ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মু. আব্দুল্লাহ আলআমিন

সিরিয়ার দুঃস্বপ্নের কালো রজনী শেষ হবে কি?

প্রকাশিত: ০৫:৩২, ২ মার্চ ২০১৬

সিরিয়ার দুঃস্বপ্নের কালো রজনী শেষ হবে কি?

অবশেষে সিরিয়ায় অস্ত্রবিরতি হয়েছে। যদিও এজন্য সিরিয়াবাসীবে কম মূল্য গুনতে হয়নি। সঙ্কটের শুরু ২০১১ সালের মার্চে, বাশার আল আসাদের পরিবারের চার দশকের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া গণআন্দোলনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ধীরে ধীরে এই আন্দোলন পুরোদস্তুর গৃহযুদ্ধের রূপ নেয়। এই যুদ্ধে এ পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি মানুষ নিহত এবং ১ কোটি ১০ লাখের বেশি লোক বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। যুদ্ধ কেবল সিরিয়ার ভূখ-ের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি। আঞ্চলিক ও বিদেশী পক্ষগুলো এতে জড়িয়ে যাওয়া পরিস্থিতি শুধু জটিলই করে তোলেনি যুদ্ধকে অনির্ধারিতকাল পর্যন্ত প্রলম্বিত করেছে। শেষ পর্যন্ত অস্ত্রবিরতির মতো একটি কঠিন বিষয়ে আপাতত একমত হয়েছে বিবদমান পক্ষগুলো। সিরিয়ায় সরকার ও বিদ্রোহী পক্ষগুলোর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ২৬ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতের পর থেকে অস্ত্রবিরতি কার্যকর হয়েছে। উভয় পক্ষের মধ্যে কথাবার্তায় মধ্যস্থতা করেছে রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্র। অস্ত্রবিরতির স্থায়িত্ব নিয়ে অবশ্য উভয় দেশই সন্দিহান। কারণ জঙ্গী গ্রুপ আইএস ও আল কায়েদা ঘনিষ্ঠ আননুসরা ফ্রন্টকে এর আওতা থেকে বাইরে রাখা হয়েছে। এমতাবস্থায় সিরিয়ার পরিস্থিতি কতটা স্থিতিশীল হবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না। এই গ্রুপগুলোর সদস্যরা বিদ্রোহীদের দখলে থাকা বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। এ কারণে শুধুমাত্র জঙ্গীদের টার্গেট করে হামলা করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ রুশ-মার্কিন অস্ত্রবিরতি উদ্যোগকে পুরোপুরি সমর্থন দিয়েছে। নিরাপত্তা পরিষদ সব পক্ষকে অস্ত্রবিরতির শর্তাবলী মেনে চলার আহ্বান জানিয়েছে। অস্ত্রবিরতি কার্যকর হওয়ার আগ পর্যন্ত রুশ বিমানগুলো সিরিয়ায় বিদ্রোহীদের অবস্থান টার্গেট করে আক্রমণ অব্যাহত রাখে। সিরিয়া বিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত স্তাফান দ্য মিসতুরা বলেছেন, অস্ত্রবিরতি অব্যাহত থাকলে ৭ মার্চ থেকে শান্তি আলোচনা আবার শুরু হবে। অস্ত্রবিরতির ভবিষ্যত নিয়ে সন্দেহ থাকলে পাঁচ বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাত অবসানে একে একটি বড় ঘটনা হিসেবেই দেখা হচ্ছে। এর জন্য সিরিয়ার জনগণকে সবচেয়ে বেশি মূল্য গুনতে হয়েছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনকে কম করে হলেও কিছু মূল্য দিতে হয়েছে, কিন্তু সিরিয়ার শাসক বাশার আল আসাদকে কোন মূল্যই দিতে হয়নি। ইউরোপীয় ও ইসরাইলী গোয়েন্দাদের মূল্যায়ন হলো, অস্ত্রবিরতি বাশার আল আসাদের জন্য আগামী অন্তত পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতা সুসংহত করার সুযোগ এনে দিয়েছে। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা দেশের বিভিন্ন অংশে সরকারী বাহিনী অবরোধ আরোপ করে রাখার ফলে মানবিক সহায়তা ঢুকতে পারছে না। অস্ত্র বিরতি ফলপ্রসূ হলে আসাদ বাহিনীর নিয়ন্ত্রণ আরও শক্তিশালী হবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি গত সপ্তাহে কংগ্রেসে শুনানিতে বলেছিলেন, সিরিয়ায় অস্ত্রবিরতি কার্যকরের সম্ভাবনা নিয়ে সংশয় রয়েছে। রুশ জঙ্গী বিমান সিরিয়ার আকাশে, মাটিতে ইরানী সৈন্যরা আসাদ বাহিনীর সঙ্গে মিলেমিশে লড়ছে। অন্যদিকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত বিদ্রোহী গ্রুপগুলো। এ অবস্থায় ঠিকমতো অস্ত্রবিরতি কার্যকর হবে এ রকম আশা করা কঠিন। তারপরও সিরিয়াকে রক্ষা করতে অস্ত্রবিরতি প্রয়োজন বলে তিনি মন্তব্য করেন। অস্ত্রবিরতি কার্যকরের আগে শেষ মুহূর্তের সুবিধা আদায় করে নিতে বিবদমান পক্ষগুলো লড়াই চালিয়ে যায়। রাজধানী দামেস্কের দারায়া শহরতলী এলাকায় ব্যাপক হারে ব্যারেল বোমাসহ অন্যান্য গোলাবারুদ নিক্ষিপ্ত হয়েছে। দারায়ার বিদ্রোহীরা বলেছে, তারা আননুসরা ঘনিষ্ঠ নয় কিন্তু আসাদ সরকার বলেছে, দারায়া যুদ্ধ বিরতি অঞ্চলের বাইরে। উল্লেখ্য, বিদ্রোহী গ্রুপগুলোর মধ্যে আইএস এবং আননুসরাই কেবল জাতিসংঘ তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী সংগঠনের মধ্যে পড়ে। এদিকে অস্ত্রবিরতি চুক্তিতে স্বাক্ষরকারী বিদ্রোহী যারা গ্রুপগুলো বলেছে, অস্ত্রবিরতি চলাকালে তাদের ওপর কোন আক্রমণ হলে তারা তার প্রতিশোধ নেবে। সে হামলা সরকারী বাহিনী, বিদেশী বাহিনী অথবা জঙ্গী গ্রুপ যেই করুক না কেন। ওবামা প্রশাসন ও সিরিয়ার বিদ্রোহীদের যে দাবি ছিল যে কোন রাজনৈতিক সমাধান হোক না কেন আসাদের ক্ষমতা ছাড়া তার অন্যতম পূর্বশর্ত হতে হবে। কিন্তু অস্ত্রবিরতি প্রক্রিয়া তাদের সে পূর্বশর্ত থেকে সরে আসতে বাধ্য করার পাশাপাশি আসাদকে ক্ষমতায় থেকে যাওয়ার সুযোগ এনে দিয়েছে। গৃহযুদ্ধ শুরুর আগে সিরিয়ার সরকারী বাহিনীর সৈন্যসংখ্যা ছিল ৩ লাখ। যুদ্ধে মৃত্যু, পক্ষত্যাগ ও দেশত্যাগের পর এ সংখ্যা এখন প্রায় অর্ধেক। হাতে দামেস্ক, হামা, হিমস ও আলেপ্পোর অধিকাংশ স্থানের নিয়ন্ত্রণ এখনও সরকারী বাহিনীর। ইরান ও রাশিয়া সক্রিয় সামরিক সহযোগিতায় ক্ষমতা এখনও কুক্ষিগত রাখতে পেরেছেন আসাদ। এই দুটি দেশ ছাড়াও লেবানন, ইরাক ও আফগানিস্তানের শিয়া মিলিশিয়া বাহিনীগুলো আসাদকে মদদ যুগিয়ে চলেছে। ওবামার মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সিনিয়র উপদেষ্টা ফিলিপ গর্ডন মনে করেন, অস্ত্রবিরতি টিকে যাওয়ার সম্ভাবনা যথেষ্ট ক্ষীণ। কারণ আসাদ ও বিদ্রোহী উভয় পক্ষেই চুক্তি বানচাল করার মতো লোকজন রয়েছে। অস্ত্রবিরতি নস্যাতের কোন সুযোগই তারা হাতছাড়া করবে না। রাশিয়া যে কেবল জঙ্গী অবস্থান লক্ষ্য রেখেই তাদের হামলা সীমিত রাখবে সেটিও তিনি মনে করেন না। গর্ডন বলেন, আসাদকে ক্ষমতায় রেখে অস্ত্রবিরতির কথা বিদ্রোহীরা গত পাঁচ বছরে চিন্তাও করতে পারেনি। এই দীর্ঘ সময়ে তারা আসাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে কোন সুবিধা করে উঠতে না পেরে শেষ পর্যন্ত অনিচ্ছা সত্ত্বেও এমন একটি সমঝোতায় আসতে বাধ্য হয়েছে। ওবামা প্রশাসনও এতে সায় দিয়েছে। যদিও ওবামা ব্যক্তিগতভাবে এখনও মনে করেন আসাদের ক্ষমতা থেকে সরে যাওয়া উচিত। বৃহস্পতিবার পররাষ্ট্র দফতরে ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠকে তিনি বলেছেন, সিরিয়ার ভবিষ্যত রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় আসাদ থাকতে পারবেন না। ওবামা বলেন, ‘বছরের পর বছর ধরে আসাদ নিজ জনগণের বিরুদ্ধে বর্বোরচিত যুদ্ধ চালিয়ে গেছেন। যুদ্ধে তিনি ব্যারেল বোমা ব্যবহার করেছেন, মানুষকে অবরুদ্ধ করে রেখেছেন, ক্ষুধার্ত অবস্থায় রেখেছেন। বন্দীদের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছেন। বিদায় না হওয়া পর্যন্ত সিরীয় জনতার একটি অংশ আসাদের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাবে।’ যা চেয়েছিল ওবামা প্রশাসন অস্ত্রবিরতি তাতে উল্টোফল বয়ে আনাতে পারে।
×