফিসের কর্মকর্তা পরিচয়ে এ সংবাদটি দেন। তিনি ফোন করে সালেহাকে বলেন ‘লন্ডন হতে আপনার বন্ধু স্কট মুরে একটি পার্সেল পাঠিয়েছেন। এ পার্সেলটির পরিবহন এবং অন্যান্য চার্জ বাবদ ষাট হাজার টাকা খরচ হবে। খরচের টাকা প্রেরণ করলে পার্সেলটি আপনার বাড়িতে পৌঁছে দেয়া হবে’। সাইফুলের এমন ফোনে কিছুটা বিশ্বাস কিছুটা সংশয়ের দোলাচলে সালেহা টাকা পাঠাতে রাজি হন। সাইফুল টাকা প্রেরণের জন্য তাকে সিটি ব্যাংক, ঢাকা -এর একটি হিসাব নম্বর-২৮০১৫৭০৭৪৬০০১ (যার হোল্ডারের নাম নাইমুল হাসান খান) প্রদান করেন। সাইফুল সে টাকা পেয়েছেন বলে ফোনে নিশ্চিত করেন। কিন্তু সালেহার বাসায় পার্সেলটি পৌঁছেনি। এতে উদ্বিগ্ন সালেহা ফোন করেন সাইফুলের মোবাইল নম্বরে। তখন তার নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। অনন্যোপায় হয়ে তিনি খুলনা হতে ঢাকা চলে আসেন। ঢাকায় অবস্থানকালে গত ৭ ফেব্রুয়ারি সকালে মোবাইল ০১৭৯৭০৯৫৭৯৪ হতে রাসেল নামে পরিচয় দিয়ে সালেহার কাছে আরও একটি ফোন আসে। রাসেল তাকে জানান, পার্সেলটি প্রেরণ করতে দুই-চার দিন সময় লাগবে। কিন্তু এ সময় রাসেলের কন্ঠ শুনে সালেহা বুঝতে পারেন সাইফুল নামে ওই ব্যক্তিটিই তাকে রাসেল পরিচয়ে ফোন করেছে। তবুও সালেহা তাকে বলেন, ‘আমি ঢাকায় আছি বিমানবন্দরে আপনার সঙ্গে দেখা করতে চাই। একথা বলার সঙ্গে সঙ্গে কলটি কেটে দেন রাসেল ওরফে সাইফুল। সঙ্গে সঙ্গে মোবাইলটিও বন্ধ করে দেয়। এতে তিনি ওই পার্সেলের সন্ধানে বিমানবন্দর কাস্টমস অফিসে যোগাযোগ করে নিশ্চিত হন এ নামে কোন পার্সেল স্কট মুরে পাঠাননি। তখন তিনি নিশ্চিত হন তিনি প্রতারণার শিকার হয়েছেন। তাৎক্ষণিক তিনি র‌্যাব-১ অফিসে গিয়ে অভিযোগ করেন। শুরু হয় র‌্যাবের অভিযান। প্রথমেই উত্তরার মাসকট প্লাজা থেকে মামুন মোকারম (৩৮) ও সুলতান মাহমুদকে (২৬) কে আটক করা হয়। তাদের ব্যাপক জিজ্ঞসাবাদে র‌্যাব নিশ্চিত হয় বিদেশী প্রতারকচক্র সম্পর্কে। চমকপ্রদ সব তথ্যাদি হাতে নিয়ে চলে অভিযান। বৃহস্পতিবার রাতে এ চক্রের ১২ জনকে আটক করা হয়। এ সম্পর্কে সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব অধিনায়ক তুহিন মোহাম্মদ মাসুদ বলেন, একই প্রক্রিয়ায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে মহিলা ডাক্তারের কাছ থেকে একই চক্র এগার লাখ ছিয়ানব্বই হাজার ছয়শত টাকা প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়। এ রকম আরও অনেক ভিকটিমের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। বাকিদের প্রতারণার কাহিনীও অনুসন্ধান করা হচ্ছে। তিনি বলেন-এ সব বিদেশী নাগরিকের অধিকাংশের বাংলাদেশে অবস্থানের বৈধ কোন দলিল নেই। তাদের বক্তব্যে প্রতীয়মান হয় তারা ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে বাংলাদেশ অবস্থান করে বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত। তাদের মধ্যে নাইজিরীয় কেসি এবং আইব্যা বাংলায় অনর্গল কথা বলতে পারেন। দীর্ঘদিন তারা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন। র‌্যাব জানায়, কঙ্গো, নাইজিরিয়া, ক্যামেরন এবং বাংলাদেশী দ্ইু নাগরিকসহ প্রতারক চক্র (বাড়ি নং-৯, রোড নং-১৫, সেক্টর নং-১৪ ) উত্তরায় বসে তাদের প্রতারণা কার্যক্রম যৌথভাবে পরিচালনা করত। বাংলাদেশী দুজনের মাধ্যমে এ চক্রটি টার্গেট খুঁজতে থাকে। পরে যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে তাদের ফেসবুক আইডি বের করে তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে। এসব ক্ষেত্রে তারা নিজেদের খুবই সুদর্শন এবং আমেরিকা অথবা ইউরোপের নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেন। বন্ধুত্ব গাঢ় হওয়ার পর প্রেমের অভিনয় এবং বিভিন্ন উপহার প্রেরণের মাধ্যমে সম্পর্কটাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার পর এক পর্যায়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেয়।
×