ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী

উচ্চশিক্ষার মান এবং আমাদের ইউজিসি

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ৫ মার্চ ২০১৬

উচ্চশিক্ষার মান এবং আমাদের ইউজিসি

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি বলেছেন, উচ্চ শিক্ষার মান উন্নয়নকল্পে ইউজিসির নাম ও কাঠামো পরিবর্তন করা হবে এবং এ্যাক্রেডিয়েশন কাউন্সিল গঠন করা হবে। আসলে দেশের সর্বস্তরে শিক্ষার মান উন্নয়নে গত সাত বছর ধরে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। শিক্ষাকে কেবল কতিপয় উচ্চ মধ্যবিত্ত ও ধনিক শ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধতা রাখার যে অর্গল ছিল সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার অব্যবহিত পর পরই তার মূলে কুঠারাঘাত করেন। তিনি সর্বজনীন শিক্ষাব্যবস্থা চালু করেন। বঙ্গবন্ধু হত্যার পর দেশে যে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে তার ধারাবাহিকতাও শিক্ষাক্ষেত্রে সম্মুখীন হয়। বোর্ডস্ট্যান্ড করা ছাত্রের হাতে পঁচাত্তর-পরবর্তী রাষ্ট্রপতি অস্ত্র পর্যন্ত তুলে দিয়েছিল। নিন্দুকেরা বলেন, তাই তো তার নিজের ছেলেদেরও আর লেখাপড়া হয়নি। একে বলে প্রকৃতির প্রতিশোধ। গত সাত বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। ইউজিসির বর্তমান চেয়ারম্যানকে অত্যন্ত যোগ্য ও বিদগ্ধ ব্যক্তি হিসেবেই জানি। অতীতে ইউজিসিতে কখনও কখনও এমন সদস্যরা ছিলেন যারা সদস্য হলেও নৈতিকতায় প্রশ্নবিদ্ধ ছিলেন। একজন সদস্যের কথা জানি, যিনি একসময় নামকরা এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করেছেন, তিনি একটি বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হওয়ার লোভে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সম্পর্কে মিথ্যে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। আসলে অনৈতিক কাজ যারা করেন, তাদের প্রতি মানুষের শ্রদ্ধাবোধ আর থাকে না। বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে দেশের সরকারী বেসরকারী মিলে ৬১টি বিশ্ববিদ্যালয়ে রাউন্ড-১, রাউন্ড-২, রাউন্ড-৩-এর আওতায় ইনস্টিটিউশনাল কোয়ালিটি এস্যুরেন্স সেল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী দেশের উচ্চশিক্ষাকে একটি মানসম্মত ডিগ্রী হিসেবে পরিগণিত করতে চাচ্ছেন। তার এ আন্তরিক প্রয়াস সফল করতে হলে অবশ্যই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে তাদের শিক্ষার মান, কাঠামো, শিক্ষা ব্যবস্থাপনা, উন্নতমানের গবেষণার কাজ করার পাশাপাশি আন্তর্জাতিকীকরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে যেভাবে ‘নিজেকে মূল্যায়ন কর’ ভিত্তিতে স্বনির্ধারণী জরিপ পরিচালিত হচ্ছে তা সত্যিকার অর্থে করা গেলে অত্যন্ত কার্যকর হবে। কেননা এই জরিপের ভিত্তিতে বেরিয়ে আসবে প্রাক্তন ছাত্রছাত্রী, বর্তমান ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকবৃন্দ, চাকরিদাতা এবং শিক্ষক ছাড়া অন্য কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দের কাছ থেকে ব্যবচ্ছেদ। এ ব্যবচ্ছেদ থেকে সত্যিকার চালচিত্র বেরিয়ে আসলে তখন উন্নয়নের জন্যে চার বছর সময় পাওয়া যাবে। এটি একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। এক্ষণে যে এ্যাক্রেডিয়েশন কাউন্সিল গঠন করা হচ্ছে সেটি বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষার ইতিহাসে দীর্ঘমেয়াদী ভূমিকা পালন করবে। কেননা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বিচ্যুত হয়ে মাঝখানে শিক্ষাকে কেবল পণ্যনির্ভর করে ফেলা হয়েছিল। জননেত্রী হাসিনা আবার হাল ধরেছেন এবং উনি