ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

ভারতীয় বাজেট ॥ কৃষকের আয় বৃদ্ধি করা হবে দ্বিগুণ

প্রকাশিত: ০৩:৫৮, ৪ মার্চ ২০১৬

ভারতীয় বাজেট ॥ কৃষকের আয় বৃদ্ধি করা হবে দ্বিগুণ

অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে গত সপ্তাহে ভারতে একটা ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটেছে। ভারতে প্রতিবছর বাজেট ঘোষিত হয় মার্চ মাসে এবং তা কার্যকর করা হয় এপ্রিল মাস থেকে। আমাদের বাজেট কার্যকর হয় জুলাই মাস থেকে। সেই মোতাবেক অর্থমন্ত্রী অরুণ জেঠলি ভারতের বাজেট ঘোষণা করেছেন গত সপ্তাহে। আমাদের দেশের সব কাগজে বিস্তারিত কিছু পাইনি, দুই একটি কাগজে যা দেখেছি তাতে আমি বেশ কিছুটা চমৎকৃতই হয়েছি। অরুন জেঠলি বাজেট ঘাটতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সাড়ে তিন শতাংশে সীমিত রাখবেন বলে উল্লেখ করেছেন যা ২০১৫-১৬ অর্থবছরে (এপ্রিল-মার্চ) ছিল তিন দশমিক ৭ শতাংশ। এই পরিমাণ বাজেট ঘাটতি রীতিমতো ঈর্ষণীয় বিষয়। আমাদের মতো দেশগুলোতে বাজেট ঘাটতি ৫-৬ শতাংশ থাকলেও তাকে বিপজ্জনক ধরা হয় না। মোট বাজেটের পরিমাণ দেখলাম ১৯ দশমিক ৮ ট্রিলিয়ন রুপী (এক ট্রিলিয়ন সমান এক হাজার বিলিয়ন)। এই আকারের বাজেটের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ২০২২ সালের মধ্যে অর্থাৎ আর মাত্র ছয় বছরের মধ্যে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করা। ‘জিডিপি’ (গ্রস ডমেস্টিক প্রোডাক্ট) প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে সাত থেকে পৌনে আট শতাংশ। বলা হয়েছে প্রবৃদ্ধির হার কিছুটা শ্লথ হতে পারে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ভারতের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৭ দশমিক ২ শতাংশ, আর চলতি অর্থবছরে তা হওয়ার কথা ৭ দশমিক ৬ শতাংশ। সেই তুলনায় ২০১৬-১৭ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধির হার ৮ শতাংশে উন্নীত হওয়ারই কথা ছিল। কিন্তু দুটো কারণে প্রবৃদ্ধির হার কিছু শ্লথ হবে বলে বাজেটে উল্লেখ করা হয়েছে। কারণ দুটো হচ্ছে: বড় ধরনের খরা এবং বিশ্ব বাজারের অব্যাহত মন্দা। এই দুই কারণের পরও যে প্রবৃদ্ধির হার ধরা হয়েছে তা এই অঞ্চলের জন্য সর্বোচ্চ হবে যেহেতু চীনের প্রবৃদ্ধির হার সাতের কাছাকাছি এখন। বাজেট এক নজর দেখে বোঝা যাচ্ছে মোদি সরকার আগামী দিনে গ্রামীণ অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগ দেবে এবং গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করবে। গ্রামীণ অর্থনীতি, স্বাস্থ্য, সামাজিক খাত, গ্রামীণ রাস্তাঘাট, রান্নার গ্যাস, নারী উদ্যোক্তার জন্য পুঁজি সরবরাহ, গ্রামে ইন্টারনেট সুবিধা বৃদ্ধি, শস্যবীমা এবং গ্রামীণ বিদ্যুত ইত্যাদি হচ্ছে বাজেটের অগ্রাধিকার। বলা হয়েছে সেচ প্রকল্পে খরচ হবে ৩৬ হাজার কোটি টাকা। প্রত্যেক বাসাবাড়ি যাতে গ্যাস পায় তার ব্যবস্থা করা হবে। প্রত্যেক বাড়িতে দুই বছরের মধ্যে বিদ্যুত যাবে। রাস্তাঘাট ও রেল এবং বন্দরের অবকাঠামো খাতে ব্যয় হবে ২ দশমিক ২১ ট্রিলিয়ন রুপী। সেচের আওতায় আসবে ৮০ দশমিক ৬ লাখ হেক্টর জমি। স্বচ্ছ ভারত প্রকল্পে বরাদ্দ ৯ হাজার কোটি রুপী। কৃষি খাতে ৩৫ হাজার ৯০০ কোটি রুপী বরাদ্দ। সংক্ষিপ্ত পাঠে মনেই হচ্ছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির এবারের বাজেট একটা বিপরীতধর্মী বাজেট। