ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

‘আমার কর্ম আমার জীবন’ গ্রন্থে এরশাদ

হত্যার উদ্দেশ্যেই বিএনপি আমাকে কারাগারে ঢুকিয়েছিল

প্রকাশিত: ০৪:৫৭, ২ মার্চ ২০১৬

হত্যার উদ্দেশ্যেই বিএনপি আমাকে কারাগারে ঢুকিয়েছিল

রাজন ভট্টাচার্য ॥ তীব্র গণআন্দোলনের মুখে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর ক্ষমতাচ্যুত হন তৎকালীন স্বৈরশাসক এরশাদ। এরপর ১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এসে তাঁর বিরুদ্ধে ৪২টি মামলা দিয়েছিল। মামলার কারণে কয়েক দফা কারাবরণ করতে হয়েছে তাঁকে। জেলে থেকেই নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। বিজয়ী হয়েছিলেন পাঁচটি আসনে। তবে হত্যার উদ্দেশ্যে বিএনপি সরকার তাঁকে কারাগারে নিয়েছিল বলে মনে করেন তিনি। ইরাকের সাবেক প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের উপহার হিসেবে দেয়া অস্ত্রের কারণেও তাঁকে সাজা ভোগ করতে হয়েছে। তাছাড়া তাঁর জেল হওয়ায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দু’জনেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলেছিলেন বলেও অভিযোগ করেন এরশাদ। নিজের লেখা ‘আমার কর্ম আমার জীবন’ গ্রন্থে এভাবেই জেল জীবনের বিস্তারিত তুলে ধরেছেন সাবেক এই রাষ্ট্রপতি। বইয়ের ৭৮৮ পৃষ্ঠায় ‘আমাকে কারাগারে পাঠিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর তুললেন দুই প্রধান দলের দুই শীর্ষ নেত্রী’ শীর্ষক এই অধ্যায়ে বিভিন্ন বিষয় ওঠে আসে। ৭৮৯ পৃষ্ঠায় ‘আমাকে ধীরে ধীরে মৃত্যুর মুখে ঠেলা দেয়াই ছিল তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য’ এই অধ্যায়ে কারা জীবনের অজানা অনেক কথাই উল্লেখ করেন সাবেক এই সেনাপ্রধান। মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়াই ছিল তাদের প্রকৃত উদ্দেশ্য ॥ নিজের লেখা বইতে তিনি লিখেছেন, ‘সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা ওই কারাগার কোন সাধারণ কারাগার ছিল না। পুরাণে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের অত্যাচারী মামা কংসের কারাগার নাকি ছিল নির্মমতার সর্বোচ্চ উদাহরণ। আর কারাগারে আমার প্রতি তৎকালীন সরকারের আচরণ কংস মামার আচরণকেও হার মানিয়েছিল। মধ্যযুগীয় বর্বরতার এমন উদাহরণ আর দ্বিতীয়টি খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাদের দেশের একজন প্রখ্যাত আইনবিদ গাজী শামসুর রহমান রেডিওর একটি আলোচনায় বলেছিলেন, আমি দীর্ঘদিন জজ হিসেবে চাকরি করেছি। অনেক অপরাধীর বিচার করেছি। সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ- দিয়েছি। কিন্তু একটি দিনের মতো নির্জন কারাবাসের মতো নির্মম দ- কাউকে দেইনি। এটা শুধু নির্মমতাই নয়, সভ্য জগতের নিয়ম নীতির পরিপন্থী এবং মানবতাবিরোধী একটি দ-’। আমাকে সেই মানবতাবিরোধী দ-ই দেয়া হয়েছিল। এ যে কি এক মর্মযাতনা, মানসিক যন্ত্রনা, এটা শুধু যে ভোগ করে সেই অনুভব