ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

দিলরুবা আহমেদ

ধাপে ধাপে ধাবমান, হে প্রবাসী

প্রকাশিত: ০৩:৫৬, ৪ মার্চ ২০১৬

ধাপে ধাপে ধাবমান, হে প্রবাসী

হাসপাতালে পৌঁছাতেই প্রায় ১টা। লম্বা লাইনের পেছনে। কখন যে ডাক আসবে কে জানে। হসপিটালটা এত সুন্দর যে শুমাই-ই বলল মাম আমি বড় হয়ে এখানে চাকরি করব, কাজরী হাসে, সবে ২০০১ , এই মেয়ে বড় হতে হতে ২০২০, ততদিনে কত কিছুই না বদলে যাবে!! ক্যানবেরাতেও কাজরী দেখেছিল খুব সুন্দর সুন্দর হসপিটাল। একবার ক্যানবেরাতেই এক বাচ্চা স্কুলে ব্যথা পায়। তার লোকাল গার্জিয়ান ছিলেন জাফর ভাই। বাবা-মাকে না পেয়ে স্কুল থেকে ওনাকেই ফোন করা হয়। জাফর ভাই হন্য হয়ে বাবা-মাকে খুঁজলেন। শেষে না পেয়ে কাজরী আর ওলিদকে খবর দিল। বাচ্চার পাশে কাউকে থাকতে হবে। পৌঁছে দেখল বাচ্চাটার ঞৎবধঃসবহঃ শুরু হয়ে শেষও হয়ে গেছে। বাচ্চা ভাল আছে। সবই জাফর ভাই করে ফেলেছেন। এখন কাউকে দরকার জেগে থাকা বাচ্চার সঙ্গে কিছুটা কথা বলার জন্য। বাঙালি সমাজে মোটামুটি খবর হয়ে গেছে। সবাই খুঁজতে বের হয়েছে। খুব দ্রুতই বাবা-মাকে আবিষ্কার করা গেল। সেবারই প্রথম কাজরী বিদেশ-বিভুইয়ে এক অপরূপ ভালবাসার ছোঁয়া দেখল। দারুণ একটা হাসপাতালও দেখল। বাচ্চাদের হাসপাতাল। অতএব পুরো হাসপাতালটাই খেলনা, মিকিমাউস, টেডি বিয়ার, পেইন্টিংয়ে ঠাসা। এ্যান্ডু গিভসের অসাধারণ সব ফটোগ্রাফি দেয়ালে দেয়ালে শোভা পাচ্ছিল। নিউজিল্যান্ডের এই ভদ্রমহিলা শুধু নাকি বাচ্চাদের ছবিই তোলেন। ছবিগুলো কাজরী আগেও দেখেছে। বাবার বিশাল হাতের ওপর শুধু নবজাতক পরম নিশ্চিন্তে শুয়ে আছে কিংবা বাবার একটা আঙ্গুুল ধরে আছে শিশু অথবা ফুলের টবে বিভিন্ন সাজে বাচ্চারা ফুটে আছে। অসাধারণ সব কল্পনা। বড় বড় কয়েকটা চড়ংঃবৎ আছে দেয়ালেÑ লেখা হাতে ঔড়ন ভধরৎ! লড়ন ভধরৎ-এ গেলে মনে হয় লড়ন পাওয়া যাবে। এসেছে সবে এই দেশে, তাড়াতাড়ি চাকরি জোগাড় করতে হবে। একটা রিহফড়-িএর ওপর লেখা ওৎারহম পধৎব- আরভিংয়ের যতœ! বেশ কয়েক মহিলা লাইন দিয়ে ফর্ম নিচ্ছে। কি পধৎব ঢ়ৎড়ারফব করে জানা দরকার। এই এলাকার নাম আরভিং। পাশে এসে একজন ফর্ম হাতে বসল। কাজরী জানতে চাইল, : এসকিউজ মি, আরভিং কেয়ার ব্যাপারটা কি? কাজরীর কথা শুনে গোলাপি রঙের চিতি চিতি কালো দাগের মোটাসোটা মেয়েটা মুখ তুলে তাকাল, হয়ত বুঝল কাজরী এ দেশের নতুন