ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

মিয়ানমারে গণতন্ত্র

প্রকাশিত: ০৪:২৪, ৩ মার্চ ২০১৬

মিয়ানমারে গণতন্ত্র

মিয়ানমারে গণতন্ত্রের নতুন যুগের সূচনা হলেও ‘কাক্সিক্ষত গণতন্ত্র’ এখনও ধোঁয়াশায়। দেশটিতে গণতন্ত্র কখনই ভালভাবে প্রস্ফুটিত হতে পারেনি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই দেশটিতে গণতন্ত্রের সঙ্কট দীর্ঘদিনের। এদেশের ইতিহাসে রয়েছে সেনাশাসনের দীর্ঘ ও কৌশলগত রাজনৈতিক অবস্থান। অথচ মিয়ানমারেই জন্মগ্রহণ করেছেন গণতন্ত্রের মানসকন্যা নোবেল বিজয়ী রাজনীতিক আউং সান সু চি। নির্মম হলেও সত্য দেশটিকে বছরের পর বছর সেনাবাহিনী তাদের রাইফেলের নলের মুখে শাসন করেছে এবং আউং সান সু চির মতো গণতান্ত্রিক নেত্রীকে রাখা হয়েছিল গৃহবন্দী। অবশেষে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ফিরে যেতে অনুষ্ঠিত হয়েছে জাতীয় নির্বাচন এবং আউং সাং সু চির গৃহবন্দিত্বের অবসান হয়েছে। কিন্তু পূর্ণ গণতন্ত্র ফিরে আসবে কি-না তা এখনও ধোঁয়াশা। পঞ্চাশ বছরের বেশি সময় ধরে সামরিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট ছিল দেশটি। ২৫ বছর পরে গত নবেম্বরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনটি ছিল দেশটির ইতিহাসে প্রথম কোন গণতান্ত্রিক নির্বাচন। নির্বাচনে দেশের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী আউং সান সুচির দল এনএলডি ৮০ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। এর আগে ১৯৯০ সালের নির্বাচনেও সুচির দল নিরঙ্কুশ বিজয় পায়। সে নির্বাচনের পরই তা প্রত্যাখ্যান করে দেশটির সামরিক বাহিনী। অবশ্য এবারের নির্বাচন সামরিক বাহিনী মেনে নিয়েছে। কিন্তু ক্ষমতার হাল ছাড়েনি বরং অংশীদারিত্বকে উপভোগ করছে সামরিক কায়দায়। পার্লামেন্টের ১৬৬ আসন সেনাবাহিনীর জন্য সংরক্ষিত থাকায় সুচির পিছু ছাড়ছে না সামরিক বাহিনীর সদস্যরা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যায় সামরিক শাসনোত্তর গণতন্ত্রের পথচলা মোটেই মসৃণ হয় না। বিশ্বের সেনাশাসিত দেশসমূহের মধ্যে খুব অল্প সংখ্যক দেশই সেনাপ্রভাবমুক্ত গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করতে পেরেছে। লক্ষণীয় বিষয় হলো এসব সেনাশাসিত দেশসমূহের কোনটিতেই গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিত্ব সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত ছিল না। এসব দেশে সামরিক শাসন জারির সঙ্গে সঙ্গেই সংবিধান স্থগিতের প্রয়োজন হতো। ব্যতিক্রম কেবল মিয়ানমার। মিয়ানমারের শাসন ব্যবস্থায় সামরিক বাহিনীর প্রতিনিধিত্ব সংবিধান দ্বারা স্বীকৃত এবং সংবিধান সংশোধনের ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর অনুমোদনের প্রয়োজন হবে। এ কারণ গণতন্ত্রের উন্মেষ মিয়ানমারের নির্যাতিত ও অমানবিক বৈষম্যের শিকার সংখ্যালঘুু রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের জন্য এখনও কোন সুখবর নিয়ে আসতে পারেনি। সুচির সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ। দারিদ্র্য দেশটিকে আঁকড়ে রেখেছে আগে থেকেই। জনগণ যেহেতু গণতন্ত্রকামীদের ভোট দিয়েছে সে ক্ষেত্রে কিছু কিছু চ্যালেঞ্জ সম্ভাবনায় পরিণত হয়েছে। বিশ্ব যেহেতু গণতন্ত্রের পথে এগোচ্ছে সে ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক যুক্তিতর্কের জন্য পথ অনেকটাই সুগম এবং সে ক্ষেত্রে মিয়ানমারের চ্যালেঞ্জগুলো সম্ভাবনায় রূপ নেবে- এমনটাই স্বাভাবিক। তবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে গণতন্ত্রের পথে টিকে থেকে সেই সম্ভাবনাগুলোকে অর্জন করতে হয়। মিয়ানমারের বর্তমান অবস্থা সে ক্ষেত্রে যথেষ্ট শক্ত নয়। জনগণের প্রত্যাশা পূরণের জন্য গণতন্ত্রপন্থী ও গণতন্ত্রকামী চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী ব্যক্তিবর্গকে অবশ্যই সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলোকে বিবেচনায় নিতে হবে গুরুত্বসহকারে। একথা সত্য যে, সেনাবাহিনীর সমঝোতার ওপরই নির্ভর করবে মিয়ানমারের ‘গণতন্ত্র’। দায়িত্ব নেয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে এনএলডির গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে কয়েকটি মৌলিক চ্যালেঞ্জ তুলে ধরেছে। জাতিগত সংঘাত নিরসন করে দেশটির ঐক্য ও সমঝোতা প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা ছাড়াও সামরিক-বেসামরিক নেতৃবৃন্দের মধ্যকার দূরত্ব হ্রাস করার বিষয়টির ওপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাছাড়া দেশটির শাসনতান্ত্রিক ও সাংবিধানিক সংস্কারের ইস্যুটিকেও উদীয়মান গণতন্ত্রের পথে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন এপ্রিলে। দেশের প্রায় সোয়া পাঁচ কোটি মানুুষের প্রত্যাশার পাহাড়ও বড় হচ্ছে। দেশটির জনগণ চায় সামরিক শাসনের যাঁতাকলে স্থবির হয়ে যাওয়া অর্থনীতি পুনরুদ্ধার, জাতিগত সংঘাত সমাধানসহ শান্তি প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হবে।
×