বিশ্বাস করেন যে, উচ্চশিক্ষায় বিনিয়োগ একটি জাতির উন্নয়নে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রেখে থাকে। তার সুযোগ্য ও গতিময় নেতৃত্বে দেশের অর্থনীতির মান যেমন বাড়ছে তেমনি শিক্ষাক্ষেত্রেও মান বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিক্ষার গুণগতমান অত্যন্ত কঠিন একটি প্রশ্ন। এটি নিরূপণ করে থাকে চাকরির বাজারে সরবরাহ ও চাহিদার সামঞ্জস্যের মধ্য দিয়ে। বর্তমানে প্রতিবছর প্রায় তেত্রিশ লাখ গ্র্যাজুয়েট বেরুচ্ছে। এদের মধ্যে অর্ধেক চাকরির বাজারে প্রবেশ করতে পারছে। অবস্থাদৃষ্টে এমন হয়েছেÑ সরকারী চাকরির ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য দাবি উঠেছে। তবে বর্তমান সরকারের আমলে নতুন কর্মসংস্থান শুরু হয়েছে। অনেক বেসরকারী উদ্যোক্তা নিজেদের দেশের গ্র্যাজুয়েট পাসকৃত চাকরি প্রার্থীদের চাকরি না দিয়ে ভিনদেশীদের দিতে ব্যস্ত রয়েছেন। দেশে প্রায় দু’লাখের মতো বিদেশী চাকরিজীবী রয়েছে যার অর্ধেকই কিন্তু এদেশের চাকরি প্রার্থীরা করতে পারত। কেউ হঠাৎ করে কোন কিছু শিখে না বরং তাকে শেখাতে হলে ক্রম সুযোগ বৃদ্ধি করতে হয়। কোন কোন উদ্যোক্তা এটি বুঝতে চান নাÑ তাই তারা রেডিমেড প্রার্থী ভিন দেশ থেকে আনেন। ফলে অনেক সময় দেশ থেকে মূল্যবান বিদেশী মুদ্রা চলে যায়। বর্তমানে যে আইকিউসি গঠন করা হয়েছে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেটির পরিচালক ও অতিরিক্ত পরিচালকের পদমর্যাদা প্রফেসর হওয়ার কথা থাকলেও কোন কোন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় সহযোগী অধ্যাপক বা তার নিচের পদের শিক্ষককে দিয়েছে। এটি অবশ্য ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বল্পতার কারণে হতে পারে। বিদেশে দেখেছি যারা আইকিউসিতে পরিচালক থাকেন তাদের পদমর্যাদা। উপ-উপাচার্যের সমান। অথচ বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকেই নিম্ন পর্যায়ের শিক্ষক প্রেরণ করে বিষয়টিকে বেশ হালকা করে ফেলেছেন। এতে বোঝা যায় যে, সে সমস্ত বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়সমূহ আসলে গুণগতমান উন্নয়নের বিষয়টিকে হালকা করে দেখছেন। গুণগতমান উন্নয়নের বিকল্প নেই। নচেৎ বিশ্বায়নের এ যুগে বাংলাদেশী শিক্ষার্থীরা মূলত সমস্যার মুখে পড়তে বাধ্য হবে। এবারের বইমেলায় শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ ‘শিক্ষাÑ লক্ষ্য অর্জনে যেতে হবে বহু দূর’ শীর্ষক চারুলিপি প্রকাশন থেকে যে বইটি বের হয়েছে তা অত্যন্ত বাস্তবসম্মত এবং শিক্ষা নিয়ে তার ভাবনা-চিন্তার বিচ্ছুরণ ঘটেছে। আশা করা যায়, এ ভাবনা চিন্তার প্রায়োগিক কৌশলগত বিনির্মাণ ও বাস্তবায়ন ঘটলে বর্তমান সরকারের শিক্ষাক্ষেত্রে সাফল্য আরও অধিকতর বাস্তবায়ন ঘটবে। এক্ষেত্রে শুধু সংযোজন করতে চাই, কেবল দেশের গুণগতমানসম্পন্ন শিক্ষার সঙ্গে আঞ্চলিক সহযোগিতার বিষয়টিও যুক্ত রয়েছে। যদি আঞ্চলিক সংস্থা বিমস্টেক ইওগঝঞঊঈ-এ মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর উদ্যোগে শিক্ষা বিষয়টি বিশেষত উচ্চশিক্ষার ব্যাপারে একটি কাঠামো তৈরি করা যায় তবে তা ইতিবাচক ফল বয়ে আনতে পারে। এক্ষেত্রে আসন্ন যে চতুর্থ বিমস্টেক শীর্ষ পর্যায়ের সম্মেলন হবে সেখানে অবশ্যই শিক্ষা বিষয়টি যাতে অন্তর্ভুক্ত করা যায় সে জন্যে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে অনুরোধ থাকবে ‘বিমস্টেক’ নেত্রী হিসেবে এটিকে গতিশীল করার জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে এবং বিমস্টেকে ‘শিক্ষা’ সংযুক্ত করে আসিয়ানের আদলে আসিয়ান ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্কের মতো ‘বিমস্টেক