ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বাগান কেনাবেচায় মন্দা

চাঁপাইয়ের আম বাগানে মুকুলের ঢল

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ৪ মার্চ ২০১৬

চাঁপাইয়ের আম বাগানে মুকুলের ঢল

ডিএম তালেবুন নবী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ॥ ‘ওমা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে’ কবিগুরুর এই পঙক্তির যথাযথ বাস্তব রূপ এখন চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের পথেঘাটে বিরাজ করছে। বোলের ভারে নুয়ে পড়েছে বাগানের সব গাছ। কবিগুরুর পুরো কবিতার খ-িত অংশ যা দেশেপ্রেমের অনুষঙ্গ হিসেবে নিয়ে ও প্রতিবেদনের যাত্রা শুরু হলেও বর্তমানে কবিতার পুরোটাই রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত। যার মধ্যেই লুকিয়ে আছে মেঘনা, যমুনা, পদ্মার সঙ্গে মিলেমিশে বাঙালীর ঠিকানা ঠেকেছে এই আম্র কাননে। যদিও এই মুহূর্তে প্রসঙ্গ একেবারে ভিন্ন কিন্তু আমের প্রতিটি গাছের বোলের যে ঘ্রাণের আমেজ তাতেই মনে করিয়ে দিয়েছে কবিগুরুসহ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত এই বাংলার মূল সুর জাতীয় সঙ্গীতকে। পুরো জেলা এখন এই মুহূর্তে বিশাল আম বোলের সামিয়ানার নিচে। এই আমের বোলের গন্ধে এক অদ্ভুত অনুভূতি রয়েছে। ডালে ডালে ডগায় ফুটে থাকা মনোরম দৃশ্য যে কোন মানুষকে কাব্যিক অনূভূতির ঠিকানায় পৌঁছে দেবে। প্রকৃতির এ এক চমক ধরা সৃষ্টি। যদিও আবহাওয়ায় এবার ভিন্ন মাত্রা যোগ হবার কারণে ও আগাম তাপমাত্রা বাড়ার কারণে এখন পর্যন্ত (২৯ ফেব্রুয়ারি) বয়সভিত্তিক আম গাছে মুকুল বা বোল ফুটেছে ৮৮% ভাগ। সংশ্লিষ্ট বিভাগ সূত্র নিশ্চিত করেছে ১-০৬ বছর বয়সের প্রায় ৪ লাখ, ৭ থেকে ২০ বছর বয়সের ৩ লাখ ৮০ হাজার ৮০৯টি গাছ, ২১ থেকে ৫০ বছরের ৬ লাখ গাছে এবং ৫১ থেকে শত বছর বা তারও বেশি গাছের পরিমাণ প্রায় সাড়ে ৬ লাখের কাছাকাছি। গাছের প্রায় প্রতিটিতে মুকুল এসেছে। এমনকি গত বছর আম হওয়া গাছেও এবার মুকুল দৃশ্যমান। সব মিলিয়ে জেলার প্রায় ২৫ হাজার হেক্টর আম বাগানের ২২ লাখ গাছের পুরোটাই মুকুলে ছেয়ে গেছে। যে ১২ ভাগ মুকুল আসেনি তা এখন শুধু সময়ের ব্যাপার। মার্চের ১৫ তারিখ বা তার আগেই মুকুল এসে পড়বে। তবে এবার ৯টি উন্নত জাতের মধ্যে খিরসাপাতি, ল্যাংড়া, বোম্বাই, গোপালভোগ, আম্রপালি, ফজলি ও ল্যাড়া জাতের গাছে মুকুলের সংখ্যা বেশি। তবে আবহাওয়ার বৈরী আচরণে আশ্বিনা আমের বোল অন্যান্য বছরের তুলনায় অনেক কম। এই জাতের গাছের সংখ্যা প্রায় ৫ লাখ ৩৯ হাজার ৭৫৮টি। তবে গুঁটিজাতের এবার ডালপালা ভেঙ্গে মুকুল এসেছে। তাই পুরো চাঁপাইনবাবগঞ্জজুড়ে প্রকৃতির সৃষ্ট চমকের সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে এবার আমের বামপার ফলনের। প্রকৃতিগত দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারলে উৎপাদন কত হাজার কোটিতে গিয়ে ঠেকবে সে হিসাব করেনি এখনও সংশ্লিষ্ট বিভাগ। কৃষিবিজ্ঞানী ও আবহাওয়াবিদরা জানিয়ে দিয়েছে ২০১৬ সাল আম উৎপাদনের রেকর্ড ভঙ্গের বছর। যদিও এ বছর ম্যাংগো ইয়ার বা আমের বছর না হবার পরও সরকারী তত্ত্বাবধান, আমচাষীদের কঠোর পরিশ্রম, পরিচর্যায় ও আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় প্রতিটি জাতীয় বৃক্ষ আম গাছ জানান দিচ্ছে এবার নিজেকে উজাড় করে দেবার। এ থেকে সবার ধারণা, ইতোমধ্যেই পোক্ত হয়েছে যে রেকর্ড পরিমাণ উৎপাদিত আমে এ অঞ্চল তথা সমগ্র দেশের অর্থনীতির