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি ধনীদের প্রধানমন্ত্রী। সেই অভিযোগ তিনি এবারের বাজেট দ্বারা খ-ন করেছেন। এটা বোঝা যায় ব্যবসায়ীদের প্রতিক্রিয়ায়। তারা এবার ততটা খুশি নন। স্টক এক্সচেঞ্জগুলোও একই বার্তা দিয়েছে। আমার ধারণা এটাই স্বাভাবিক। সকলের কথা গড়ে না বলে কৃষকদের আয় দ্বিগুণ করা হবে এই কথা বলা হলে ব্যবসায়ীরা খুশি হন কিভাবে? ব্যবসায়ীরা চান তাদের সুযোগ-সুবিধা। তারা বুঝতেই চান না যে কৃষকের আয় না বাড়লে, তাদের ক্রয়ক্ষমতা না বাড়লে শিল্পের পণ্য কে কিনবে? শত হোক বাংলাদেশ ও ভারতের মতো দেশের বিপুল সংখ্যক নাগরিক গ্রামে বাস করে। কৃষিতেই সিংহভাগ লোকের কর্মসংস্থান। এই কৃষক ও কৃষিকে বাঁচিয়ে না রাখলে কোন বাজেটই কাজে আসবে না। শত হোক উন্নয়নের জন্য দরকার বাজার, আর বাজার মানে হচ্ছে ক্রয়ক্ষমতা। সেই ক্রয়ক্ষমতায় বিরাট অবদান গ্রামের এবং কৃষকের। ভারতের ২০১৬-১৭ অর্থবছরের সর্বসাম্প্রতিক এই বাজেট থেকে আমরা কী শিক্ষা নিতে পারি? আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনেক দিন যাবত মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির ওপর সমধিক গুরুত্ব দিচ্ছেন। ২০০৮ সালের দিকে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ছিল মাত্র ৫৪৩ ডলার। বর্তমানে সেই আয় ১৩১৬ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ হবে মধ্যম আয়ের দেশ। অতএব আমাদের দ্রুতগতিতে মাথাপিছু আয় বাড়াতে হবে। এই বিষয়ের প্রতি গুরুত্ব দিয়ে তিনি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছেন অনেকদিন থেকেই। এই সেদিনও তিনি আয় বৃদ্ধির কথা বলেছেন। গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী দশটি ‘ইকোনমিক জোনের’ উদ্বোধন করেছেন। আগামী ১৫ বছরের মধ্যে মোট ‘ইকোনমিক জোন’ গড়ে তোলা হবে ১০০টি। বিশাল কর্মকা- বটে। এক শ’টির মধ্যে ১০টির উদ্বোধন করা হলো মাত্র। এই ‘ইকোনমিক জোনগুলো হচ্ছে তিন ভাবে : সরকারী উদ্যোগে, বেসরকারী উদ্যোগে, সরকারী ও বেসরকারী যৌথ উদ্যোগে। তিনি ‘অর্থনৈতিক জোন’ সৃষ্টির ক্ষেত্রে শুধু ‘জিডিপি’ ও বিনিয়োগের কথা ভাবছেন না দেখছি। তিনি সঙ্গে সঙ্গে আয় বৃদ্ধির কথা বলছেন, বলছেন পরিবেশ রক্ষার কথা, বলছেন নদী রক্ষার কথা। ইকোনমিক জোনের উদ্যোক্তাদের তিনি বলেছেন ‘জোন’ তৈরির পাশাপাশি জলাধার রক্ষা করতে হবে, গাছ-পালা ও বৃক্ষরাজি রক্ষা করতে হবে। ‘জোন’ তৈরির কারণে যাতে সাধারণ মানুষ বাস্তুচ্যুত না হয় তা দেখতে বলেছেন। ধানি জমি রক্ষা করতে হবে সর্বাগ্রে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা থাকতে হবে সকল কারখানাতে। উদ্বোধনকালের এসব বক্তব্য থেকে পরিষ্কার বোঝা যায় আগামী দিনের উন্নয়ন হবে পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন। উন্নয়ন করা হলো, নদীর দুই ধারে শিল্প-কারখানা করা হলোÑ দুই দিন পর দেখা গেল নদীর জল পান করা যায় না। জল পান তো দূরের কথা জলে হাত লাগানো যায় না অসুখ-বিসুখের ভয়ে। এখন দেখা যাচ্ছে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা ও বালু নদীর দুই পারে শিল্প-কারখানা আছে কিন্তু নদী আর নেই। শোনা যায় ঢাকার লোকদের পানীয় জলের ব্যবস্থা