ইউনিভার্সিটি নেটওয়ার্ক’ গড়ে তোলার জন্যে সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে রাজি করাতে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আঞ্চলিক সহযোগিতা বিশেষত শিক্ষাক্ষেত্রে অত্যন্ত দরকার। প্রয়োজন হচ্ছে দেশে যেভাবে বর্তমানে শিক্ষা কাঠামো গড়ে তোলা হচ্ছে তার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক বিশেষ করে আঞ্চলিক কাঠামো গড়ে তোলা। বিমস্টেকের সদস্য রাষ্ট্রসমূহের মধ্যে রয়েছে থাইল্যান্ড যারা শিক্ষা কাঠামোয় কেবল নিজের দেশ নয় বরং আসিয়ান নেটওয়ার্কের সঙ্গে আওতাভুক্ত। আমাদের দেশে অওঞ-এর একটি শাখা খোলার ব্যাপারে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও ইউজিসি প্রয়াস গ্রহণ করতে পারে। ইউজিসির চেয়ারম্যান ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের কাছে এদেশে শিক্ষার মান উন্নয়নে সহযোগিতা চেয়েছেন। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। কেননা ছঝ রেটিং অনুসারে ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের অবস্থান এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে এক নম্বর। আসলে শিক্ষকতা হচ্ছে মহান পেশা। ভোগবাদী সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে এক থেকে তিন শতাংশের জন্য অন্যদের বিরূপ বলা যায় না। অর্থনীতিতে একটি সাদামাটা অথচ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক কথা রয়েছেÑ কার্ডিনাল এ্যাপ্রোচ যার অর্থ হচ্ছে যা টাকা দিয়ে পরিমাপ করা যায় না। অর্থাৎ লেভেল অব সেটিসফেকশন। শিক্ষকতায় আত্মনিবেদিত হলে, মানি সেন্ট্রিক সোসাইটিতে যে সম্মান পাওয়া যায় তা নিজের পিতৃ পরিচয়ের সুবাদে এবং নিজে এ পেশায় এসে মর্মে মর্মে অনুভব করছি। শ্রদ্ধা ও সম্মানবোধে শিক্ষকতা অনন্য। এর কোন বিকল্প নেই। বিদেশে দেখেছি একজন ইলেকট্রিশিয়ান বা প্লাম্বারের বেতন কয়েক গুণ বেশি। এ জন্য শিক্ষককে নৈতিকভাবে বলীয়ান ও দায়িত্বশীল হতে হয়। এদেশে সামাজিকভাবে বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সবার ছেলেমেয়েকে মাস্টার্স করাতে হবেÑ যোগ্যতা থাকুক আর না থাকুক। কারিগরি শিক্ষার প্রতি অত্যন্ত অনীহা। কিন্তু বর্তমানে দেশের অর্থনীতি যেভাবে সমৃদ্ধ হচ্ছে, সেদিকে খেয়াল রেখে পাঠ্যক্রম পুনর্বিন্যাস করা দরকার। পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হোয়াইট কালার লেবার এবং ব্লু কালার লেবার তৈরির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। এর কোন বিকল্প নেই। ধরুন সবাই বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং বা বিবিএ পাস করলÑ তাহলে ফোরম্যান বা এ্যাকাউন্টটেন্টদের কি হবে। এ বিষয়টি বিবেচনার এনে সিলেবাস ঢেলে সাজাতে হবে এবং বাজারের চাহিদা অনুযায়ী কোর্স কারিকুলাম নির্ধারণ করতে হবে। এ জন্যে তিন বছর মেয়াদী বিকম (অনার্স) বা তিন বছর মেয়াদী শর্ট বিএসসি চালুর বিষয়টি ভেবে দেখা মেতে পারে। কারিগরি ও বৃত্তিমূলক বিষয়গুলো ভিন্ন নামে বা বিজনেস প্রসেস রিইঞ্জিনিয়ারিং করে চালু করলে ভাল হয়। বর্তমান সরকার যেভাবে শিক্ষা বিস্তারে কাজ করে চলেছে তাকে এক কথায় অনন্য বলা যায়। শেখ হাসিনা প্রমাণ করেছেন উনি বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা এবং কেবল নেত্রী নন সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তিনি একজন স্টেটসম্যান হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত। তাই তো তাকে দেশ-বিদেশের দশটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টরেট দেয়া হয়েছে। লেখক : শিক্ষাবিদ ও অর্থনীতিবিদ ই-মেইল : [email protected]
×