আগন্তুক। তিনটি আঙ্গুুল তুলে বলল, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এই তিনটি যারা বধৎহ করতে পারে না, তাদের সেই ব্যাপারে যবষঢ় করে। : এড়ড়ফ, এ কারণে তোমাদের দেশে ইবমমবৎ নেই। মেয়েটি অত্যন্ত বিরক্ত চোখে কাজরীর দিকে তাকাল। কাজল গায়ে মাখল না। হাসপাতালে ঢোকার সময় দেখেছিল কিছু মেক্সিকান ছেলে ডেন্টাল ইন্স্যুরেন্সের কাগজ বিক্রি করছে। বিষয়টাকে লুক্রেটিভ করার জন্য ধরে ধরে ফ্রি টুথ ব্রাশ বিলাচ্ছে। বিভিন্ন আকৃতির। ওরা এলো, গেল, দিল না ওদের। কাজরী ওলিদকে জিজ্ঞেস করেছিল, : আমাদের দিল না যে! : বুঝেছে, এশিয়ান, বেগার জাতি, শুধু দেখবে, ইন্স্যুরেন্স কিনবে না, তাই। ওলিদ ফাজলামোর ভঙ্গিতে বলল, কিন্তু কাজরীর মন খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটার ওপর কি সেই ঝালই ঝাড়ল! ভাবতেই কাজরীর আরও মন খারাপ হয়ে গেল। এত দুস্থ অবস্থায় থাকা একজনের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার কি মানে! আন্তরিক ভঙ্গিতে মেয়েটিকে এবার কাজরী জিজ্ঞেস করল, : তোমার নাম কি? মেয়েটি বেশ অবাক হয়ে চেয়ে দেখল কাজরীকে। মেয়েটার ঠিক দুই চোখের মাঝখানে একটা তিল আছে। যেন টিপ পড়েছে। মুখ ভর্তি ছোপ ছোপ কালো দাগের জন্য টিপটা চোখেও পড়ে না। সেদিন উইনগ্রিন এ্যাপার্টমেন্টের কোন এক ভাবি যেন তার বাচ্চাকে শাসাচ্ছিলেন এই বলে যে, স্কুলে গিয়ে টিফিনে চড়ৎশ খেলে মুখে কালো কালো দাগ পড়ে যাবে। সাবধান। কাজরীর হাসি পেয়ে গেল। : আমার নাম কাজরী আহমেদ। : আমি এলেন। : তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। : আমিও। : আরভিং কেয়ার লড়ন ঢ়ৎড়ারফব করে না কেন? : তাহলে ওদের অফিসই উঠে যাবে, ওরা দরিদ্র পাবে কোথায় যবষঢ় করার জন্য। এলেন হি হি করে হাসতে লাগল। মেয়েটির সব দাঁতেই ফাঁক দেখা যাচ্ছে। আমেরিকার মতোন উন্নত দেশেও এত দরিদ্র মানুষ আছে? আশ্চর্য ! কথা আর এগুলো না, ওলিদ ফিরে এসেছে শুমাইকে নিয়ে। জানতে চাইল, : কত নম্বর ডেকেছে? কাজল বলল, : ২৫। : মাত্র ! আমাদের নম্বর তো ৬৯। : ইয়াহ। : যাও, তুমি তাহলে শুমাইকে নিয়ে ঠাকুরমার ঝুলি শুনে আস। ংঃড়ৎু ঃরসব শুরু হচ্ছে এখনই। এদেশে বাচ্চাদের হাসপাতালের ভেতরও কত কাণ্ড করে রেখেছে। লাইব্রেরি রুমটা আরও বেশি যেন ঠাণ্ডা। বাচ্চাদের জন্য অনেকগুলো আলাদা করে কম্পিউটারও দেয়া আছে। একজন সাদা