ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশ ৩ হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য সুবিধা পাবে;###;প্রতিবেশী ৪ দেশের মধ্যে ;###;বাণিজ্য বাড়বে সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকার

সম্ভাবনার নতুন দ্বার ॥ খুলে যাবে সিল্ক রোড

প্রকাশিত: ০৫:২০, ৫ মার্চ ২০১৬

সম্ভাবনার নতুন দ্বার ॥ খুলে যাবে সিল্ক  রোড

কাওসার রহমান ॥ আঞ্চলিক অর্থনৈতিক করিডর গঠনের মাধ্যমে নিজেদের বাণিজ্যিক উন্নয়নে একটি উদ্যোগ সৃষ্টির পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে বাংলাদেশ, চীন, ভারত এবং মিয়ানমার। যার মাধ্যমে এ অঞ্চলের জনগণের আয়-উপার্জনের সুযোগও সম্প্রসারিত হবে। উদ্যোগটি আসলে বহু প্রাচীনকালের বাণিজ্যিক যোগাযোগেরই পুনরুজ্জীবন ঘটানো, যা সময়ের নানা ঘটনাপ্রবাহে কালের অন্তরালে হারিয়ে গিয়েছিল। এর নাম সিল্ক রোড। এটি প্রায় দু’হাজার বছরের পুরনো বাণিজ্য পথ। মানবসভ্যতার বিকাশের ক্ষেত্রে, যোগাযোগ ও পণ্য-বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্থনীতির প্রাণচাঞ্চল্যে সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে যুক্ত রাখার ক্ষেত্রে সেই সুপ্রাচীন কাল থেকে এই সিল্ক রোড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। আজকের দিনে এসে বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমার ঘুমিয়েপড়া এই যোগাযোগ সড়কসংযোগটি জাগিয়ে তুলে অর্থনৈতিক কর্মচাঞ্চল্যে ভরপুর করে তুলতে চাইছে। উদ্যেগাটি যথাযথভাবে সফল হলে এ অঞ্চলজুড়ে বাণিজ্যিক প্রবাহ সৃষ্টি ছাড়াও জনজীবনযাত্রায় ইতিবাচক প্রভাবের শুভ সূচনা করবে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ভৌগোলিক এবং কৌশলগত অবস্থান ও শ্রমশক্তির কারণে এই সিল্ক রোডের মাধ্যমে এ অঞ্চলের বিশাল বাজারের সুবিধা নিতে পারবে বাংলাদেশ। তৈরি পোশাক শিল্পপণ্য নিয়ে যেভাবে বাংলাদেশ বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতা করছে, একইভাবে সিল্ক রোডের যোগাযোগ সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে চামড়া, তথ্যপ্রযুক্তি ও জাহাজ নির্মাণ শিল্পকেও বিকশিত করার ব্যাপক সুযোগ নিতে পারবে। এই চার দেশের মধ্যে যানবাহন সংক্রান্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা শক্তিশালী হলে বাণিজ্য, বিনিয়োগ, বিদ্যুত ও পর্যটনক্ষেত্রে সম্ভাবনার নানা দুয়ার খুলে যাবে। প্রকৃতঅর্থে, করিডরটি ব্যবহারিক কর্মযজ্ঞের আওতায় চলে আসবে চীনের ইউনান প্রদেশ, বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও ভারতের সাড়ে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটারের বিশাল অঞ্চলের ৪৪ কোটি মানুষ। সেই সঙ্গে এই চার দেশের মানুষের বিশাল বাজার। অর্থনৈতিক করিডর উদ্যোগে থাকবে সড়ক, জল ও আকাশপথের যোগাযোগ ব্যবস্থা। রুটটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল দিয়ে হলে চট্টগ্রামকেন্দ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্যের সুযোগ বেড়ে যাবে। অবকাঠামোর উন্নয়ন অবিশ্বাস্যভাবে গতি লাভ করবে। চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য কক্সবাজার, টেকনাফ হয়ে মিয়ানমারের আকিয়াব ও মান্দালয় হয়ে চীনের কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছে যাবে। চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের আমদানি-রফতানি ব্যয় বহুলাংশে কমে যাবে। রফতানিপণ্য তাতে প্রতিযোগিতায় সুবিধা করতে পারবে। ভারত তার উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পণ্য সরবরাহের জন্য যে ট্রানজিট চাইছে বাংলাদেশের কাছে এই সিল্ক রোড তা বহুলাংশে পূরণ করতে সক্ষম হবে। আর বাণিজ্যনীতির আংশিক উদারীকরণ হলে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৩ হাজার কোটি টাকার শুল্কমুক্ত বাণিজ্য সুবিধা ভোগ করতে পারবে। চারটি দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে সাড়ে ৪৪ হাজার কোটি টাকার। বাংলাদেশ পরিণত হবে বিনিয়োগের কেন্দ্রস্থলে। জানা যায়, চারটি দেশ নিজেদের একসূত্রে আবদ্ধ করার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত দীর্ঘকাল ধরে। এ প্রচেষ্টায় সংযুক্ত চারটি দেশ আবার পরস্পরের প্রতিবেশী। এশিয়া মহাদেশের এই দেশগুলোর রাজনৈতিক সম্পর্কের নানা টানাপোড়েন রয়েছে। রয়েছে আদর্শগত ভিন্নতা এবং পণ্য বাজার নিয়ে প্রতিযোগিতা। তা সত্ত্বেও জনগণের কল্যাণ ভাবনা এবং বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্যনীতি ও সার্বিক পরিবেশ-পরিস্থিতিকে বিবেচনায় নিয়ে এই চারটি এশীয় দেশ নিজ নিজ স্বার্থেই এমন একটি সম্মিলিত ব্যবস্থায় পথ চলতে সম্মত হয়েছে। বাণিজ্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা ও নিরাপত্তার স্বস্তি অর্জনের বিষয়টি সামনে রেখে বাংলাদেশ, চীন, ভারত আর মিয়ানমারের এই যৌথ প্রয়াসটিকে দেখা হচ্ছে সম্ভাবনার নতুন এক দিগন্তরূপে। চার দেশের নামের আদ্যক্ষর নিয়ে একে অভিহিত করা হচ্ছে- ‘বিসিআইএম রিজিওন্যাল ইকোনমিক করিডর’। এ উদ্যোগটির নেতৃত্বে রয়েছে চীন। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অপর তিনটি দেশ প্রথমদিকে বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। তবে, সিল্ক রোডের পুনরুজ্জীবনের প্রচেষ্টা চীন অব্যাহতভাবে চালিয়ে সহযোগী দেশগুলোকে এক টেবিলে বসাতে পেরেছে ২০১৩ সালের ১৮ ও ১৯ ডিসেম্বরের বেজিং বৈঠকে। এরপর ২০১৪ সালে বাংলাদেশের কক্সবাজারে অনুষ্ঠিত ১৭ ও ১৮ ডিসেম্বরের সম্মেলনে চার দেশের মধ্যে ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ সংক্রান্ত চুক্তিপত্র স্বাক্ষরিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় জ্বালানি সহযোগিতা, জলবায়ু পরিবর্তন, বাণিজ্য সহজীকরণ, শুল্ক হ্রাস, নন-ট্যারিফ বাধা দূর, সাংস্কৃতিক বিনিময় ও জনসাধারণের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বয়, দারিদ্র্য বিমোচন, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সহযোগিতা ইত্যাদি বিষয়। উল্লেখ্য, ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে আদিকালের এই সিল্ক রোডটি চালু করার উদ্যোগ নিয়েছিল। লক্ষ্য ছিল চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য কক্সবাজার, টেকনাফ, মিয়ানমারের আকিয়াব মান্দালয় হয়ে কুনমিং পর্যন্ত পৌঁছানো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় এই প্রয়াস হোঁচট খায়। এর প্রায় ৭০ বছর পর চীন ১৯৯৯ সালে তার বাণিজ্যিক শহর কুনমিংয়ে সিল্ক রোড পুনরুজ্জীবনের ঘোষণা দেয়। এখন যেভাবে তার বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া চলছে তাতে ভবিষ্যতের পরিবর্তন উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। এ বিষয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলভিত্তিক এনজিও সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল সোশ্যাল এ্যান্ড পলিসি রিসার্চ (সিইএসপিআর) উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্য অসম, ত্রিপুরা, নাগাল্যান্ড, মনিপুর, মিজোরাম, অরুণাচল ও মেঘালয় প্রদেশের বিভিন্ন শ্রেণী -পেশার মানুষের ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশ, চীন, ভারত ও মিয়ানমারকে (বিসিআইএম) নিয়ে অর্থনৈতিক করিডর এ অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে। পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশের মধ্যে অমীমাংসিত ইস্যুগুলো সমাধানেও সহায়তা করবে। জরিপে অংশগ্রহণকারী ৮৯ শতাংশ মানুষই মনে করে, বিসিআইএম এ অঞ্চলের অর্থনীতির জন্য সুফল বয়ে আনবে। আর ৮৫ শতাংশ মনে করে, এই করিডর প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সমস্যা নিরসনে ভারতকে সহায়তা করবে। ৮৮ শতাংশ মনে করছেন, অস্ত্র ও মাদক চোরাচালানের মতো গুরুতর ইস্যুগুলো বিসিআইএমের মতো বহু রাষ্ট্রীয় ফোরামের মাধ্যমে আরও কার্যকরভাবে মোকাবেলা করা সম্ভব।
×