ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

লিপি হালদার

সমমর্যাদার জন্য লড়াই

প্রকাশিত: ০৭:০৯, ৪ মার্চ ২০১৬

সমমর্যাদার জন্য লড়াই

নারী-পুরুষের সমমর্যাদার কথা উঠলেই সমাজে দুটি প্রতিক্রিয়া খুব দ্রুত চোখে পড়ে। এ বিষয়ক অন্যতম একটি প্রতিক্রিয়া হচ্ছে, শারীরিক গঠনের কারণে নারী-পুরুষের অধিকার কখনই এক হওয়া উচিত নয়। অপর প্রতিক্রিয়াটি হলো- সমঅধিকার নারীকে পণ্য হিসাবে সমাজে উপস্থাপন করবে, তাই এই দাবি বর্জনীয়। যে দেশে রাস্তায় লোক পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়, শিশুকে অমানবিকভাবে হত্যা করা হয়, সমপ্রেমী বলে বাবা নিজেই মেয়েকে তুলে দেন চাচাতো ভাইয়ের কাছে ধর্ষণ করার জন্য, যেই সমাজে মেয়ে-স্ত্রীর গায়ে হাত তোলা বাবা, উচ্চকণ্ঠে কথা বলা ছেলে বা যে কোন পুরুষের কাছে অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা, সেই দেশে, সেই সমাজের জন্য নারী-পুরুষের সমমর্যাদার জন্য সচেতনতা তৈরি এবং আইনের মাধ্যমে সেই অধিকার বাস্তবায়নের কোন বিকল্প হতে পারে না। নারী-পুরুষের সমতা বা সমমর্যাদা মানে এই নয় যে, বাসে পুরুষ দাঁড়িয়ে গেলে নারীকেও দাঁড়িয়ে গিয়ে সমঅধিকার দেখাতে হবে, সমতা মানে এই নয় যে, পুরুষ ১০ কেজি ভার বইলে নারীকেও ১০ কেজি ওজনের ভার বইতে হবে, অথবা পুরুষ খালি গায়ে ঘুরে বেড়ালে নারীকেও তাই করতে হবে। বরং সমতা বলতে নায্যতাকেই গুরুত্ব দেয়া হয়। নারী-পুরুষের একে অন্যের শারীরিক, মানসিক গঠন এক নয়, সেই সীমাবদ্ধতা, একে অন্যের থেকে পৃথকতা মেনে নিয়েই মানুষ হিসেবে একে অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা, সাহায্যের হাত, পারস্পরিক সম্মানের দৃষ্টিভঙ্গি এনে দিতে পারে নারীর জন্য সমাজে সম্মানজনক অবস্থান। অনেকেই বলে থাকেন নারী সমাজে সর্বোচ্চ সম্মানে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু চলমান সমাজ ব্যবস্থায় তা পরীলক্ষিত হয় না। একটি মেয়ে সন্তানকে রাস্তায় ধর্ষিত হতে হয়, অধিকাংশ গ্রামে, শহরে তাকে সুরক্ষার জন্য ঘরের বাইরে একা যেতে দেয়া সম্ভব হয় না। ওপরদিকে শহর অঞ্চলে যে সকল নারীকে এগিয়ে আসতে দেখা যায়, এদের অনেককেই পুরুষের ভোগ্যপণ্য হিসেবে দেখতে, উপস্থাপন করতে সমাজের এক শ্রেণী মানুষ ব্যতিব্যস্ত থাকেন। অপরদিকে সমাজের আরেক শ্রেণী নারীকে এই ভোগ্যপণ্য থেকে বাঁচাতে ঘরের মধ্যে নানা বেড়াজালে আবদ্ধ করতে সচেষ্ট হন। মাঝে জাঁতাকলে পিষ্ট হন, পথভ্রষ্ট হন নারী, মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও থাকে না নিজের কোন সম্মানজনক অস্তিত্ব, অনেক নারীর জীবনযাপন হয় অমানবেতর। অথচ ভোগ্যপণ্য হিসেবে যে শ্রেণীর নারীকে, বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে তুলে ধরা হয়, তাদের অধিকাংশই সমাজের ঘরে ঘরে বসবাসরত অধিকাংশ নারীর জীবনযাপনকে প্রতিনিধিত্ব করে না। ফলে আজ এত বছর পরেও নারী দিবসে নারীর সমমর্যাদার বিষয়ে সচেতনতা গড়ে তুলতে আহ্বান করা হচ্ছে বিশ্বজুড়ে। ১৮৫৭ সালে মজুরি বৈষম্য, কর্মঘণ্টা নির্দিষ্ট করা, কাজের অমানবিক পরিবেশের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে যুক্তরাষ্ট্রের নিউয়র্কের রাস্তায় নেমেছিলেন সুতা কারখানার নারী শ্রমিকরা। সেই যুগের সকল নীপিড়ন শোষণের জাঁতাকল পার হয়ে, ১৯০৮ সালে নিউইয়র্কের সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট এবং জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯১০ সালে ১৭টি দেশ থেকে ১০০ জন নারী প্রতিনিধি যোগ দিয়েছিলেন ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে আয়োজিত ২য় সম্মেলনে । সেই সম্মেলনে ক্লারা প্রতিবছর ৮ মার্চ আন্তজার্তিক নারী দিবস হিসাবে পালনের ঘোষণা দেন, যেখানে নারীদের সম অধিকারের কথা বলা হবে। ২০১৬ সালের ৮ মার্চ, আন্তর্জাতিক নারী দিবসের এবারের প্রতিবাদ্য বিষয়, সমমর্যাদার জন্য অঙ্গীকার। এবারে জোর দেয়া হয়েছে মূলত নারী-পুরুষের সমমর্যাদাকে। নারী অথবা মেয়েকে তাদের লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে সাহায্য করাতেই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। একই সঙ্গে নেত্রীত্বে নারী-পুরুষের অংশগ্রহের সমতা। নারী-পুরুষ দুজনকেই জীবনের সফল হতে গেলে, সুখী হতে গেলে একে অপরকে বুঝতে পারা, সাহায্য করা, বিশ্বস্তার সঙ্গে আস্থা অর্জনের করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই শিক্ষা তৈরি হয় ছোটবেলা থেকেই। ঘরে আপনি আপনার বোনকে, মাকে কাজে সহযোগিতার মাধ্যমে সমতা আনতে পারেন যা পরবর্তিতে আপনার নিজের সংসারকেই সুন্দর করতে সাহায্য করবে। অনেক পুরুষই নিজের বোনকে, মাকে, স্ত্রীকে ঘরের সাধারণ কাজগুলোকে মেয়েদের কাজ বলে সাহায্য করতে এগিয়ে না গিয়ে মেয়েদের বাধ্য করেন নির্দিষ্ট ঘরের কাজগুলোতে, পাশাপাশি রয়ে যায় বাইরের কাজ, সন্তান পালন। অথচ সামান্য সাহায্যের হাত সম্পর্ককে করে তুলতে পারে আনন্দময়, অর্থবহ। একজন পুরুষ যতটা স্বাধীনভাবে বাইরে যেতে পারে, সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করতে পারে তা নারীর ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হয় না। বিয়ের পরে সীমাবদ্ধতা বৃদ্ধি পেতে থাকে আরও বেশি। একজন পুরুষ বা ছেলে বহু প্রেম, বহু বিয়ে করলেও সমাজ তার চরিত্র নিয়ে কোন উচ্চবাচ্য করবে না কিন্তু মেয়ের যদি বিয়ের আগে বন্ধু থাকে, পূর্ব কোন প্রেম থাকে (বহু বিবাহ হলে তো কথাই নাই) তাহলে সেই মেয়ের, নারীর চরিত্র বলে সমাজে কিছু থাকে না। এভাবেই সমাজে নারী/পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গি ঘরে, সমাজে, কর্মক্ষেত্রে, রাজনীতিতে, সামাজিক মাধ্যমে নারীকে বৈষ্যমের স্বীকার করে যাচ্ছে। সে কারণেই এখন সময় নারী-পুরুষের সমমর্যাদার অঙ্গীকারের যেন, যে শিশু সন্তানটি আজ আপনার ঘরে মেয়ে হিসেবে জন্ম নিল তার নিজের জন্য একটি নিরাপদ, সচেতন, সুশিক্ষার, সহায়ক জীবন থাকে। ভাই, বাবা, স্বামী, সহকর্মী, বন্ধু যে ভূমিকাতেই আপনি থাকুন না কেন, নিজেকে একজন বিবেকবান, বিচেক্ষণ, আস্থাশীল, সাহায্যশীল পুরুষ-নারী হিসেবে নিজেকে তৈরি এবং উপস্থাপন করুন। সমাজে, ঘরে, নেত্রীত্বে নারীর সমমর্যাদা মানুষ হিসেবে যতটা বৃদ্ধি পাবে, আপনিও ততটাই নিরাপদ জীবন কাটাবেন একজন ভাই, বাবা, স্বামী, বন্ধু, সহকর্মী হিসেবে। নারীর প্রতি যে কোন বৈষম্যমূলক আচরণের পূর্বে নিজেদের পশুত্বকে খুঁজে বের করে নির্মূল করা এবং আইন নিজের হাতে তুলে না নেয়াই হোক নারীর প্রতি সমমর্যাদায় আমাদের প্রথম অঙ্গীকার। একই সঙ্গে অর্জিত স্বাধীনতাকে বিচক্ষণতার সঙ্গে ব্যবহার করে অন্য নারীদের জন্য পথ সুগম করে দেবার দায়িত্ব অগ্রসরমান নারী নিজেরও। নারী-পুরুষের দায়িত্বশীল আচরণ এবং চিন্তাই বদলে দিতে পারে সমাজ, গড়তে পারে আলোকিত পারিবারিক এবং সামাজিক জীবন।
×