ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মাহবুবা সুলতানা মনি

বিশ্ব নারী দিবস ও আমাদের অর্জন

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৪ মার্চ ২০১৬

বিশ্ব নারী দিবস ও আমাদের অর্জন

১৮৫৭ সালের ৮ মার্চ। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে একটি সুচ কারখানার নারী শ্রমিকরা দৈনিক শ্রম ১২ ঘণ্টা থেকে কমিয়ে ৮ ঘণ্টায় আনা, ন্যায্য মজুরি এবং কর্মক্ষেত্রে সুস্থ ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ নিশ্চিত করার দাবিতে সোচ্চার হয়েছিলেন। ঐতিহাসিক সংগ্রামের স্বীকৃতিস্বরূপ ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস ঘোষণা করে জাতিসংঘ। আজ ব্যাপকভাবে বিশ্বজুড়ে পালন করা হয় দিবসটি। মানুষ হিসেবে একজন নারী পরিপূর্ণ অধিকারের দাবিতে সুদীর্ঘকাল যে আন্দোলন চালিয়ে আসছে, তারই সম্মানস্বরূপ সারা বিশ্বে পালিত নারী দিবস। অন্তত একটা দিন গোটা বিশ্ব আলাদা করে মনে করে নারীরাই এই জগতের শক্তির উৎস আর প্রেরণা। সামাজিক কর্মকা-ের বিভিন্ন ধারায় দেখা যায়, নারী কোন অংশেই পেছনে ছিল না। ফ্রান্সের প্যারি কমিউন, ফরাসী বিপ্লব, যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিক আন্দোলনসহ ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রাম, ১৯৭১-এর স্বাধীনতার সংগ্রামে পুরুষের পাশেই নারীকে দেখা গেছে। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের নারীরা সর্বক্ষেত্রে এগিয়েছে দুর্দান্ত গতিতে। তাদের অসামান্য অর্জনে অবাক হয়েছে বিশ্ববাসী প্রতিনিয়ত। কি পাহাড়চূড়া, কি সমতল; কি জলরাজ্য, কি অনন্ত গগন-সর্বক্ষেত্রেই বাংলার নারীর দীপ্ত বিচরণ সত্যিই ঈর্ষা করার মতো! বিশ্ববাসী এখন জানে, বাংলাদেশের রয়েছে দু’জন এভারেস্টজয়ী নারী। নিশাত মজুমদার এবং ওয়াসফিয়া নাজরীন। এঁদের মধ্যে ওয়াসফিয়া শুধু এভারেস্ট জয় করেই থেমে নেই। তিনি বরং সাতটি মহাদেশের সাতটি সর্বোচ্চ শৃঙ্গ জয়ের মাধ্যমে বাংলাদেশের নারীদের ভিন্ন এক উচ্চতায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছেন। সম্প্রতি ন্যাশনাল জিওগ্রাফির বর্ষসেরা অভিযাত্রীর খেতাব পেয়েছেন ওয়াসফিয়া। আর বাংলাদেশের জাতীয় নারী ক্রিকেট দল তো মাঝেমাঝে পুরুষদের চেয়েও এগিয়ে যাচ্ছেন সাফল্যের বিচারে। নারীরা বিভিন্ন অর্থনৈতিক ক্ষেত্রকেও সমৃদ্ধ করছে। দেশে-বিদেশে এদেশের মর্যাদা ও সম্মান অনেক উঁচুতে নিয়ে গেছে তারা। সম্প্রতি ব্রিটেনের নির্বাচনে তিন বাঙালী কন্যা টিউলিপ সিদ্দিকী, রূপা হক আর রুশনারা আলীর জয়লাভ এদেশের নারীদের নিয়ে গেছে এক অনন্য উচ্চতায়। নারীদের এ অর্জন শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে শান্তি মিশনে এদেশের নারীরা কাজ করছে। দেশের ভেতরও তাদের অর্জন কম নয়। নারীরা এখন সেনাবাহিনীতে কাজ করছে। কয়েক দশক আগেও যা ছিল কল্পনার বাইরে। তামান্না-ই-লূৎফী। সামরিক বাহিনীর প্রথম পাইলট হিসেবে সফলভাবে হেলিকপ্টার উড্ডয়ন সম্পন্ন করে সকলকে তাক লাগিয়ে দেন। সামরিক বাহিনীতে নিঃসন্দেহে নারীদের জন্য এক বিরাট সাফল্য। নারীরা সেই অসাধ্য সাধন করেছে মাত্র কয়েক বছরে। পুরুষদের অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করে, নারীরা