আমেরিকান মহিলা মোডা জাতীয় জিনিসে বসে গল্প বলা শুরু করেছে। সামনে কার্পেটে বসে আছে অনেক ছেলেমেয়ে। ক্যাসেটে গল্পটা আগেই রেকর্ড করা আছে। বাজছে। মহিলাটি শুধু বাঁ হাতে খোলা বইটা ধরে পাতাগুলো উল্টে যাচ্ছে। বাচ্চাগুলো গল্প শুনছে আর হাসছে। খিলখিল হাসির শব্দ হচ্ছে। আনন্দময় ভুবন তৈরি হয়েছে এখানে। কাজরী একসময় লক্ষ্য করল শুমাইও ওদের সঙ্গে সঙ্গে তাল মিলিয়ে হাসছে, শুনছে, গাইছে। সে ওদের ধারা ধরতে পারছে। শিশুরা বড় সহজে গড়িয়ে যেতে পারে যেভাবে গড়িয়ে যাওয়া দরকার। এদের ধারণ ক্ষমতা অভাবনীয়। শুমাইও পারবে ইনশাল্লাহ। ** : আচ্ছা, আজকে তুমি এটা কি করলে? : কি করলাম? : এ রকম ভেউ ভেউ করে কেউ কাঁদে? : কান্না পেলে কি করব। : তাও তো কথা। ওলিদ একপাশ ফিরে শোয়। শুমাইকে বুকে নিয়ে কাজরী শুয়ে আছে। শুমাইকে আজ ছয়টা ইনজেকশন দেয়া হয়েছে। এক দিনেই একসঙ্গেই। কাজরী শুমাইকে ইনজেকশন দেয়ার সময় কোলে নিয়ে বসেছিল। ওর হাত চেপে ধরেছিল। কাজরী শুমাইকে আগেই বলে রেখেছিল ইনজাকশন দেয়া হবে। ভয় নেই। মার কোলে থাকবে সে। সে তো মায়ের ব্রেভ গার্ল। শুমাই ব্রেভ গার্লের মতন মার কোলে বসেছিল চুপ করে। কাজরী শুমাইয়ের মুখটা হাত দিয়ে আড়াল করে গল্প বলতে শুরু করল। এক দেশে ছিল এক রাজা, আরেক দেশী ছিল এক রানী। রাজা একদিন ভাবল সে রানীর দেশে যাবে। : ওরা কি একজন বাংলাদেশে, আরেকজন আমেরিকাতে ছিল মা? : হ্যাঁ, তাই। তারপর একদিনÑ শুমাই তীক্ষè স্বরে কেঁদে উঠল। প্রথম ইনজেকশনটা ফোটানো হয়েছে বাঁ হাতে। : একদিন রাজা ভাবল শিকারে যাবে, না না রানীর কাছে যাবে। শুমাই চিৎকার করে কাঁদছে। : একদিন রাজা ভাবল, রাজা ভাবল... কাজরী আর গল্পটা মেলাতে পারছে না। কথাগুলো এলোমেলো হয়ে যেতে লাগল। তার চোখের সামনে শুমুইকে সুই ফোটানো হচ্ছে, এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়Ñ পর পর ছয়টা। এ হাতে তিনটা ওই হাতে তিনটা। কাজল আরও জোরে চেপে ধরল শুমুনকে। : আহ্ তুমি এ রকম করছ কেন? কাজরীর খেয়াল হলো সে নিজেই কাঁদছে। সে যে কাঁদছে এতক্ষণ ব্যাপারটা বুঝল না কেন সে! সবাই চেয়ে আছে তার দিকে। লজ্জা লাগছে অথচ চোখের পানি বন্ধ হচ্ছে না। যে নার্সটা সুই ফোটাল সে কি ভাবল কে জানে। হয়ত ভাবছে ইমোশনাল এশিয়ান! এখন জানতে চাইল। : নার্সটা কি কিছু বলেছে? : নাহ্, কি বলবে। ওরা জানে এশিয়ান মায়েরা এ রকম