ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্রভাবশালী ও পেশীশক্তির চাপে করতোয়া এখন মৃতপ্রায়

দখলদারদের কালো থাবা

প্রকাশিত: ০৩:২৬, ৫ মার্চ ২০১৬

দখলদারদের কালো থাবা

সমুদ্র হক ॥ কোনভাবেই ভাঙ্গা যাচ্ছে না করতোয়া নদী দখলদারদের কালো থাবা। তাদের হাত এতটাই লম্বা যে আইনকেও তোয়াক্কা করে না। প্রশাসনের অজ্ঞাত কারণে নীরবতা এবং প্রভাবশালীদের অর্থ ও পেশীশক্তির চাপে একদার প্রমত্তা করতোয়া এখন আর মৃত্যুপ্রায় নয় মরেই যাচ্ছে। অবস্থা এমনই যে উত্তরাঞ্চলের মধ্য নগরী বগুড়ার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া এই নদী তার অস্তিত্বই রাখতে পারবে কিনা এই সংশয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। প্রবীণরা তবুও বলেন একদা এখানে নদী ছিল। করতোয়ার তীরে ছিল এই নগরী। যেভাবে নগরীর বহুতল ভবনগুলো গগনচুম্বী হচ্ছে তা দেখে প্রজন্মরা বলবে ‘নতুন এই নগরীর নিচেই ছিল করতোয়া নদী যা এখন মাটির ওপর জলের ওপর নয়। সমানের দিনে করতোয়া নদী শুধুই থাকবে প্রবীণ ও আজকের মধ্যবয়সীদের স্মৃতি হয়ে। আর প্রজন্মের কাছে থাকবে পূর্বসূরিদের কাছ থেকে শোনা কোন গল্প। গল্পকথার কল্পলোকের ধারায় শীর্ণকায় এই নদীকে এখনও কিছুটা দেখা যাবে করতোয়া সেতুর নিচে। যেখানে কেবলই পায়ের পাতা স্পর্শ করে এমন পানি কোন রকমে ড্রেনের পানির মতো স্থির হয়ে আছে। এই প্রান্ত থেকে ওই প্রান্ত হেঁটেই পার হওয়া যায়। তবে কেউ হেঁটে পার হয় না। কারণ শহরের তাবত আবর্জনা ফেলে পুতি দুর্গন্ধময় করে তোলা হয়েছে। পৌর কর্তৃপক্ষের কাছে করতোয়া এক ভাগাড়। শহরের কেন্দ্রস্থল সাতমাথা থেকে পূর্বে দেড় শ’ মিটার এগিয়ে গেলে তিনটি বহুতল মার্কেটের পেছনের দিকে গেলে স্পষ্ট দেখা যাবে কিভাবে একটি বেসরকারী সংস্থা অভিজাত বহুতল মার্কেটের একাংশ গড়ে তুলেছে নদীর তীর এবং ভেতরের অনেকটা নদীভূমি দখল করে। প্রশাসনের নাকের ডগায় দেশের আইনকে উপেক্ষা করে এভাবে এমন একটি বৃহৎ স্থাপনা গড়ে তোলার পরও নদী দেখভালকারী সংস্থা পানি উন্নয়ন বোর্ড ও প্রশাসন কোন ব্যবস্থাই নেয়নি। বছর কয়েক আগে বগুড়া প্রশাসনের উর্ধতন এক কর্মকর্তা নদী দখলকারীদের তালিকা তৈরি করে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নেয়ার দিনকয়েকের মধ্যেই বদলি হয়ে যান। এরপর প্রশাসন মাঝেমধ্যে লোক দেখানো উদ্যোগ নেয় কাজের কাজ কিছুই হয় না। লোকজন বলাবলি করে পর্বতের মূষিক প্রসব। যে প্রতিষ্ঠানটি নদী দখল করে মার্কেট বানিয়েছে সেই প্রতিষ্ঠান গেল ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে সদরের ঠেঙ্গামারা এলাকায় নদীতে উচ্চ শক্তির ইঞ্জিন পাম্প বসিয়ে বড় ব্যাসার্ধের পাইপ দিয়ে নদীর গভীরে থেকে বালি উত্তোলন করে। এলাকার লোকজন প্রশাসনকে খবর