ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

পাহাড়ী মারমাদের বিশ্বাস

নাচ থেকে ভাষার উৎপত্তি

প্রকাশিত: ০৩:৩৩, ৫ মার্চ ২০১৬

নাচ থেকে ভাষার উৎপত্তি

জহার গড়লাগি-এই কথাটি উপজাতি সম্প্রদায়ের ভাষা। যার অর্থ শুভেচ্ছা নেবেন। দেশের বিশাল এক জনগোষ্ঠী উপজাতি। যে সংখ্যা অন্তত ৩০ লাখ। বংশ বৃদ্ধি পেয়ে এই সংখ্যা দিনে দিনে বাড়ছে। দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে অধিকাংশ আদিবাসীর বাস। পূর্বাঞ্চলে বিশেষ করে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা ও সিলেট অঞ্চলে উপজাতিরা নিজস্ব বলয়ে বহু বছর ধরে বাস করছে। তাদের জাতিসত্তার দিক থেকে সবচেয়ে বেশি বাস সাঁওতাল (সান্তাল) উড়াও, মন্ডা, মাহালি, মালো, পাহাড়ী মাল, পাহাড়ী পাহান, রাজোয়ার, কোল কিসদু, হাঁসদাক, সোরেন টুন্ডু, বাসকে বেসরা, হেমরেম মাড়ান্ডি, চোড়ে, পাওরিয়া ইত্যাদি। উড়াও সম্প্রদায়ের দশটি গোত্রের মধ্যে বহু উপগোত্র রয়েছে। প্রধান গোত্রগুলো হলো- টিরকী, মিনজি, টিগা, খুজুর, নাকড়া, কিসকাট্টা, বড়া, এক্কা কেরকাট্টা। বংশ ও গোত্রের নাম শুনলে সহজে বোঝা যায় এদের আলাদা ভাষা আছে। এরা বাড়িতে যে ভাষায় কথা বলে (কখনও কখনও লেখে) স্কুলে গিয়ে সেই ভাষা শুনতে পায় না। যে বাংলা ভাষা শোনে তা শিশুদের কাছে মনে হয় অচেনা। এরা অ আ ক খ বর্ণমালা লেখা শেখার পর বাংলা ভাষা কিছুটা আয়ত্ত করতে পারে এবং শেষ পর্যন্ত বাংলা ভাষা লালন করেই বেড়ে ওঠে। উপজাতিদের অনেকেই এখন উচ্চশিক্ষিত হয়ে বড় ও ভাল চাকরি করছে। তাদের একজন পৌল চারোয়া তিগ্যা। দিনাজপুরের উঁড়াও সম্প্রদায়ের। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সমাজবিজ্ঞানে ¯œাতকোত্তর ডিগ্রী নেয়ার পর ব্রিটেন ও নরওয়ে থেকেও ডিগ্রী নিয়েছেন। তিনি বেসরকারী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক। তার মতে আদিবাসীকে দুই ভাগে সংজ্ঞায়িত করা যায়Ñ ভৌগোলিক ও সাংস্কৃতিক। ভৌগোলিক অর্থ এককালে বিভিন্ন স্থানে ছিল এখন এক দেশে বাস করছে। যখন বলা হয় এ দেশের আদিবাসী তাহলে তারা অন্য জায়গা থেকে প্রথমে এসে বসতি গড়েছে। সাংস্কৃতিকভাবে বললে যাদের জীবনযাত্রা খুবই সহজ সরল জটিল টেকনোলজিতে নেই। এদের ভাষার কোন বর্ণমালা নেই। বর্ণমালা না থাকায় সম্প্রদায়ভিত্তিক ভাষা পাল্টে যায়। যেমন বাংলা বাক্যে বলা হলো ‘তিনি উড়াও সম্প্রদায়।’ সাঁওতালরা বলবে ‘উনি দো উড়াও কোরেন তারেনাকা’। এই কথাটিই উঁড়াওরা বলবে ‘আস কুড়কু সামজানতা আলাস রাচাস’। আদিবাসীদের স্কুল দেখে বাংলায় বলা হলো- এই স্কুলটির নাম উচাই জেরকা আদিবাসী উচ্চবিদ্যালয়। উঁড়াও সম্প্রদায় বলবে ‘আককন ই পড়হানা এড পাগিহি নামে মানজা উচাই ওজরকা আদিবাসী কোহাপোড়তান এড়পা’। সাঁওতালরা বলবে ‘নিত স্কুল রিয়া নুতুমাদা উচাই জেরেকা আদিবাসী উচ্চবিদ্যালয়। টেনসভিত্তিক ভাষাও আছে এদের। যেমন বাংরাং আমি করি। সাঁওতালরা বলবে ইঞ গেঞ কামিয়া। উড়াও বলবে ‘এন নানদান’। আমি করিতেছি এই কথাটি যথাক্রম ম্ংে কামিয়েদা ও এন নানানুগুদান। পাহাড়ী মারমাদের কথা এসেছে নাচের উপাদান থেকে। তারা মনে করে পৃথিবীর আদি ভাষা হলো নাচ। নাচ থেকেই উৎপত্তি হয়েছে ভাষার। এ্যবরজিনাল গ্রন্থের এক জায়গায় বলা হয়েছে, বাংলার প্রাচীনতম ভাষা হলো সাঁতালী। কয়েক হাজার বছর আগে যখন এই দেশে আর্য জাতির আগমন হয়নি, তখন যারা বাসপোযোগী করে তুলেছিল তারাই আমাদের পূর্বপুরুষ। কোন পাহাড়ী নদীর ধারে অথবা বনভূমির প্রান্তে পূর্ণিমার চাঁদ উঠত তখন তারা কুটির থেকে বের হয়ে নাচত গাইতো ফুলের মালা পরাত। এই গানের ভাষা চলে এসেছে নাচ থেকেই। পাহাড়ী উপজাতিদের ভাষায় দেখা যায় জোছনা রাতে নাচের সঙ্গেই ভাষা এসেছে। এদের চারা রোপণ থেকে আনন্দ উৎসবের ভাষায় নাচ এসেছে। এদের একটি নাচের নাম হুগতাংমানি। সেই নাচের কয়েকটি কথা- ‘রাজা বা কইতন আছানি মিতায় কাঙ্গাল মামিতা বি অ রাজা বাতান মিছিল মার্থনা কাঙ্গাল এক কুকুর যার...’। যার মর্মার্থ হলো- রাজা বড় পুজো করেন, আমরা গরিব আমরা মামিতা পুজো করি। রাজা বড় মোষ বলি দেন, আমরা গরিব সাদা মুরগি বলি দেই।’ এই সহজ সরল মানুষেরা (সাঁওতাল) যখন দেখে অন্যায় অবিচার, তখন ফুঁসে ওঠে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সাঁওতাল বিদ্রোহের। হানাদার পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন একাত্তরের মার্চে নিরীহ বাঙালীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই সময় মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে সাঁওতালরা তীর ধনুক নিয়ে পাল্টা আক্রমন চালায় আধুনিক অস্ত্রধারী সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে। সাঁওতালদের তীর ধনুক নিয়ে আদিবাসী সমাজে একটি মিথ আছে। তা হলো-ধনুকের পিঠের দিকটি বাঁশের তৈরি কঠিন ও সুডৌল। দুই দিকের সুচালু ত্রিকোন অগ্রভাগ পুরুষের প্রতীক। ধনুকের ছিলা হলো নারীর প্রতীক। সৃষ্টির আদিতে নারী পুরুষকে বলেছিল তুমি অর্ধচন্দ্রের মতো নমনীয় হও আমি মিলিত হবো। তুমি আর আমি মিলিত হলে সৃষ্টি হবে। নারীর কথা শুনে পুরুষ এগিয়ে এসেছিল। তৈরি হয়েছিল পূর্ণাঙ্গ ধনুক। সেই ধনুকে শরসন্ধান করা হলো। শর বা তীরই হলো সন্তান। তাই তীর-ধনুক আদিবাসীদের হাতিয়ার শুধু নয়, বঞ্চিত জীবনের একতারা। এরা এখন এদের ভাষায় গেয়ে ওঠে ‘দেকোতে আলম বড় বয়হাহাড়তে বড়মে গগোয়া : বলি হেড়েম হেড়েম গে, বাবায়া : বলি আটি সাফা গেয়া। বাংলা করলে দাঁড়ায়- অন্যের বুলি মুখে না তুলি মাতৃভাষায় বল মাতৃভাষা মধুর অতি পিতৃভাষা স্বচ্ছ স্ফটিক জল। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×