হয়। : হ্যাঁ জানে! তার নিজের বাচ্চাকে একসঙ্গে ছয়টা সুই ফোটালে বুঝত মজা। : সে নিজেই ছয়টা সুই হি হি করে হাসতে হাসতে ফুটিয়ে দিত। : খুব যে খুশি মনে হচ্ছে আজকে। : হব না, ওহ ধ ফধু দেখ কতগুলো কাজ হয়েছে। দেশে এটা সম্ভব ছিল? কাজরী কোন জবাব দিল না। কথাটা ঠিক। তার পরও সব সত্যি স্বীকার করতে ইচ্ছে করে না। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ওরা গেল স্কুলে। স্কুলের যাবতীয় সারঞ্জাম ‘ংঁঢ়ঢ়ষু ইড়ী’ কিনল। কাগজপত্র জমা দিল। শুমার হাতে ছয়টা ব্যান্ডেজ দেখে অনেক টিচার এগিয়ে এলো, ওকে আদর করল, সাহসী বালিকা খেতাব পেল। অনেক কিছুই হলো আজ। প্রতিটি দিনই যাচ্ছে প্রচুর কাজে কাজে, ব্যস্ততায় এবং ব্যবস্থাপনায়। শুমাইকে ক্লাসরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে কাজরী আর ওলিদ বাইরে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকল। শুমাইর জীবনে প্রথম স্কুল। কাজরীর মনে হয়, ওলিদ তার চেয়েও বেশি টেনশন করছে। কিন্তু কাজলের হাতেই শুমা গড়া। সে জানে শুমা খুব ভাল থাকবে। শুমাইর ভেতর ইন্সট্রাকশন ফলো করার একটা ব্যাপার আছে। ওকে যেভাবে বলা হয়, ও সেভাবেই গড়িয়ে যায়। ও জেনেছে এখন থেকে স্কুলে যেতে হবে, ও যাবে এবং কাজরীকে সেখানে সে খুঁজবে না। এমনিতে মাকে ছাড়া এক কদমও সে যেতে পারে না কিন্তু এখন যেতে হবে এটা সে জানে। : তুমি কি একবার উঁকি মেরে দেখবে শুমাই কি করছে। : ঘড় ঘববফ গৎ. বাসায় চল। : আচ্ছা আরেকটু অপেক্ষা কর। মহাউদ্বিগ্ন ওলিদ মেয়েকে ছেড়ে যেতে চাইছে না। ক্লাসরুমের বাইরে করিডরে প্যাসেজে সবকিছু খুটিয়ে দেখছে সে। ক্লাসরুমের দরজার ওপর বিশাল একটা টেডি বিয়ার বসানো। ক্লাসরুমটার নম্বর ১৭, ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও ১৭ জন। কাকতালীয়ভাবে ব্যাপারটা মিলে গেছে। প্যাসেজের ওপরই একটা বাবলার। ফোয়ারার মতন। চাপ দিলে উপরের দিকে পানি বের হচ্ছে। মুখে সরাসরি পানি ঢুকে যাবে। অস্ট্রেলিয়াতে প্রথম তারা এ জিনিস দেখেছিল। শুমাই তখনও বাবলার দেখলেই পানির তৃষ্ণায় ছটফট করত। এখন ওর দারুণ মজা হবে। সারাদিনই কি সে শুধু এখন পানিই খাবে! ওলিদ বলল, : দেখেছ, আমার গো গো-টার কি সৌভাগ্য। কি রকম সুন্দর স্কুলে। ইংলিশ মুভিতে এ রকম দেখা যেত। : ঢাকার স্কুলগুলোও এখন অনেক সুন্দর। আমাদের যুগের লম্বা বেঞ্চ টুল অনেক জায়গাতেই উঠে