ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

আদালতপাড়ায় জরন বিবির ফরিয়াদ

প্রকাশিত: ০৫:২৪, ৫ মার্চ ২০১৬

আদালতপাড়ায় জরন বিবির ফরিয়াদ

আরাফাত মুন্না ॥ সিলেটের কারাগারে বন্দী ফরিদ মিয়া (৩০)। ডাকাতির মামলায় তাকে যাবজ্জীবন কারাদ- দিয়েছেন বিচারিক আদালত। ফরিদের বউও দুই সন্তান রেখে চলে গেছে বাবার বাড়িতে। কিন্তু মা তো আর ছেলেকে ভুলে যেতে পারেন না। তাই তো গত ছয় বছর যাবত উচ্চ আদালতের বারান্দায় ঘুরছেন ফরিদের মা ষাটোর্ধ জরণ বিবি। সহায় সম্পত্তি যা কিছু ছিল, সবই বিক্রি করেছেন মামলা চালাতে গিয়ে। এর পরও ছেলেকে মুক্ত করতে পারেননি তিনি। এখন দুই নাতি ও নিজের দুই বেলা খাবার জোগাতেই কষ্ট হয় তার। অনেকটা ভিক্ষা করেই জীবন চলছে। তারপরও, মায়ের মন বলে কথা। একদিন মুক্তি পাবেই- আশা জরণ বিবির। ঢাকায় মামলার খোঁজ নিতে এসে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণেই ভিক্ষা করেন জরণ বিবি। আবার সিলেটে ফিরে সেখানেও ভিক্ষা করেন তিনি। ছেলের দুই সন্তানকেও মাঝে মধ্যে নিয়ে আসেন সুপ্রীমকোর্টে। জরণ বিবির অভিযোগ, ছেলের সঙ্গে একই মামলায় অন্য দুজনের জামিন হলেও রহস্যজনক কারণে ছেলের (ফরিদ মিয়া) জামিনের ব্যবস্থা করেননি আইনজীবী। পরে মামলা পরিচালনার জন্য অন্য আইনজীবীর দ্বারস্থ হয়েছেন তিনি। জানা গেছে, একই মামলায় যাবজ্জীবন দ-প্রাপ্ত অপর দুই আসামির হাইকোর্ট থেকে জামিন হলেও অজানা কারণে কারাগারেই বন্দী রয়েছে ফরিদ মিয়া। মামলাটি বর্তমানে হাইকোর্টের নিয়মিত বেঞ্চে শুনানির তালিকায় থাকলেও সংশ্লিষ্ট সেকশন থেকে ফাইলটি আদালতে না আসায় মামলার কার্যক্রম পরিচালনা করা যাচ্ছে না। জরণ বিবির বর্তমান আইনজীবী বেলায়েত হোসেন জানান, মামলাটি বর্তমানে নিয়মিত কোর্টের কার্যতালিকায় প্রকাশ পেলেও সেকশন থেকে ফাইলটি আদালতে উপস্থিত করা যায়নি। মামলার নথি না পাওয়ার বিষয়ে সুপ্রীমকোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেল বরাবর একটি আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে বলা হয়েছে, ‘মহামান্য হাইকোর্টে বিভাগের ২৭ (এনেক্স) কোর্টের কার্যতালিকায় মামলা নং ৭৯২৩/২০১১ এর আসামি ফরিদ উদ্দিনের জামিন শুনানির জন্য প্রায় ৫ মাস যাবত অপেক্ষমাণ। মামলাটি নিয়মিতভাবে প্রতি রবিবার বেঞ্চের কার্যতালিকায় আসে কিন্তু সেকশন থেকে ফাইলটি আদালতে উপস্থাপন করতে পারছি না। এ জন্য মহামান্য হাইকোর্ট সেকশন সুপারকে আদালতে সশরীরে হাজির হওয়ার তাগাদা দেন। ফাইলটি রহস্যজনক উধাও হওয়ায় বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বসহকারে দেখা একান্ত আবশ্যক নতুবা সমূহ ক্ষতির সম্ভাবনা।’ আইনজীবী বেলায়েত হোসেন জানান, গত বুধবার হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ ১১ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে প্রতিবেদন দিতে সংশ্লিষ্ট ডেপুটি রেজিস্ট্রারকে নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি সুপ্রীমকোর্টে অবস্থিত ল’ রিপোর্টার্স ফোরামের কার্যালয়ে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে ছেলের মামলার বিষয়টি তুলে ধরেন জরণ বিবি। এছাড়া বিভিন্ন আইন সহায়তা কেন্দ্রের সহায়তাও চেয়েছেন তিনি। মামলার নথি থেকে জানা গেছে, ২০০৯ সালে মার্চ মাসে একটি ডাকাতির মামলায় সিলেট জেলার বিশ্বনাথ উপজেলার পুরাণসতপুর গ্রামের মৃত এখলাছ মিয়ার ছেলে ফরিদ মিয়াকে (৩০) গ্রেফতার করে পুলিশ। পরবর্তীতে এ মামলায় পুলিশ বিশ্বনাথ এলাকার উজির ও নাজির নামে আরও দুজনকে গ্রেফতার করে জেলহাজতে পাঠায়। একই বছর ওই মামলায় সিলেট জেলার বিচারিক আদালত এই তিনজনকে যাবজ্জীবন সাজা দেন। রায়ের বিরুদ্ধে ফরিদের মা জরণ বিবি এবং উজির-নাজিরের আত্মীয়স্বজন আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটনের মাধ্যমে হাইকোর্টে আপীল করেন। হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ শুনানি শেষে উজির-নাজিরকে জামিনে মুক্তি দিলেও ফরিদের জামিন আবেদন নাকচ করেন। জরণ বিবি ওই আইনজীবীর কাছে একাধিকবার যোগাযোগ করেন। এক পর্যায়ে আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটন জরণ বিবি মামলায় ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দিয়ে দেন। এরপর আইনজীবী বেলায়েত হোসেনের দ্বারস্থ হন তিনি। সাজাপ্রাপ্ত ফরিদের মা জরণ বিবি জানায়, আপীল মামলায় উজির-নাজিরের জামিন হলেও তার ছেলে ফরিদের জামিন হয়নি। এ জন্য আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটন দায়ী। ঘরের চালের টিন বিক্রি করে আইনজীবীকে টাকা দিয়েছি, কিন্তু ছেলের জামিন শুনানি করেননি তিনি। অন্য আইনজীবীর কাছে যেতে চাইলে মামলার নথিপত্র ফেরত দেননি। ছয় বছর যাবত আদালতের বারান্দায় আমি ছেলের জামিনের জন্য ঘুরছি। জরণ বিবি আরও বলেন, ছেলের দুই সন্তান রেখে ফরিদের স্ত্রী বাপের বাড়ি চলে গেছে। দুই নাতনিকে সঙ্গে নিয়ে ভিক্ষা করে জীবন চালাচ্ছি। কেউ খাবার দিলে খাই, না হলে উপোস থাকি। এ বিষয়ে আইনজীবী সাহিদুল ইসলাম খান লিটন টেলিফোনে সাংবাদিকদের বলেন, ‘ফরিদের জামিনের চেষ্টা করেছি, আদালত জামিন দেয়নি। আমি ওই মামলায় ‘নো অবজেকশন’ সার্টিফিকেট দিয়ে দিয়েছি। বর্তমানে ওই মামলাটি এ্যাডভোকেট বেলায়েত হোসেন পরিচালনা করছেন।’ আইনজীবী এ্যাডভোকেট বেলায়েত হোসেন বলেন, ‘মামলাটির নথিপত্র পাওয়া যাচ্ছিল না। কিন্তু যে কোন মামলার মূল নথিপত্র আদালতের কাছে জমা থাকে। ওই নথি আদালত থেকে উঠিয়ে এখন নতুন করে (ফাইল প্রস্তুত) জামিন আবেদন করা হয়েছে। আশা করছি জামিন আবেদন শুনানি হতে পারে। জামিন হবে কি না সেটা একমাত্র আদালতের ইচ্ছা।’
×