ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মুহম্মদ শফিকুর রহমান

শিশুরা মাতৃক্রোড়েও নিরাপদ নয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ৫ মার্চ ২০১৬

শিশুরা মাতৃক্রোড়েও নিরাপদ নয়

লেখার ইস্যু অনেক : দৈনিক জনকণ্ঠে (৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬) দেখলাম বিএনপি সংস্কারপন্থী নেতা মেজর (অব) হাফিজ বলেছেন, এটিএম কার্ড জালিয়াতিতে আওয়ামী লীগ জড়িত? এটি তাদের চিরাচরিত মিথ্যাবচন। ১. চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে মাদক চোরাচালানি ট্রাকচাপা দিয়ে দু’জন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করেছে। ট্রাকটি ফেনসিডিল নামক ভয়াবহ মাদক বহন করছিল। ২. স্বাধীনতার মাস মার্চে পাকিস্তানকে হারাল আমাদের টাইগাররা। ৩. রাজধানীর বনশ্রীতে দুই সন্তান অরণী ও আলভীকে হত্যার দায়ে মা মাহফুজা মালেক আইনের কাঠগড়ায়। তবে শেষোক্ত ঘটনাটিই আজকের লেখার ইস্যু হওয়া উচিত বলে মনে করছি। অরণী এবং আলভী। অরণী ঢাকার বিখ্যাত ভিকারুন্নিসা নূন স্কুল এ্যান্ড কলেজে ৫ম শ্রেণীতে এবং আলভী তাদের বাসার কাছে একটি স্কুল পড়ত। বলা হচ্ছে, তাদের মা মাহফুজা মালেক সন্তানের ভবিষ্যৎ লেখাপড়ার চিন্তা থেকে মানসিক চাপে তাদের হত্যা করে। তাও আবার একটি ওড়না জড়িয়ে পর পর দু’জনকে একই সময়। প্রথমে মেয়ে অরণীকে এবং পরে ছেলে আলভীকে। দু’টি শিশু। নিষ্পাপ নির্মল। এখনও তাদের ভবিষ্যৎ চিন্তা করার বয়স হয়নি। সংবাদপত্রের মাধ্যমে যা জানতে পারলাম তাতে পরিবারটি অর্থনৈতিকভাবেও সচ্ছল। বাচ্চাদের বাবাও জীবিত। প্রতিবেশী বা আপনজন কারও সঙ্গে কোন ঝগড়া-ফ্যাসাদের খবরও সংবাদপত্রে নেই। তবে একটি কাগজে দেখলাম তাদের ‘মার পরকীয়া’ সন্দেহ করা হচ্ছে (?) এটি সন্দেহের পর্যায়েই থাকুক। কিন্তু তাহলে কেন বাচ্চা দু’টিকে মরতে হলো। নাকি হত্যাকারী ওদের মা নয়, অন্য কেউ। এসব প্রশ্নের জবাব কি? ক’দিন আগেও ৪টি শিশুকে একসঙ্গে হত্যা করে মাটি চাপা দেয়া হয়। অবশ্যই অপরাধীরা পার পায়নি। ধরা পড়েছে। কারণও মোটামুটি পরিষ্কার। সিলেটের রাজন হত্যার জন্য দায়ী ব্যক্তিরাও শনাক্ত এবং আইনের কাঠগড়ায়, ফাঁসির দড়িতে। তবে সাংবাদিক সাগর-রুনি হত্যার কোন কিনারা হয়েছে বলে জানা নেই। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে? শিশু-কিশোর-কিশোরীরা টার্গেট হচ্ছে? অনেক ক্ষেত্রে ৩/৪ বছরের শিশুকেও রেপ করে হত্যা করা হচ্ছে। প্রায়শই এমন ঘটনা ঘটছে। এসবকে সমাজের অস্থিরতা বললে সব বলা হবে না। নিশ্চয়ই এর পেছনে কারণ আছে। অথচ আমাদের শিক্ষার হার বেড়েছে, দারিদ্র্য নেই বললেই চলে। ঢাকার বস্তিবাসী রিকশাচালক বা গ্রামের কৃষক শ্রমজীবী মানুষ এখন দিনে ৬০০-১০০০ টাকা রোজগার করে। ৬০০ টাকা রোজগার মানে একদিনের আয়ে এক মণ ধান কিনতে পারছে। তারপরও কেন করছে এসব? গ্রামীণ জীবনেও হাতে হাতে মোবাইল ফোন, টেলিভিশন। আমি মনে করি দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক ভ-ামি, পবিত্র ধর্মের অপব্যবহার, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক লুটপাটের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার, মানুষের মধ্যে লোভ বেড়ে যাওয়া এবং এসব কারণে মানুষ হয়ে পড়েছে মূল্যবোধহীন। মানুষের মধ্যে খোদাভীতির চেয়ে মিথ্যার বেসাতি, চুরি-চামারি-লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ-সম্পদ বৃদ্ধির প্রবণতা অধিক হওয়ায় মানুষ যে কোন কাজ, সে হত্যা-সন্ত্রাস-নারী ধর্ষণ কোন কিছুতেই অপরাধবোধ কাজ করছে না। মানুষের মধ্যে যখন অপরাধবোধ কাজ করে না, তখন সে আর মানুষ থাকে না। সব মানুষই মূলত ‘হায়ওয়ান’। তবে ‘হায়ওয়ানে নাতেক’ বা কথা বলতে পারে বা মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। বিবেক-বুদ্ধি অন্যান্য হায়ওয়ানের মধ্যেও আছে, তবে তারা প্রকাশ করতে পারে না। মানুষ প্রকাশ করতে পারার, পাশাপাশি লেখাপড়া এবং পারিপার্শ্বিকতা থেকে শিখে বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন হয়ে ওঠে বলেই সে মানুষ। নইলে মানুষের সঙ্গে অন্যান্য হায়ওয়ান বা পশুর পার্থক্য কোথায়? নইলে সম্পদ নিয়ে একে অন্যকে মারে, রাজনীতিতে পক্ষ-প্রতিপক্ষকে আঘাত করে বুঝি, প্রেমিক-প্রেমিকা হতাশায় আক্রান্ত হয়ে আত্মহত্যা করে সেও না বোঝার কিছু নেই; কিন্তু আজকাল ভাইয়ে-ভাইয়ে ঝগড়া, আক্রান্ত শিশুরা; স্বামী-স্ত্রীতে ঝগড়া, আক্রান্ত শিশুরা; বাড়ি বাড়ি ঝগড়া, আক্রান্ত শিশুরা; পাড়ায় পাড়ায় ঝগড়া, আক্রান্ত শিশুরা- এ তো মানুষের সমাজ নয়, যেন জংলি সমাজ। যারা শিশুদের হত্যা করে তারাও মানুষ নয়, জংলি পশু। বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতিতে ফেল মারলেও একটা জায়গায় সফল বলতেই হবে। অর্থাৎ জামায়াত-শিবিরকে আশ্রয়-প্রশ্রয় প্রদান এবং পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করা। এ যে তিনি পেট্রোলবোমার যে কালচার সমাজে, রাজনীতিতে চালু করে দিলেন তাতে করে তিনি মানুষের সমাজকে জংলি হায়ওয়ান বানানোর জন্যে দায়ী। কল্পনা করলে কার না গা শিউরে উঠবে। একজন মানুষ দিনভর অফিস ক্লান্ত-শ্রান্ত হয়ে ঘরে ফিরছে বাসে-ট্রেনে-টেম্পো বা অন্য কোন যানবাহনে, হঠাৎ করে একটি পেট্রোলবোমা যাত্রীদের পুড়িয়ে অঙ্গার করে দিল, যানটিও পুড়ে ছাই হলো। ৫ জানুয়ারি ২০১৪-এর আগে ২০১৩ এবং ২০১৫-এর ৫ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিন রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী পেট্রোলবোমায় কয়েকশত মানুষ নিহত, হাজারো আহত হয়ে আজও কাতরাচ্ছে। এটি কোনভাবেই স্বাভাবিক ঘটনা নয়। এটি অবশ্যই জংলি হায়ওয়ানেরই কর্মকা-। নইলে যারা এসব করল, যে বা যিনি এর গডফাদার তার মধ্যে কি সামান্যতম অপরাধবোধ কেউ লক্ষ্য করছে? না, করছে না। নইলে ঝগড়াটা হচ্ছে রাজনীতির, মরছে নিরীহ অফিসগামী কর্মজীবী-শ্রমজীবী মানুষ, যারা রাজনীতি করে না। যেমন সমাজের অস্থিরতার শিকার হচ্ছে কোমলমতি শিশু-কিশোর-কিশোরীরা, যারা অস্থিরতা কি জিনিস এখনও বুঝে ওঠেনি। ওরা যে মানুষ সে বোধও তাদের হয়নি। তবুও তাদের জীবন দিতে হচ্ছে। ঐশীরা বাবা-মাকে হত্যা করে, আবার অরণী-আলভীর বাবা-মা তাদের হত্যা করে। এও তো সেই পেট্রোলবোমায় মানুষ হত্যারই ঘটনা। আমাদের দেশে আবার আরেক দল আছে যারা