গেছে। এদের মতনই মিকি, ছবি, খেলনা দিয়ে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলো সাজানো। : ওখানে বেতনও তো তেমন। : ইয়াহ ভয়াবহ, তার ওপর ‘মিস্টার ডোনেশন’ তো আছেই। : তার পরও ঢাকার স্কুলে প্রশংসা করছ। : নিজের দেশ বলে কথা। কাজরী হাসতে থাকে। ওলিদও হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে হাসল। শুমাইয়ের ক্লাস চিটার মিস বিল এগিয়ে এসে ক্লাসরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিল। তার আগে ওদের দিকে চেয়ে একবার হাসল। আমেরিকান এই স্মার্ট মহিলা কি ওদের দেখে একটু অবাক হলো! এতক্ষণ এরা কি করছে! যাচ্ছে না কেন? ওলিদ বলল, : চল, এবার বের হওয়া যাক। এশিয়ান পেরেন্টসদের আবেগ দেখে এরা আবার বিরক্ত হবে। : চালিয়েজি। মাল্টিকালচারাল এ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের ফসল। সব ভাষা মিলিয়ে ইদানীং খিচুড়ি বানিয়ে কথা বলে সেখানে সবাই। কাজরী ও তাই করল, চালিয়েজি। : এবার কোথায়। ওলিদ জানতে চায়। : শপিংমলে চল। চাকরি খুঁজব। : দুটো বড় ফাঁড়া গেল সপ্তাহেই। ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়া আর শুমার স্কুল। এবার চাকরি। : ই-য়া-প-স্। পেয়ে যাবে ইনশাল্লাহ। আরভিং শপিংমলে এই প্রথম আসা। বাসার কাছেই কিন্তু মলে আসার সময় হয়ে ওঠেনি। কাজল অস্ট্রেলিয়াতে প্রচুর শপিংমল দেখেছে তাই এই মল দেখে ভিরমি খেয়ে পড়েনি। ঢাকার ইস্টার্ন প্লাজাও খুব সুন্দর। কাজলের গাউসিয়া মার্কেটও পছন্দ ছিল। সস্তায় অনেক জিনিস পাওয়া যায় সেখানে। এখানে ১০ ডলার খরচ করতে যত সহজ লাগে ঢাকায় ৫০০ টাকা খরচ করা তত সহজ না। কষ্ট হয়। বেশ বড় এ্যামাউন্টই মনে হয়। এখন অফিস আওয়ার। কাজের সময়। সবাই এদেশে কাজ করে কিছু না কিছু। অতএব মল বেশ ফাঁকা। মলের ভেতরে বিশাল বিশাল দুটো গাড়ি সাজানো। লটারিতে কেউ গাড়ি দুটো পাবে এ আশায় গাড়ি দুটো দিন গুনছে। এই গাড়ি দুটোকে মলের ভেতরে ঢোকালো কিভাবে সেটাও একদিন জিজ্ঞেস করতে হবে, ভাবতেই ভাবতেই কাজরী ঋড়ষষবুং দোকানটার সামনে এসে দাঁড়ালো। : দেখ, ‘ঘড়ি ঐরৎরহম’ লেখা বোর্ড ঝুলছে। : যাও তুমি, অঢ়ঢ়ষরপধঃরড়হ ফর্ম নিয়ে এসো। আমি বসলাম। বলে ওলিদ সিমেন্ট-পাথরে বাঁধানো চেয়ারে বসল। কাজরী দোকানে ঢুকল। এ্যাপলিকেশন ফর্মের জন্য কাস্টমার সার্ভিসে যেতে হবে। খুঁজছে সে। ভাগে ভাগে আলাদা করে