ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

খন রঞ্জন রায়

ট্যানারি শিল্প হরিণধরায় স্থানান্তর জরুরী ॥ অভিমত

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২ মার্চ ২০১৬

ট্যানারি শিল্প হরিণধরায়  স্থানান্তর জরুরী ॥ অভিমত

১৯৫২ সালের ৬ জুন ঢাকার হাজারীবাগে ১৩ একর জমির ওপর লেদার টেকনোলজি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এই ইনস্টিটিউটে ৩ বছর মেয়াদী ডিপ্লোমা ও ২ বছর মেয়াদী ভোকেশনাল (লেদার) প্রযুক্তিবিদ্যায় ডিগ্রী প্রদান করা হতো। ডিপ্লোমা ও ভোকেশনাল প্রযুক্তিবিদের ওপর নির্ভর করে হাজারীবাগে ৩০১টি লাভজনক ট্যানারি শিল্প গড়ে উঠেছিল। ঢাকা মহানগরীর জনবহুল হাজারীবাগ এলাকা থেকে ৫৫ বছরের পুরনো চামড়া প্রক্রিয়াকরণের কারখানাগুলো সাভারের হেমায়েতপুরের হরিণধরায় সরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ চলছে প্রায় দেড়দশক ধরে। এ জন্য সরকার হেমায়েতপুরে চামড়া শিল্পনগরী গড়ে তুলতে ১৫৮টি শিল্প প্লট অতি স্বল্পমূল্যে দিয়েছে। তাছাড়া কারখানা স্থানান্তরের ক্ষতিপূরণ বাবদ ২৫০ কোটি টাকা বরাদ্দ করেছে এবং অনেক কারখানার মালিক ক্ষতিপূরণের টাকা গ্রহণও করেছেন। সরকারের পক্ষ থেকে কারখানার মালিকদের আরও নানা ধরনের সুযোগ সুবিধা ও সহযোগিতার প্রতিশ্রুতিও দেয়া হয়েছে। এতকিছুর পরও হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি কারখানাগুলো সরিয়ে নেয়া হয়নি। এই পরিপ্রেক্ষিতে শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু গত জানুয়ারিতে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এগুলো সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। খোদ হাইকোর্ট দুই বছরে মধ্যে হাজারীবাগের ট্যানারি স্থানান্তরের নির্দেশ দিয়েছিলেন, আজ থেকে ১৫ বছর আগে, ২০০১ সালে। কিন্তু এত দীর্ঘ সময়েও তাঁরা তা করেননি। হাইকোর্টের নির্দেশ অনুযায়ী ট্যানারিশিল্প স্থানান্তর ব্যর্থতার অভিযোগে হাইকোর্ট গত বছর এপ্রিলে শিল্প মন্ত্রণালয়ের আট সচিব ও পরিবেশ অধিদফতরের দায়িত্বরত ছয় মহাপরিচালকের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার রুল জারি করেছিলেন। অর্ধ শতকের বেশি সময় ধরে হাজারীবাগের চামড়া কারখানাগুলো চলছে বর্জ্য শোধনাগার ছাড়াই। ফলে বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ এবং হাজারীবাগ ও তার পার্শ¦বর্তী এলাকাগুলোর মানুষের স্বাস্থ্যগত ক্ষতি নিয়ে নানা রকম গবেষণা পর্যালোচনার পর নিরাপদ স্থানে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত হয়। প্রসঙ্গত ২০০৩ সালে ১৬ আগস্ট জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির সভায় (একনেক) চামড়া শিল্পনগরী হিসেবে সাভারের হরিণধরাতে প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়। সাভারে ২০০ একর জায়গায় ট্যানারি শিল্পনগরীর কাজ শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০০৫ সালে। নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ায় প্রকল্পটি সংশোধন করে মেয়াদ বাড়ানো হয় ২০১০ সাল পর্যন্ত। ব্যয় বেড়ে দাঁড়ায় ৫৪৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকায়। তাতেও কাজ শেষ হয়নি। ব্যয় না বাড়িয়ে আবারও ২০১২ সাল পর্যন্ত মেয়াদ বাড়ানো হলেও কাজ শেষ হয়নি। সর্বশেষ ২০১৩ সালের আগস্টে দ্বিতীয় দফায় সংশোধিত প্রকল্পের অনুমোদন হয় একনেকে। ২০৫টি প্লটে ১৫৫ কারখানা হচ্ছে। বর্তমানে বিদ্যুত ও গ্যাস ব্যবস্থাপনা অবকাঠামো নির্মাণ, কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার ও ডাম্পিং ইয়ার্ড নির্মাণের কাজ ৯০ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। হাজারীবাগ থেকে হরিণধরার দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার। সময় পেরিয়ে গেছে ১৩ বছর। ইতোমধ্যে তিনটি সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে। কিন্তু হাজারীবাগের ট্যানারিগুলোকে আর সাভারে সরানো সম্ভব হয়নি। হাজারীবাগের ট্যানারির সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে রাজধানীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া বুড়িগঙ্গা নদীর ওপর। বলা হচ্ছে, বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ এত মারাত্মক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে শুধু বাংলাদেশের নয়, বিশ্বের কোন দেশের প্রচলিত প্রযুক্তি দিয়েই এই নদীর পানি পরিশোধন সম্ভব নয়। বুয়েটের পুরকৌশল বিভাগের একটি দল দুই বছর আগেই বুড়িগঙ্গা নদীর পানি ও জীববৈচিত্র্যের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করে বলেছিল, এই নদীর দূষণের সবচেয়ে বড় উৎস হাজারীবাগের ট্যানারি। দূষণের উৎসগুলো বন্ধ করলে কোন প্রযুক্তিরই প্রয়োজন হবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের আগের আমলের (২০০৯-১৪) শুরুতে নদীদূষণ ও অবৈধ জমি দখলসংক্রান্ত সংসদীয় উপকমিটি ২০১০ সালে অপর একটি পরিকল্পনা তৈরি করে। পরিকল্পনায় হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প এলাকাকে সবচেয়ে দূষণকারী এলাকা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভাবনাময় একটি শিল্পের উন্নয়ন ঘেরাটোপে আটকে যাওয়া গ্রহণযোগ্য নয়। এটা তো বাস্তব যে, দেশের চামড়া শিল্প অত্যন্ত সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। রফতানি খাতে আয়ও এক শ’ কোটি ডলারের মতো। এই খাতে কর্মসংস্থান রয়েছে কয়েক লাখ মানুষের। বর্তমানে বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের নতুন ক্রান্তিকাল। আগামীতে এ বিপর্যয় আরও ঘনীভূত হতে পারে বলে বাংলাদেশ ফিনিশড লেদার, লেদার গুডস এ্যান্ড ফুটওয়্যার এক্সপোর্টারস এ্যাসোসিয়েশন ধারণা করছে। কিভাবে স্থানান্তর করতে হবে এবং দ্রুত সম্পন্ন করা যায়, সে পদক্ষেপ গ্রহণের বিকল্প নেই। এর জন্য সামাজিক দায়বদ্ধতা দরকার। প্রশিক্ষিত দক্ষ জনবল ও প্রযুক্তি পরিকল্পনার অভাবে এখনও এ শিল্প স্থানান্তরিত হয়নি। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ও দায়িত্ব পালন করার জন্য একদল ডিপ্লোমা প্রযুক্তিবিদের প্রয়োজন, যারা লেদার, ফুটওয়্যার ও লেদার প্রোডাক্টসÑ তিনটি বিষয়ে আধুনিক টেকনোলজিতে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করবে। সরকার যদি সেখানে একটি লেদার ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার জন্য প্লট বরাদ্দ করে তাহলে জাতি আরও বেশি উপকৃত হবে।
×