চ্যালেঞ্জিং কোন রিপোর্ট করতে পারবেন কিনা। অনেকেই মনে করেন নারীরা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে থাকে, ঝুঁকিপূর্ণ কাজ বা রাতে রিপোর্টিংসহ প্রতিকূল পরিবেশে কাজ করতে পারবে না। তাছাড়া সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিও নারীদের সাংবাদিকতা পেশার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। এমন শত প্রতিবন্ধকতা ঠেলে নারী আজ সাংবাদিকতায় নিজের অবস্থান তৈরি করছে। বাংলাদেশকে ইতিবাচক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার সংগ্রামে নারী সাংবাদিকরা তাদের কালি-কলমের মাধ্যমে সংগ্রাম করে চলেছেন। সুসংবাদ হচ্ছে, কয়েকদিন আগে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ এ্যাওয়ার্ড- আইডব্লিউওসি বা ‘আন্তর্জাতিক সাহসী নারীর পুরস্কার’ পেয়েছেন একাত্তর টেলিভিশনের সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন। সাহসিকতার স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশের তরুণ সাংবাদিক নাদিয়া শারমিন এবার এ পুরস্কারে ভূষিত হন। ফলে বিশ্ব মানচিত্রে বাংলার অপরাজিতাদের বিজয়কেতন, সত্যিই অসাধারণ! নাদিয়ার আগে আরেকজন বাংলাদেশী নারী এ পুরস্কার পেয়েছিলেন। নাদিয়া শারমিন দ্বিতীয় বাংলাদেশী নারী, সাহসিকতার জন্য এ পুরস্কার পেলেন। এছাড়াও ভারতে চলমান এসএ গেমসে ভারোত্তোলনে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম স্বর্ণ উপহার দিয়েছেন মাবিয়া আক্তার সীমান্ত। পরে সাঁতারের দুই ইভেন্টে আরও দুটি স্বর্ণ জেতেন বাংলাদেশের মাহফুজা আক্তার শিলা। দক্ষিণ এশিয়ার অলিম্পিক খ্যাত এসএ গেমসে বাংলাদেশের হয়ে সুনাম বয়ে এনেছেন এই দুই এ্যাথলেট।এই অর্জন বা গৌরব সমগ্র নারীদেরই নয়; সোনার বাংলাদেশের। গবেষণার ক্ষেত্রেও নারীরা বেশ খ্যাতি অর্জন করেছে। পাটের জিন উদ্ভাবন থেকে শুরু করে ইতিহাস গবেষণায় নারীরা বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। নারীরা শুধু শিক্ষকতায় নয়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের চ্যালেঞ্জিং প্রশাসনিক দায়িত্ব পালনেও পারদর্শী। সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রেও নারীরা পিছিয়ে নেই। তাই ফেসবুক-টুইটারের যুগে নারী লেখকদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। নারী উদ্যোক্তারা সফল ব্যবসায়ে। বিশ্বমানের অনেক ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান নারীদের দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে। রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ নতুন নয়। এখন প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেত্রী, অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রধান, স্পীকার, মন্ত্রী, সংসদ সদস্যসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করে রাজনীতিতে কেবল তাদের সরব উপস্থিতি নয়; প্রভাব বজায় রেখেছেন। ব্যক্তি স্বাধীনতার প্রশ্নেও নারীরা এখন অনেক এগিয়ে। স্বামীর নির্যাতন কিংবা অপছন্দের বিষয়গুলো মুখ বুজে সহ্য করে সংসার করার মতো মানসিকতা এখন অনেকে নারীদেরই নেই।
×