সাজানো কসমেটিকস্ জুয়েলারি, ড্রেস বড়দের, ছোটদের জুতা, ইলেকট্রনিক্স, বাথরুম আইটেম, হাউজ হোল্ড আইটেম ইত্যাদি। মোটামুটি বলা যায় এখানে ইস্টার্ন প্লাজার একটা ফ্লোর জুড়ে একটা দোকান। নিচের দিকে এক্সেলেটর যাচ্ছে দেখে কাজল বুঝল দোকানটা দোতলা। দুই ফ্লোর জুড়ে। একজন বলল কাস্টমার সার্ভিস নিচে। সে নিচে নামল। নিচের তলাতে টিভি, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন সবকিছুই থরে থরে সাজানো। পাওয়া গেল কাস্টমার সার্ভিস, পাশেই রেস্টরুম বা টয়লেট। প্রতিটা দোকানের ভেতরেও আবার আলাদা করে ছেলেমেয়ে ও ডিসএবেলদের টয়লেট আছে। চাকরি খুঁজতে এসেছে কাজরী তাই মুখ সুন্দর করে ধুয়ে লিপস্টিক পাউডার লাগিয়ে নিল। আয়নার দিকে চেয়ে নিজেই নিজেকে একটা হাসি দিল। বলল, চল কাজরী, অনেক বছর পর আবার তোমার চাকরি খোঁজার পালা শুরু। ঢাকায় ফেলে আসা সরকারী চাকরিটার কথা মনে পড়ে। এসেই তো আর হাই প্রফাইলের কিছু পাওয়া যাবে না। একটা কিছু আগে শুরু করতে হবে। ওলিদের পড়া শেষ হয়ে গেলে সেও আবার পড়তে বসবে না হয়। আব্বু ঠিকই বলতেন, লেখাপড়ার কোন বিকল্প নেই। ওকে দেখে ওলিদ জানতে চাইল : ফর্ম এনেছ? : ুবং. : কিছু জিজ্ঞেস করেছে? : না, চাওয়া মাত্রই ফর্ম দিল। ফর্ম দিতে কোন কার্পণ্য নেই। : আমার জন্য আননি? : না, এখানে সব সেকশনেই দেখলাম মেয়েরা কাজ করছে। মুখে বলল কথাটা কিন্তু কাজরী ইচ্ছে করেই আনেনি। সে চায় ওলি ভাল একটা চাকরি খুঁজে বের করুক। সে জানে ওলিও তাই চায়। : ঝঊঅজঝ এ আর উওখখঅজঝ এ যাব। : ঙশ. কিন্তু দুটো দোকান ও একদম দুই মেরুতে। : ঘড় চৎড়নষবস, একবার এদিকে হাঁটব, আরেকবার ওদিকে। : ঙশ. চালিয়েজি। দুজনই হেসে ওঠে। এক জীবনে খুশি হতে সুখী হতে খুব বেশি কিছু লাগে কি!!! দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে থাকে। কাজরীর খুব ভাল লাগে। মনে হয়, কী দরুনই না হতো সমুদ্রের পাড়ে চাঁদনী রাতে দুজনে খুব বাতাসের মধ্যে এ রকম পাশাপাশি হাঁটলে। বিয়ের পর যখন হানিমুনে কক্সবাজারে গিয়েছিল তখন বালুচরে দিনের আলোয় হেঁটেছিল। রাতে না। নিরাপত্তার অভাব। ওলিদ একটা গান শুনিয়েছিল তাকে, ‘আজ কোন কথা নয়,’ মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। আসলে সাত বছর আগের কথা। ওদের বিয়ে হয়েছে সাত বছর আগে। আশ্চর্য এত তাড়াতাড়ি সময় পার হয়ে গেল। সময় চলে গেছে, দুজনেই