করতে পারে। কারও না কারও সঙ্গে একটু কথা বলার জন্য বুকের মধ্যে হাহাকার করে ওঠতো। এক নাগারে সাড়ে তিন বছর কারও সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয়নি। আমাকে ঘিরে ইলেক্ট্রিক ব্যারিয়ার পর্যন্ত দেয়া হয়। যাতে আমি কারও সঙ্গে কথা বলতে না পারি। এরশাদ বলেন, তাদের উদ্দেশ্য ছিল আমি যেন ধীরে ধীরে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলি। কিংবা মনের দুঃখে আত্মহত্যা করি। আমাকে সাড়ে তিন বছর ওই নির্জন কারাবাস ভোগ করতে হয়। শুধু একটি অবৈধ আটকাদেশের কারণে। তারপরও এসবই আমি মেনে নিতে পারতাম, যদি আমি পড়াশোনার জন্য কিছু বই পেতাম। আর পেতাম লেখার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু কাগজ কলম। ...বিএনপি সরকারের সবচেয়ে ঘৃণ্য ও নিষ্ঠুরতম, সভ্যতা ও মানবতাবিরোধী বিকৃত মানসিকতার প্রকাশ পেয়েছিল আমার কক্ষে ২৪ ঘণ্টার জন্য দুটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা স্থাপনের মধ্য দিয়ে-যা আমার মৌলিক ও সাংবিধানিক অধিকারকে নির্মমভাবে হরণ করে। জেলখানার নির্জন প্রকোষ্ঠের চারদিকে সশস্র পাহারা ছাড়াও আমার ওপর সারাক্ষণ নজর রাখার জন্য বসানো হয় ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা। একদিন বিচার কাজের জন্য আমাকে আদালতে উপস্থিত করা হলে ওই সময়ে আমার অনুপস্থিতিতে আমার কক্ষে ব্যাপক তল্লাশি ও আমার ব্যক্তিগত জিনিসপত্র তছনছ করা হয়। বইতে তিনি আরও লিখেছেন, ‘...গুলশান সাবজেল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তরের সময় আমার রেডিও ওয়াকম্যানটি ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্য সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিলাম। অনেকদিন ধরে ওগুলো ব্যবহারে কারা কর্তৃপক্ষ কোন ওজর-আপত্তি না করলেও জুন মাসের (’৯২) প্রথম সপ্তাহে আমার কারাকক্ষ তল্লাশি করে একটি নোটবই ও সামান্য কিছু কাগজ কলমসহ সবকিছু নিয়ে যায়। শুধু তাই নয়, আমাকে নিঃসঙ্গতার আরও গভীরে ঠেলে দেয়ার জন্য ওয়াকম্যান রাখার দায়ে এক মাসের দ- দেয়া হয়। প্রদত্ত দ- অনুযায়ী ১৪ জুন থেকে ৩০ দিনের জন্য আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত করার অনুমতি বাতিল করা হয়। ঈদের দিন বিকেলে রওশন, শিশুপুত্র সাদ ও কন্যা জেবিন মাছ ও মাংস রান্না করে নিয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিল। সন্তানদের দু’দফা দেহ তল্লাশির পর ঢুকতে দেয়া হলেও রওশনকে ঢুকতে দেয়া হয়নি। কী কী খাবার তারা নিয়ে গিয়েছিল এবং সেসব খাবার কী কী দিয়ে তৈরি, তারও একটি বিবরণ দাখিল করতে হয়েছিল। আমার সঙ্গে সাক্ষাতকারীদের কক্ষ এবং আমার ভবনের মধ্যকার উঠোনের তিনদিকে ‘লাল রেখা’ টেনে দেয়া হয়েছিল। গার্ডরা অবস্থান করত ওই লাল দাগের বাইরে। আমি যাতে তাদের সঙ্গে কোন রকম কথা বলতে না পারি, সেজন্য নেয়া হয়েছিল এই ব্যবস্থা। ...