চাকা দ্বিগুণভাবে সচল হয়ে সব কিছুকে চাঙ্গা করে তুলবে। গত দুই বছর ধরে আমের উৎপাদন অনেকটাই স্বাভাবিক থাকলেও বাজারজাতকরণের পূর্ব মুহূর্তে বড় ধরনের ধাক্কা লেগেছিল অনভিজ্ঞ আমলাদের অশুভ সিদ্ধান্ত ও অপরিপক্ব দূরদর্শিতার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয় আম চাষীরা। বিশেষ করে ফরমালিন আতঙ্ক নিয়ে এই সঙ্কটের সৃষ্টি। আর এই আতঙ্কের কারণে পরিবহন সঙ্কট মারাত্মক আকার ধারণ করে। ব্যবসায়ীরা আম নিয়ে নানানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবার কারণে বর্তমান বছরে আম বাগান কেনাবেচাতে আগ্রহ হারিয়েছে স্থানীয় ও অস্থানীয় আম ব্যবসায়ী, পাইকার ও আড়ৎদাররা। বিগত দুই বছরের মৌসুমকালীন এই অবস্থা বিরাজ করায় সৃষ্ট সঙ্কটে বহু আম ব্যবসায়ী পুঁজি হারিয়েছে। দুটি আম মৌসুম তাদেরকে নিরাশ করেছে। এবারের মৌসুমে সরকার যদি এসব নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসার ব্যাপারে কৃষি বিজ্ঞানীদের সর্বক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে তবে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা সম্ভব আম পরিবহন ও বাজারজাতের বিষয়টিতে। আমের বছর না হবার কারণে অতীতের ধারণা পাল্টে এবার হঠাৎ গাছে গাছে মুকুল আসাতে নতুনভাবে প্রেরণা পেয়েছে আম ব্যবসায়ীরা। বিশেষ করে এবার আমের মৌসুমজুড়ে রমজান ধরতে পারার কারণে নিশ্চিত হয়েছে এবার আম নিয়ে বড় ধরনের লাভের মুখ দেখবে তারা। লক্ষ্য একটাই, গত দুই মৌসুমের গ্লানি আর লস বা ক্ষতি এবার পুষিয়ে নিতে সক্ষম হবে, সরকার সকল সঙ্কটে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞ ও কৃষি বিজ্ঞানীদের ব্যবহার করলে। এসব বিষয় মাথায় রেখে আগাম প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছে ফরমালিন মুক্ত রেখে আম বাজারজাত প্রক্রিয়া সচল রাখা। কারণ এবারের উৎপাদন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে। এমনকি প্রাকৃতিক দুর্যোগ যত বড় আকারের হোক না কেন আম উৎপাদনে কোন ব্যাঘাত সৃষ্টি করতে পারবে না। কারণ এই মুহূর্তে শত চেষ্টা করেও মুকুলবিহীন আম গাছ বের করতে ব্যর্থ হবেন। সাধারণ নিয়ম অনুসারে আমের বোল আসা ফাল্গুনের প্রথম সপ্তাহে শেষ হবার কথা। কিন্তু এবার শীতের পরিমাণ কম হবার কারণে চৈত্রের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত বোল ফুটতে থাকবে। তাছাড়া অনুকূল আবহাওয়া এবং ফাগুনের শুরুতে বৃষ্টিপাতের কারণে আমের ভাল ফলন পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন উদ্ভিদ সংরক্ষণ ও উদ্যান বিশেষজ্ঞরা। পাশাপাশি এই মুহূর্তে বাগান পরিচর্যা ও মুকুল তত্ত্বাবধানে প্রায় ২৪ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। গাছে গাছে ¯েপ্র ও সেচ কাজে এসব শ্রমিক খ-কালীন কাজ করছে। এবার বাগান পরিচর্যা ও ¯েপ্র করায় বিভিন্নজাতের কীটনাশক পাঁচ উপজেলায় মজুদ ছিল প্রায় ৭ কোটি টাকার কাছাকাছি। তবে বাগান পরিচর্যায় বা ¯েপ্র করার অভিজ্ঞ ও শিক্ষিত কোন বিশেষজ্ঞ পরামর্শ ছাড়াই কৃষকরা অতীত অভিজ্ঞতা থেকে তা ব্যবহার ও কাজে লাগাচ্ছে। এই সুযোগে এই ধরনের গাছ ও মুকুল পরিচর্যায় ভারতীয় চোরাকারবারিরা খুবই সজাগ দৃষ্টি রেখে এ দেশে ঠেলে দিচ্ছে নানান ধরনের উপকরণ, কীটনাশক, পাউডার ও বোতলজাত লিকুইড জার। এবার শুধু চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে আমের উৎপাদন ৭ লাখ মেট্রিক টন ছাড়িয়ে গেলেও আশ্চর্য হবার কিছু থাকবে না।
×