ছিল ব্যস্ত। সকাল বিকেল দুজনাই অফিসে ছুটেছে। মনে আছে কোন একটা বিয়েবার্ষিকীতে সকালে উঠে ওলিদ চলে গিয়েছিল বগুড়ায়, ট্রেনিং ছিল। ওলিদ ছুটি পাবে না, তাই কাজরীও ছুটির চেষ্টা না করে ভোরে টাঙ্গাইল চলে গিয়েছিল, অফিস ছিল টাঙ্গাইলে। দিনভর ক্লাস নিয়েছিল ছাত্রছাত্রীদের। প্রভাষিকার দায়িত্ব পালন করেছে নিষ্ঠার সঙ্গে। দুপুরে এক স্টাফ এসে বলল, : আপা, আজকে রাতে আপনি আমার বাসায় খাইবেন। এ সপ্তাহটা পুরোটাই তাকে থাকতে হবে। লাগাতার ক্লাস আছে। হোস্টেলেই থাকে সে। খায়ও সেখানে। : রাজ্জাক সাহেব, আপনি অযথা এত কষ্ট করবেন কেন। : আপা, আমরা গরিব মানুষ। আপনাদের মতন কেউ একজন বাসায় আসলেও আমাদের সম্মান বাড়ে। কাজরী জানে, সে যে প্রভাষিকা, তার চেয়েও এখানে সে অধিক আদৃত সচিব-পুত্রবধূ হিসেবে। এটাই বাংলাদেশ। : আমার পতœীর খুব ইচ্ছে, আপনাকে একবার দেখার। কাজরী একবার ভাবল জিজ্ঞেস করে, একজন প্রভাষিকা কেমন তা দেখতে চায়, নাকি সচিব পরিবারের বধূ কেমন হয় তা জানতে চায়। জিজ্ঞেস করা হয় না। সব কথা জিজ্ঞেস করতে হয় না। টাঙ্গাইলে প্রথম কিছুদিন সর্বত্র তাকে পরিচিত করানো হতো অমুক সচিবের পুত্রবধূ, তার ডেজিগনেশনটা কি সেটা বলতে যেন সবাই ভুলে যেত। শেষে কাজরীই মুখ ফুটে সরাসরি নিষেধ করল, : আমি আমার পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই। শ্বশুরের না। সেই ছিল এক কাজেকর্মে ভরা দিন। সারাদিন আত্মীয়স্বজনরা সবাই ফোন করেছে মেরেজ ডের অভিনন্দন জানাতে। কেউ কেউ এলো ফুল হাতে। তারপর অবাক হয়েছে। এমন দিনে দুজনই হাওয়া। একজন বগুড়া আরেকজন টাঙ্গাইলে । জীবন কত রকমেরই না হয়! রাজ্জাক ভাইয়ের বাসায় সে রাতে পোলাউ-কোরমা খেতে খেতে কাজরীর চোখ গিয়েছিল ভরে। পরে ওলিদ বলেছিল ওই রাতে পুরো দলকে মুড়ি আর নারিকেল খেয়ে রাত কাটাতে হয়েছে। বগুড়ার রেস্ট হাউসের বাবুর্চি অজানা কোন এক কারণে নিখোঁজ ছিল। পরেও তার আর হদিস পাওয়া যায়নি। আমেরিকায় আসার পর থেকেই আষ্টেপৃষ্ঠে লেপ্টে আছে দুজন দুজনার সঙ্গে। এখানে কেউ নেই। বাবা নেই, মা নেই। চারদিকে বাংলা কথা নেই। অথৈই জল। ভীরু পদযাত্রা। কাজরী নিজের বুকের ধুঁক ধুঁক শব্দ নিজেই শুনতে পায়। ওলিদের হাত ধরে থাকে শক্ত করে। ওলিদের হাত ধরেই হাঁটতে থাকে। এখানে কেউ নেই আপন তার পরও একজন আছে, এই একজনই কোটি জনের সমান। এই একজন থাকলেই সব থাকা হয়।
×