ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নির্ভরতার মূর্ত প্রতীক সাব্বির

প্রকাশিত: ০৫:২১, ২ মার্চ ২০১৬

নির্ভরতার মূর্ত  প্রতীক সাব্বির

প্রতি দলেই এমন একজন ক্রিকেটার থাকতে হয় যার আগ্রাসী ব্যাটিং প্রতিপক্ষের জন্য ভীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। প্রতিপক্ষরা হিসেবে কষতে থাকে মারকুটে ব্যাটসম্যানদের আটকানোর উপায় বের করতে। যুগে যুগে সব দলেই এমন কোন এক ব্যাটসম্যান ছিলেন যার তা-ব ঠেকানোর পরিকল্পনায় রাতের ঘুম নষ্ট করতে হয়েছে। যেমন আছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিস গেইল, নিউজিল্যান্ডের ব্রেন্ডন ম্যাককুলাম, কোরি এ্যান্ডারসন, ইংল্যান্ডের জো রুট, এ্যালেক্স হেলস, অস্ট্রেলিয়ার গ্লেন ম্যাক্সওয়েল, শেন ওয়াটসন, দক্ষিণ আফ্রিকার এবি ডি ভিলিয়ার্সরা। বাংলাদেশ দলে এমন নির্ভরযোগ্য কোন বিধ্বংসী ব্যাটসম্যানের ঘাটতি বরাবরই দেখা গেছে। আর সে কারণেই ক্ষুদ্রতম ফরমেটের টি২০ ক্রিকেটে এখন পর্যন্ত শুধু টেস্ট খেলুড়ে অন্য দলগুলোই নয়, আরও অনেক দলের চেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। মারদাঙ্গা ব্যাটিংয়ে এক সময় সিদ্ধহস্ত তামিম ইকবালও সম্প্রতি অনেকখানি থিতু হয়েছেন। তবে সাব্বির রহমান রুম্মান দলে আসার পর সবাই ভাবতে শুরু করলেন টি২০ স্পেশালিস্ট রাজশাহীর এ তরুণ। হ্যাঁ, তার ব্যাটিং করার মনোভাবটা তেমনই। বেশকিছু ম্যাচ খেলে সেটাই তিনি প্রমাণ দিয়েছেন! সবচেয়ে বড় প্রমাণটা দিলেন এবার এশিয়া কাপ টি২০ আসরে। উদ্বোধনী ব্যাটিংয়ে নেই অপরিহার্য ব্যাটসম্যান তামিম! কিন্তু ওয়ানডাউনে থিঁতু হয়ে যাওয়া সাব্বির সেটা বুঝতেই দেননি। ব্যাট হাতে ঝড়ো ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি ধারাবাহিকভাবে রান করে যাওয়ার দারুণ কীর্তি দেখালেন শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে। এর আগে কখনও লঙ্কানদের বিপক্ষে টি২০ জিততে পারেনি বাংলাদেশ। কিন্তু সাব্বিরের দুরন্ত ব্যাটিংয়ে এবার সেই কাজটাই করল বাংলাদেশ দল। ৫৪ বলে ৮০ রানের বিধ্বংসী ইনিংস খেলে দলকে জয়ের পথ বাতলে দিলেন। কিন্তু এখানেই থামলে চলবে কেন? আরও অনেকটা পথ পাড়ি দিতে হবে! বাংলাদেশের জন্য অনেক কিছুই করে দেখানোর বাকি আছে, টি২০ ক্রিকেটে দলকে ভাল একটি অবস্থানে নিতে হলে এই ধারাবাহিকতা রাখাও অত্যন্ত জরুরী। সেটা ভাল করেই জানেন এ তরুণ। ঘোষণা দিলেন দৃপ্ত কণ্ঠে আরও উন্নতি করতে চান এবং দলের প্রয়োজনে এভাবেই