ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জয় আমার করতলে

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ৫ মার্চ ২০১৬

জয় আমার করতলে

অগ্রজ মাকিদকে ফোন করলুম, প্রায়-মিনিটখানেক রিং-এর আওয়াজ, ভাবলুম ঘরে নেই হয়তো। রিসিভার নামিয়ে রাখবো, তক্ষুণি গলার আওয়াজ। হ্যালোর বদলে গালাগালি। ‘আর সময় পেলেন না? পরে করবেন।’ ‘তারপরেই আর্তনাদ, ‘হায়, হায় চলে গেল, চলে গেল!’ নিশ্চিত বিশ্বাস হলো, তাঁর শ্বশুরের গ্রান্ড- গ্রান্ডফাদার ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নাহ ..... রাজেউন)। পরিচয় জানিয়ে সভয়ে জিজ্ঞেস করি, কে চলে গেলেন। মাকিদ ॥ সাকিব, সাকিব। - কে সাকিব। মাকিদ ॥ তাও জানিস নে? বাংলাদেশের ক্রিকেটার। - কোথায় গেলেন? মাকিদ ॥ আউট! - হতেই পারে, এই জন্যে হাহাকার? মাকিদ ॥ তুই একটা কুফা। পরে ফোন করিস, মেজাজ বিগড়ে গেছে। আহা সাকিব, চলে গেল। বুঝলুম, দিলে বড্ডো চোট লেগেছে, প্রেমে বিচ্ছেদের পরেও যেমন রেশ থাকে, ব্যথা যায় না। - কোন দেশের সঙ্গে খেলা। মাকিদ ॥ মোলো। তোদের দেশে কি ফুটবল, টেনিস ছাড়া আর কোনো খেলার খবর নেই? খেলা পাকিস্তানের সঙ্গে। -স্ফূর্তি করুন। সংগ্রামের মাসে বিজয় আমাদের অবশ্যই। তরুণরাই সর্বদা যোদ্ধা, বিজয়ী। তরুণরাই আশা, ভরসা, পথপ্রদর্শক। হাল ছাড়বেন না। ছাড়ার যুক্তি নেই কোনো। ওরাই সবুজ, ওরাই কাঁচা। ওরাই আধ-মরাদের ঘা মেরে বাঁচায়। বাঁচাবে ক্রিকেট-রণাঙ্গনেও। জয় আমার করতলে / হোক তা দিনশেষে, অস্তাচলে। টেলিফোন ছেড়ে দিলেন। কমনওয়েলথ্-এর দেশ ছাড়া (তাও আবার কমনওয়েলথের সব দেশে নয়। দুই-একটি দেশ ইদানীং খেলছে অবশ্য।) পৃথিবীর বহু দেশে ক্রিকেট নেই। ক্রিকেটের নামও শোনেনি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ই ইউ )-ভুক্ত দেশের মধ্যে ব্রিটেন-আয়ারল্যান্ড বাদে ক্রিকেটকে কোনো খেলাই মনে করে না। ইদানীং নেদারল্যান্ডস ব্যাটেবলে ঠোকাঠুকি করছে বটে, কিন্তু আখেরে লাভ নেই জেনে, গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেন দিচ্ছে না, কারণ যথেষ্ট। খেলাটি বিশ্বব্যাপী নয়, অর্থনৈতিক হিসেবনিকেশ সামান্য। অলাভজনক। করপোরেট ব্যবসায়ীরাও এগিয়ে আসছে না। আসবে না। ক্রিকেট নিয়ে উন্মাদনা থাকলে ঘুম হারাম হতো। ক্রিকেট নিয়ে খুশবন্ত সিং-এর একটি ব্যঙ্গমাখা লেখা পড়েছিলুম, ‘ভাগ্যিস, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, ইটালি, জার্মানি, ফ্রান্স, হল্যান্ড ক্রিকেট খেলে না। খেললে ইংল্যান্ডসহ আমাদের উপমহাদেশে গর্তে পালিয়ে যেত। যেমন গেছে ফুটবলে। ওদের স্কিলের কাছে আমাদের ছোকরারা কু কিত কিত ঝিক।’ সুকুমার রায়ের মতো এতটা রসিক নন খুশবন্ত, বলেননি, ‘কুমড়ো নিয়ে ক্রিকেট খেলে কেন রাজার পিসি?’ এশিয়ায় নিশ্চয় সাকুল্যে ১০ বারোটি দেশ নয়। কয়টি দেশ ক্রিকেট খেলে? দুনিয়ার কতটি দেশ ক্রিকেট নিয়ে ব্যস্ত? দেশের সংখ্যা আঙুলে গোনা। তাই যদি হয়, নাম কেন এশিয়া কাপ বা বিশ্বকাপ। নামকরণে মনে হয় এশিয়া বা বিশ্ব কুয়োর মধ্যে। আবার সুকুমার রায় জংলা বনে পাগলা বুড়ো আমায় এসে বলে, ‘আড়াই বিঘে সমুদ্রেতে কাঁঠাল কত ফলে?’ আমিও বলি আন্দাজেতে ‘বলছি শোন কত... তোমাদের ঐ ঝিঙের ক্ষেতে চিংড়ি গজায় যত।’ ব্রিটেন ছাড়া ইউরোপের কোনো দেশের মিডিয়ায় ক্রিকেটের নামগন্ধ নেই, এক অক্ষর খবরও লাপাত্তা। ভাবলুম, ক্রিকেটে পাকিস্তানকে পিটিয়ে তক্তা বানিয়েছে বাংলাদেশ, এই সংবাদের ছিটেফোঁটা অন্তত বিলেতি কাগজে থাকবে। না নেই। না থাকুক। আমাদের আনন্দে খামতি কোথায়? ঠিক যে, বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে আনন্দ-স্ফূর্তি-উল্লাস-সুখের ঘাটতি। মাঝে মাঝে দেখা তব পাই, চিরদিন কেন পাই না। না-পাওয়ার বেদনায় বলি, ‘তুমি আমার সকল কাজে, সন্ধ্যাসাঁঝে অন্তরালে/ থাকো আসমুদ্র- দিকচক্রবালে।’ মূল কথা এই। বাংলাদেশ আবেগে-উচ্ছ্বাসে ভেসে যায়, উদ্বেলিত হয়, প্রাণে বাজে সহস্র বীণা। ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা। একুশে ফেব্রুয়ারি, স্বাধীনতা দিবস, পয়লা বৈশাখ, বিজয় দিবস ঘরে-ঘরে যখন মৃত্তিকালগ্ন, দূরদেশে, নির্বাসনেও একাত্ম হই বাংলার মানুষের বাঁধভাঙা প্লাবনে। আমাকে বাঁচিয়ে রাখে। এই বাঁচার নামই বাংলাদেশ। যে দেশ জয়ে আনন্দে কাঁদে, যে দেশ পরাজয়ে বলীয়ান হয়, শপথে-প্রত্যয়ে দৃঢ়, যে দেশ প্রতিটি সংগ্রামে জয়ী, যে দেশ তারুণ্যে ভরপুর, যে দেশ আধ-মরাদের ঘা মেরে বাঁচায়, ক্রিকেটে পাকিস্তানকে হারানো উপলক্ষমাত্র, সেই দেশের সবুজ, কাঁচাদের কাছে নতজানু। কুর্নিশ। ঘা মেরে বাঁচাও আমাদের। হোক তা ক্রিকেট। আমিও আবেগাক্রান্ত। অগ্রজ মাকিদ নিশ্চয় ‘কুফা’ বলবেন না আর। লেখক : জার্মান প্রবাসী [email protected]
×