করতে হবে যমুনা নদী থেকে। বিলিয়ন বিলিয়ন টাকা খরচ আর কী? বলাবাহুল্য এই উন্নতি আর আমরা চাই না। উন্নতি চাই পরিবেশ রক্ষা করে, উন্নয়ন চাই ধানি জমি রক্ষা করে। অর সবচেয়ে বড় কথা সেই উন্নতিকে ধরে রাখার জন্য, টেকসই রাখার জন্য দরকার বাজার, বিশাল বাজার। আশার কথা বাংলাদেশের ১৬ কোটি লোকের মধ্যে প্রায় ৪ কোটিরই ক্রয়ক্ষমতা আছে যা অনেক ইউরোপীয় দেশেরই নেই। এই বাজার যথেষ্ট নয়। বাজার আরও বড় করতে হবে। এর বিকল্প হচ্ছে রফতানি বাজার। আমাদের দুটো শক্ত অবস্থান আছে। একটা হচ্ছে রফতানি আয়, আর অন্যটি হচ্ছে রেমিটেন্স আয়। বলাবাহুল্য দুটোই বিদেশী বাজার। রফতানি বাজার প্রধানত ইউরোপীয় বাজার এবং আমেরিকার বাজার। রেমিটেন্সের বাজার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য এবং ইউরোপীয় ও আমেরিকার বাজার। এখানে বলা দরকার এটা কাম্য পরিস্থিতি নয়। বিদেশের বাজারের ওপর নির্ভর করে কোন অর্থনৈতিক উন্নয়ন টেকসই উন্নয়ন হয় না। সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে চীনা অর্থনীতি। চীনা অর্থনীতির চালিকাশক্তি ছিল রফতানি। সস্তায় তারা সারা বিশ্বের বাজার দখল করেছে। কিন্তু এখন চলছে মন্দা। এই মন্দায় চীনা অর্থনীতি এখন দারুণ ক্ষতিগ্রস্ত। এক সময় রফতানি বাজার ছিল জাপানের হাতে, তারপর দক্ষিণ কোরিয়া। এরপর বাজার দখল করল চীন। ‘এক্সপোর্ট অর পেরিশই’ মনে হয় নীতি। কিন্তু এর একটা সীমা আছে। এ কথা এখন সকলেই বলছেন। রফতানি বাজার থাক এবং বাড়ুক, কিন্তু দেশীয় মানুষের বাজার, দেশীয় মানুষের ক্রয়ক্ষমতা লাগবেই। এখানেই ক্রয়ক্ষমতার প্রশ্ন, এখানেই মাথাপিছু আয় বৃদ্ধির প্রশ্ন, এখানেই কৃষকের আয় বৃদ্ধির প্রশ্ন। মানুষের আয় বাড়াতে হবে এই কথাটি বলা যত সহজ তা বাস্তবায়িত করা তত সহজ নয়। আয় বাড়ে, কিন্তু তা বাড়ে গড়ে। গড়ের আয় যেমন আয়, তেমনি সাধারণ মানুষের আয় বৃদ্ধির প্রশ্নও বড় প্রশ্ন। এই ক্ষেত্রে দুটো বিষয় বিবেচ্য। আয়-বৈষম্যে সাধারণ মানুষের আয় ছাইচাপা পড়ছে কি-না। দ্বিতীয়ত প্রকৃত অর্থেই মানুষের আয় বাড়ছে কি-না। স্বাধীনতার পর থেকে এই পর্যন্ত সময়ের মধ্যে গড় আয় বেড়েছে। কিন্তু জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে বেশি হারে। অতএব শুধু আয় বাড়লে চলবে না। আয় বাড়তে হবে ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে। ধরা যাক, একজন পলিশওয়ালার কথা। এখন এক জোড়া জুতা পলিশে লাগে ১৫-২০ টাকা। স্বাধীনতার প্রাক্কালে লাগত ৫০ পয়সা-এক টাকা। এই অর্থে তার আয় বেড়েছে ৩০ গুণ। কিন্তু তার ব্যয় বেড়েছে কতগুণ? একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক চাকরির শুরুতে কত পেতেন, এখন কত পান? এভাবে বিভিন্ন পেশা ও জীবিকার লোকদের হিসাব করলে দেখা যাবে আয়ের চেয়ে ব্যয় বেড়েছে বেশি। অতএব শুধু আয় বাড়লেই চলবে না। প্রকৃত আয় বাড়াতে হবে। আয়ের বৃদ্ধির হার এবং ব্যয়ের বৃদ্ধির হারের সঙ্গে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। এই কথাটা বাংলাদেশ, ভারতসহ সকল দেশকেই মনে রাখতে হবে। শত হোক বাজার অর্থনীতির মূল শক্তি ক্রয়ক্ষমতা, আয় বৃদ্ধি, প্রকৃত আয় বৃদ্ধি। লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট ও সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×