মনে করে মানুষ (নাস্তিক বা ব্লগার?) হত্যা করতে পারলে সরাসরি বেহেস্তের সিঁড়ি পাবে। এ ক্ষেত্রেও খালেদা জিয়া বেশ সফল হয়েছেনÑ হিযবুল মুজাহিদীন, হিযবুত তাহরীর, হামযা ব্রিগেড বা আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বানিয়ে মাঠে ছেড়ে দিয়েছেন মানুষ হত্যার জন্য। সে মানুষ সত্যি সত্যি নাস্তিক কিনা বা কেবলই ব্লগার এবং ধর্মহীন হয়, সে কি ধর্ম বিশ্বাসী, নাকি ধর্ম বিশ্বাসী না, এসব তো তারা ভাবে না। তাছাড়া ইসলাম কি বলেছে কোন একজন ধর্মে বিশ্বাস করে না, তাকে হত্যা করলে বেহেস্তে যাওয়া যাবে, এতো ইসলামের শিক্ষা নয়; বরং যে মানুষ ধর্মে বিশ্বাস করে না, ধর্মের অনুশাসন পালন করে না, তার বিচার তো আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই করবে বলে শুনেছি। তাহলে এভাবে মানুষ হত্যা কেন? তৃতীয়ত, মানুষকে অমানুষ করে তোলে আরেকটি ভয়ঙ্কর বস্তু এবং তা হলো ড্রাগ বা মাদকদ্রব্য। এর বিভিন্ন নাম রয়েছে, যেমন : হেরোইন, (হালের) ইয়াবা, ফেনসিডিল, হাশিশ প্রভৃতি। এগুলো মানুষকে কতখানি অমানুষ করে তোলে তার প্রমাণ তো বৃহস্পতিবার চাঁপাইনবাবগঞ্জের কানসাটে ফেনসিডিলবাহী একটি ট্রাক পুলিশের দু’জন সাব ইন্সপেক্টরের ওপর দিয়ে চালিয়ে তাদের হত্যা করেছে। ট্রাকটির চালক এত মাদকাসক্ত ছিল যে, পুলিশকেও তার ভয় নেই। ঐশীর কথা তো আগেই বলেছি। কানসাটেও পুলিশ হয়ত ট্রাকটিকে চ্যালেঞ্জ করেছিল, পরিণতিতে তাদের জীবন দিতে হলো। আজ রাজধানী ঢাকা থেকে তামাম শহর ছাড়িয়ে গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ড্রাগ ছড়িয়ে পড়েছে। ড্রাগ এখন তরুণ-তরুণীদের হাত ধরে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়ছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের ব্যাপার হলো, হয়ত কানসাটের ওই ট্রাক চালকের ফাঁসি হবে (এরই মধ্যে সে ধরা পড়ছে শুনেছি)। কিন্তু এই ফেনসিডিল কে ট্রাকে তুলল, ট্রাকের মালিক কে? কে মূল ড্রাগ চোরাচালানি? তার সঙ্গে কোন রাজনৈতিক নেতা (সরকারী বা বিরোধী দল), কোন মন্ত্রী, কোন এমপি, কোন সিভিল-পুলিশ আমলা, কোন সুশীল জড়িত, তা কেউ জানবে না। আজ পর্যন্ত কক্সবাজারের বদি এমপি ছাড়া অন্য কোন গডফাদার বা চোরাচালানি ধরা পড়েছে এমন কোন নজির নেই। একজন বদিই কেবল কোটি কোটি ইয়াবা এনে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দিচ্ছে এটিও কি বিশ্বাস করতে হবে? কারা সেই সব গডফাদার? তাদের ধরে জনসমক্ষে তুলে না ধরা পর্যন্ত এ প্রাণনাশী মাদক থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না। ভারত সরকারও এসব প্রশ্নে নির্বিকার, বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি অনেক বড় বড় কথা বলেন : কিন্তু তার এলাকায় ফেনসিডিলের কারখানা যে রয়েছে তা তার জানা দরকার এবং ব্যবস্থা গ্রহণ দরকার। আমাদের সরকারকেও এ প্রশ্নে মমতা ব্যানার্জির সঙ্গে কথা বলতে হবে। নইলে সমাজ আরও অস্থির হবে, সমাজে মানুষরূপী হায়ওয়ানের সংখ্যা আরও বাড়বে। অরণী-আলভীরা মাতৃক্রোড়েও নিরাপদ নয়, থাকবেও না। ঢাকা- ৪ মার্চ ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×