ব্যাট চালিয়ে যেতে চান। আগের চারবার শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে পারেনি বাংলাদেশ দল। আর শেষ দুটি মোকাবেলায় তো সঙ্গী হয়েছে আফসোস। শেষ বলের নাটকীয়তার কাছে পরাজিত হয়েছে টাইগাররা। অবশেষে সেই লঙ্কানদের টি২০ ক্রিকেটে প্রথমবারের মতো বধ করেছে বাংলাদেশ। রবিবার এশিয়া কাপে বাঘ-সিংহের যে ক্রিকেটীয় লড়াই সেখানে বিজয়ীর বেশ নিয়ে মাঠ ছেড়েছে বাঘেরাই। আর এই যুদ্ধ জয়ের নায়ক যিনি, তিনি হচ্ছেন সাব্বির রহমান রুম্মান। ক্যারিয়ারসেরা ইনিংস খেলে যখন ৫৪ বলে ৮০ রানের বিস্ফোরক একটি রান নিয়ে সাজঘরে ফিরেছেন তখনও ৪ ওভার বাকি ছিল। যেভাবে খেলছিলেন মনে হচ্ছিল বাংলাদেশের পক্ষে টি২০ ক্রিকেটের প্রথম গর্বিত সেঞ্চুরিয়ান হবেন ২৪ বছর বয়সী এ তরুণ। কিন্তু সেটা হয়নি। অবশ্য পরে সংবাদ সম্মেলনে সাব্বির দাবি করেছেন সেঞ্চুরি বা হাফসেঞ্চুরির লক্ষ্য নিয়ে খেলেন না তিনি। তাই আফসোস নেই। তিনি ঘোষণা দিয়েছেন দলের জন্য যা প্রয়োজন সেটাই করার চেষ্টা করেন সবসময়। আর আইপিএল কিংবা সিপিএল নয়, যেখানেই খেলেন সবসময় চেষ্টা থাকে নিজের উন্নতি করার। আরও ভাল করতে চান তিনি। অধিনায়ক মাশরাফি বিন মর্তুজাও চান সাব্বির যেন নিজের মতো করেই খেলেন। এর আগে মাত্র দুটি অর্ধশতক হাঁকিয়েছেন সাব্বির। তবে ব্যাট হাতে নামলেই তার কাছ থেকে রান পেয়েছে বাংলাদেশ দল। সর্বোচ্চ ৫১ রানের অপরাজিত ইনিংস ছিল। ধারাবাহিকভাবে মারদাঙ্গা মনোভাবে ব্যাটিং করে দলের আস্থা কুড়িয়েছেন। সে কারণে তার ব্যাটিং পজিশনে পরিবর্তন এসেছে এ বছর জানুয়ারি মাসে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৪ ম্যাচের টি২০ সিরিজে। ৫ অথবা ৬ নম্বরে ঘুরাঘুরি করা সাব্বির তিন নম্বরে নেমে দারুণ সফল হয়েছেন এ সিরিজে। করেছেন ৪৬, ৪৩*, ৫০ ও ১ রান। স্থায়ী হয়ে গেছেন সে কারণেই তিন নম্বরে। এ বিষয়ে সাব্বির বলেন, ‘তিন নম্বর পজিশনে আমি খেলতে চাই। আমার কাছে মনে হচ্ছে এখানে খেলে আমার পক্ষে আরও ভাল করা সম্ভব। নিজের স্বাভাবিক খেলাটা এখানে খেলা যায়। এখানে খেলে আমি খেলাটাও উপভোগ করছি। বিপিএলে আমি তিনে নেমে সাফল্য পাওয়ার পর আমার আত্মবিশ্বাস আরও বেড়ে গেছে। তাই টি২০তে এ পজিশনটাই আমার কাছে বেশি প্রিয়।’ অধিনায়ক মাশরাফিও সাব্বিরকেই সমর্থন করছেন। তিনি এ বিষয়ে বলেন, ‘সাব্বির নিশ্চিন্ত মনে খেলুক। আমি মনে করি, তিন নম্বরে কী করতে হবে, তা সে ভাল করেই জানে। সুতরাং সে নিজের মতোই খেলুক। নিজের মতো খেলতে গিয়ে হয়ত প্রতিদিন সে সফল হবে না। তারপরও আমি চাই সে খোলামনেই খেলুক।’ ১৭ ম্যাচের টি২০ ক্যারিয়ারে নিয়মিত আক্রমণাত্মক মনোভাব নিয়ে ব্যাট চালিয়েও তিনবার অর্ধশতক ছুঁতে পারেননি। যে দু’বার অর্ধশতক ছুঁয়েছেন বেশি বড় করতে পারেননি ইনিংসকে। এবার সেই সমস্যাটা পেরিয়ে ৮০ রানের ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেছেন যা টি২০ ক্রিকেটে বাংলাদেশের পক্ষে চতুর্থ সেরা ব্যক্তিগত ইনিংস। মনে হচ্ছিল সেঞ্চুরি ছুঁয়ে ফেলবেন। কিন্তু একাই দলকে টেনে নিয়ে যাওয়ার পর ২৪ বল বাকি থাকতেই আউট হয়ে যান। তবে এ বিষয়ে সাব্বির বলেন, ‘আমি কখনও চিন্তা করিনি ফিফটি করব কিংবা সেঞ্চুরি করব। আমার চিন্তা থাকে সব সময় দলের জন্য খেলা। দলের স্বার্থে আমার অবদান যদি অল্পও হয় আমি সেটাই করতে চাই। ৪৯ রানে থাকলেও আমি দলের জন্য খেলব, নিজের জন্য নয়।’ টি২০ স্পেশালিস্ট নাম হয়ে গেছে সাব্বিরের। তিনি সেই নামের সুবিচারও করেছেন। শট খেলতে পছন্দ করেন রাজশাহীর এ ডানহাতি ব্যাটসম্যান। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শুরু থেকেই চিন্তা থাকে শট খেলার। কারণ আমার শক্তি এটাই। নিজের স্ট্রেংথ ধরেই এগোতে চাই।’ নিজের খেলার আরও উন্নতি করতে চান সাব্বির। বর্তমান ফর্ম অনুসারে বাংলাদেশের অন্যতম সেরা টি২০ ব্যাটসম্যান হলেও এখন পর্যন্ত দেশের বাইরের কোন জনপ্রিয় টি২০ আসরে খেলার সুযোগ হয়নি। কিন্তু সেসব নিয়ে চিন্তাই করছেন না সাব্বির। তিনি বলেন, ‘আমি প্রতিদিন উন্নতি করতে চাই। আইপিএল-সিপিএল বা এ ধরনের কোন আসর নিয়ে কিছু ভাবি না। যেখানেই খেলি না কেন, উন্নতি করার প্রতিই থাকে আমার বেশি মনোযোগ।’ ১৭ ম্যাচের টি২০ ক্যারিয়ারে সাব্বির করেছেন ৩১.৬১ গড়ে ৪১১ রান। স্ট্রাইক রেট ১২১.২৩! ব্যাটিং গড়ে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের পক্ষে দ্বিতীয় সেরা তিনি। সেদিক থেকে এক নম্বরে আছেন এনামুল হক বিজয় ৩২.২৭ গড় নিয়ে। তবে স্ট্রাইক রেট (১১৭.৯৪) তিনি আবার পিছিয়ে সাব্বিরের চেয়ে। তবে এখন সাব্বিরের জন্য চ্যালেঞ্জ আরও অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার। এশিয়া কাপের পরেও সেই লড়াইটা শেষ হবে না এ তরুণের। কারণ ভারতের মাটিতে শুরু হয়ে যাবে টি২০ বিশ্বকাপ। সেখানে দুর্বল বাংলাদেশকে মর্যাদার সুপার টেন পর্বে খেলতে হলে প্রাথমিক রাউন্ডে লড়তে হবে আইসিসির সহযোগী সদস্য দেশগুলোর বিপক্ষে। পারবেন সাব্বির তার ব্যাটের আগুন ধরে রেখে প্রতিপক্ষদের ভস্ম করতে?
×