দেয়। উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখতে পায় কিভাবে শুকনো নদীর ভূগর্ভস্থ স্তর থেকে বালি তোলা হচ্ছে। ঘটনাস্থলেই বেআইনী কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। ব্যবহৃত যন্ত্রগুলো জব্দ করা হয়। দু’দিন পরই দেখা যায় একই স্থানে যন্ত্র বসিয়ে ফের নদীর টুঁটি চেপে ধরে বালি উত্তোলন করে নদীকে সমতল ভূমি বানানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এবার প্রশাসনের কেউ ঘটনাস্থলে যায়নি। নদী হন্তারক কর্তৃপক্ষের সাফাই যুক্তি; তারা নিজেদের কাজের জন্য বালি উত্তোলন করছিল। যখন জিজ্ঞাসা করা হয় নদী থেকে বালি উত্তোলন করা বৈধ কি না, তাদের উত্তর সকলেই তুলছে তারাও তুলছে (কি চমৎকার যুক্তি)। করতোয়া নদীর নাব্য হ্রাস করে মেরে ফেলার প্রক্রিয়া শুরু হয় ’৮০-এর দশকের শেষভাগে। ১৯৮৭-৮৮ সালে তৎকালীন সরকার একটি এলাকার বন্যা নিয়ন্ত্রণে নদীর উজানে গোবিন্দগঞ্জের কাটাখালীর কাছে চক রহিমপুরে একটি রেগুলেটর স্লুইসগেট বানিয়ে নদীর প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়। এরপর বগুড়ার দিকে প্রবহমান নদী ভিন্ন পথে চলে যায়। ফলে একদিকে নদী শুকিয়ে রুগ্ণ শীর্ণকায় হতে থাকে আরেকদিকে নদী দখলকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে। বগুড়া শহরের মালতীনগর, নামাপাড়া, এসপিঘাট ব্রিজ, চেলোপাড়া এলাকায় গিয়ে সহজেই চোখে পড়বে কিভাবে দখলকারীরা চর দখলের মতো নদীভূমি দখল করছে। শহরের মাটিডালি বাজার এলাকায় দ্বিতীয় বাইপাস সংযোগ সড়কে নদীর ওপর নির্মিত বেইলি ব্রিজের এক প্রান্ত ভরাটের পর অবকাঠামো নির্মিত হতে দেখা যায়। তার পাশেই নদীর মধ্যে দখল করে নির্মাণ কাজ শুরু হয়েছে। নদী দখল থেমে নেই। করতোয়া নদী বাঁচানোর জন্য পরিবেশবিদরা মানববন্ধন করেছে। নদীর ভেতরে গিয়ে কোদাল দিয়ে দখলকৃত ভূমি প্রতীকীভাবে কেটে প্রতিবাদ করেছে। মিছিল করেছে। কিছুই হয়নি। পরিবেশ আন্দোলনের সভাপতি ডাঃ সামির হোসেন মিশু বলেন, নদী দখলকারীদের উচ্ছেদের আবেদন করেও কোন ফল মেলেনি। উল্টো দখলের মহোৎসব শুরু হয়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের বিভাগীয় কর্মকর্তা বলেন, নদী দখলকারীদের রুখতে সকলের আগে এগিয়ে আসা দরকার প্রশাসনের। তবে পরিবেশ আইনের একটি সংশোধনের ফলে পরিবেশ অধিদফতর ব্যবস্থা নিতে পারে। চেষ্টা করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায় খোঁজখবর করে আইননানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের কথা নদী রক্ষা কমিটি সীমানা চিহ্নিত করে খুঁটি বসিয়ে ভেতরের দখলদারদের উচ্ছেদের ব্যবস্থা করা হবে। নদী রক্ষার সকল প্রতিষ্ঠনের কথা এই হবে এই হচ্ছে। কিছুই আর হয় না। দখলকারীরা দিনে দিনে বেপরোয়া হয়। এ খেলা চলছে নিরন্তর...।
×