একজন সাধারণ কয়েদির সুযোগ-সুবিধা আমাকে দেয়া হয়নি। চিকিৎসকদের পরামর্শও অমান্য করা হয়। হাইকোর্ট বেঞ্চ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্টকেও পাত্তা দেয়নি তৎকালীন বিএনপি সরকার। তদন্ত কমিশন জেলে তাদের প্রথম পরিদর্শনের দিনে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও বিভিন্ন নিরাপত্তা ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির অসযোগিতার বিষয়টিও রিপোর্টে উল্লেখ করেছিলেন। তারা বলেছিলেন, ‘এই অসহযোগিতা দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে অবমাননার শামিল।’ তদন্ত কমিটির রিপোর্ট দাখিলের পর বিচারপতি মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক ও বিচারপতি মাহফুজুর রহমানের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট ডিভিশন বেঞ্চ আমার সুচিকিৎসা করার ও সেই সঙ্গে নিরাপত্তা বিধানের নির্দেশ দিলেও তৎকালীন বিএনপি সরকার তা অগ্রাহ্য করে। সরকার কর্তৃক গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড আমাকে কোন বিশেষায়িত হাসপাতালে হস্তান্তর করার জন্য ছয়বার পরামর্শ দিলেও সরকার তাতে সম্মতি না দিয়ে চরম অমানবিক আচরণ করে। ...বিএনপির শাসনামলে কারাগারের ভেতরে এবং আদালত কক্ষে আমার প্রতি যে অমানবিক ও নিষ্ঠুর আচরণ করা হয়, তার দৃষ্টান্তও কোন সভ্য সমাজে, এমনকি অসভ্য সমাজেও পাওয়া যাবে না। প্রচলিত জেল কোড, গণতান্ত্রিক বিশ্ব ও সভ্য জগতের মৌলিক ও মানবাধিকারের প্রতি চরম অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দীর্ঘ তিন বছরের বেশি সময় আমাকে নির্জন কারাগারে রেখে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয়াই ছিল তাদের মূল উদ্দেশ্য। এগুলো কোন কথার কথা নয়, অভিযোগের জন্য অভিযোগ নয়, আমার প্রতি তৎকালীন বিএনপি সরকারের আচরণই তা নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করেছে...। কারাগারে পাঠিয়ে দুই নেত্রীর তৃপ্তির ঢেকুর ॥ বইতে এরশাদ লিখেছেন, ‘দেশের কয়েকটি রাজনৈতিক দলের দৃষ্টিতে আমি স্বৈরাচার ছিলাম। অবশ্য তারা একে অপরকে স্বৈরাচার সরকার কিংবা ফ্যাসিবাদী সরকার হিসেবে অভিহিত করে থাকে। তবে তাদের দৃষ্টিতে আমি স্বৈরাচার হলেও কোনদিন শেখ হাসিনা ওয়াজেদ ও বেগম জিয়াকে কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দী করে রাখিনি। তাদের আন্দোলন যখনই নৈরাজ্যে রূপ নিত, তখন জনগণের জানমালের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে, রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে প্রয়োজনবোধে নিজ নিজ গৃহেই অন্তরীণ করে রেখেছিলাম। অন্তরীণ থাকা অবস্থায় তারা বিবিসি-ভয়েস অব আমেরিকার মতো গণমাধ্যমেও সাক্ষাতকার দিয়েছিলেন। আমি কোন বাধা দেইনি, তাদের মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় অন্তরায় সৃষ্টি করিনি। ইচ্ছা করলে আমি তাদের বিভিন্ন মামলায় জড়িয়ে বিপাকে ফেলতে পারতাম, যা আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। গাড়ি ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ নিয়ে ‘হুকুমের আসামি’ করে অনেক মামলা দায়ের করতে পারতাম। আমি সে পথে পা বাড়াইনি। অথচ আমাকে গুলশানে সাবজেলে বন্দী করে তাদের প্রতিহিংসা চরিতার্থ হয়নি। আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাতে তারা উঠেপড়ে লেগেছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সঙ্গেও দেখা করলেন। আমার ওপর বিএনপির রোষ ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ এতই প্রবল ছিল যে, শীর্ষ নেত্রী বেগম জিয়া প্রায়ই খোলামেলা বলে বেড়াতেন, ‘এরশাদ আর জীবনে কারামুক্ত হবে না। তাকে জেলেই মরে পচতে হবে।’ তিনি বলেন, ‘জেলকোডে বলা হয়েছে, সূর্যাস্তে জেলের ‘সেল’ লক হয়ে গেলে পরদিন ভোরের আগে তা খোলার বিধান নেই। অথচ ১৮ এপ্রিল ১৯৯১ তারিখ রাত ১১টায় যখন অন্ধকারে আচ্ছন্ন ছিল পুরো ঢাকা শহর, তখন আমাকে গুলশান সাব জেল থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। রাত সোয়া ১১টায় জেলের পুরনো সেলে পৌঁছানো হয়। কারণ দিনের আলোয় ওদের বড় ভয় ছিল। ওরা ভয় পেয়েছিল দিনের মানুষকে, মানুষের ভিড় ও জনতাকে। তারা অন্ধকারে ঢাকা রাতে লোকচক্ষুর আড়ালে আমাকে নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় কারাগারে। আমার প্রিয় সকল মানুষ-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা, আমার প্রিয় বাংলাদেশের ৬৮ হাজার গ্রামের মানুষদের কাছ থেকে, সবুজ বৃক্ষ আর নীলাভ আকাশের সান্নিধ্য থেকে আমি নির্বাসিত হলাম। আমাকে নিক্ষেপ করা হলো অচিন্তনীয় এক নির্মম ও নিষ্ঠুরতার গভীরে। আমি বিচ্ছিন্ন হলাম সবার সান্নিধ্য থেকে। মনে হলো, এক অবিচারের অট্টহাসি আমাকে চারদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। হাফ ছেড়ে বাঁচলে দুই দলের দুই শীর্ষ নেত্রী। আমাকে কেন্দ্রীয় কারাগারে স্থানান্তর করায় আওয়ামী লীগ প্রধান সন্তোষ প্রকাশ করলেন। আর বিএনপি চেয়ারপার্সন তার ‘আপোসহীন’ সংগ্রামের বিজয় বলে ঘোষণা করলেন’। বইতে জেল জীবন প্রসঙ্গে এরশাদ আরও বলেন, ‘জেলখানার ভেতরে আরেক জেলখানায় বন্দী করা হলো আমাকে। কারণ, আমাকে নিয়ে তাদের অনেক দুঃশ্চিন্তা। পাঁচটি গেটে পাহারাদার তো আছেই। মাথার ওপরে সেন্ট্রি। পেছনে সেন্ট্রি। তবুও তাদের দুঃশ্চিন্তার শেষ ছিল না। আমার একটা নতুন নামকরণ হলো-কয়েদি নং ৪১৮০, যার শাস্তি দশ বছর। অস্ত্র মামলায়। অস্ত্রটি আমার নয়, সরকারের, সরকারী ভবনেই রক্ষিত ছিল। সরকারী সফরে ইরাক গেলে সে দেশের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন ইরাকের শহীদদের স্মৃতির প্রলেপমাখা নাইন মিলিমিটারের একটি পিস্তল আমাকে উপহার দিয়েছিলেন। তবুও তো, শাস্তি দিতে হবে। তাই দেয়া হয়েছিল। আমার সেলের গেটের চাবির নম্বর ছিল ৩১৬। প্রতিটি বিষন্ন বিকেলে এই চাবিতেই বিকট শব্দে বন্ধ হয়ে যেত আমার সেলের লৌহ কপাট। আবার পরের দিন সকালে ওই ৩১৬ নং চাবি দিয়েই খোলা হতো সেলের তালা’।
×