ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

ইশ, আরও দু’-দশ দিন যদি পাওয়া যেত...!

প্রকাশিত: ০৫:৪২, ১ মার্চ ২০১৬

ইশ, আরও দু’-দশ দিন যদি পাওয়া যেত...!

মোরসালিন মিজান ॥ এত দেখা একটি মেলা। তবু বিস্ময় কাটে না। সেই ১ ফেব্রুয়ারি শুরু হয়েছিল। শেষ হলো সোমবার ২৯তম দিনে। দীর্ঘ এক মাসের আয়োজন। অথচ একঘেয়ে মনে হয়নি। মনে হয়নি, আর কত? বরং প্রতিটি দিনই নতুন ছিল। বই দেখে, বই কিনে চমৎকার কেটেছে! আড্ডা গল্প প্রিয়জনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়ানোÑ সবই ছিল বইকেন্দ্রিক। তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বইয়ের প্রতি পাঠকের অনুরাগ দেখে মুগ্ধ, শুধু মুগ্ধ-ই হতে হয়েছে। তবে সমাপনী দিনটি বেদনার ছিল। বুকের ভেতরে কেমন যেন ‘নেই’ ‘নেই’ অনুভূতি হয়েছে। মনে হয়েছে, কী যেন হারিয়ে যাচ্ছে! আহা, আরও যদি দু-দশ দিন পাওয়া যেত! এই বইটা কেনা হয়নি। ওই স্টলটায় যাওয়া হয়নি। এমন কত কত আক্ষেপ! প্রত্যাশাও ছিল। আগামীতে আরও সুন্দর আরও সফল মেলা আয়োজনের প্রত্যাশায় শেষ হয়েছে অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০১৬। ২৯তম দিনে সোমবার মেলা শুরু হয় বেলা একটায়। ফলে এক ঘণ্টা সময় বেশি পান বইপ্রেমীরা। সময়টা পুরোপুরি কাজে লাগিয়েছেন পাঠক। প্রবেশদ্বার উন্মুক্ত হওয়ার কয়েক মিনিট পর সোহরাওয়ার্দী উদ্যান ঘুরে দেখা যায়, একদিকে স্টল খোলা হচ্ছে, অন্যদিকে শুরু হয়ে গেছে বিক্রি! সময়, প্রথমা, পাঠক সমাবেশ, মাওলা, অন্য প্রকাশ, অনন্যা, কাকলী, তাম্রলিপি, ঐতিহ্য, অ্যার্ডনসহ বেশকিছু স্টলের সামনে এই দৃশ্য দেখা যায়। সময় যত গড়ায়, বইয়ের ক্রেতা পেয়ে যায় প্রায় সব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান। এদিন নির্দিষ্ট কোন লেখকের বই বিক্রি হয়নি শুধু। বহুবিধ সৃজনশীল প্রকাশনা পাঠককে খুঁজে নিতে দেখা গেছে। শেষ দিন হওয়ায় তাড়াহুড়োটা ছিল লক্ষ্য করার মতো। যার যা পছন্দ, চোখের সামনে পরলেই হলো, নিয়ে নিয়েছেন। শেষ দিনে তাই বিক্রি হয়েছে প্রচুর বই। এদিন মেলা শেষ করে যাদের বের হতে দেখা গেছে তাঁদের প্রায় প্রত্যেকের হাতে বই ছিল। এমন অনেক পাঠক দেখা গেছে যাদের দুই হাতে বড় বড় ব্যাগ ভর্তি বই। ওজন অনেক। বহু কষ্টে সামলাতে হচ্ছিল। এর পরও মনে আনন্দ! আরিফুর রহমান নামের এক বইপ্রেমী জানালেন, তিনি শেষ দুই ঘণ্টায় সাড়ে ৬ হাজার টাকার বই কিনেছেন। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র থেকে ৩ হাজার টাকায় কিনেছেন সৈয়দ মুজতবা আলী সমগ্র। বাকি টাকায় ৩টি প্রবন্ধ, ২টি উপন্যাস ও একটি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষণা গ্রন্থ কিনেছেন বলে জানান তিনি। সাবেক সরকারী কর্মকর্তা আনিসুল ইসলাম বই কিনেছিলেন দুই ব্যাগ ভর্তি করে। এর পরও তিনি খুশি হতে পারেননি। বললেন, দেশের বাইরে ছিলাম। বইয়ের বেশি খোঁজ রাখতে পারিনি। শেষ মুহূর্তে ভাল যা চোখে পড়েছে, কিনেছি। আরও সময় পাওয়া গেলে খুব ভাল হতো। কিন্তু আমার জন্য তো আর মেলার সময় বাড়াবে না! পারভীন আহমেদ নামের এক প্রবীণও আক্ষেপ করলেন। বললেন, মেলা এবার এমনভাবে সাজানো হয়েছে যে অনেক স্টল খুঁজেই পেলাম না। আর যখন পেয়েছি তখন আলো নিভে গেছে। মেলার শেষ দিনে এসে প্রকাশকদের অনেকেই লাভ লসের হিসাব কষেছেন। অ্যাডর্নের প্রধান নির্বাহী সৈয়দ জাকির হোসাইন অবশ্য বললেন অন্য কথা। তাঁর মতে, মেলায় বিক্রিটা আসলে বড় উদ্দেশ্য নয়। এত এত মানুষ প্রতিদিন এসেছেন। বই দেখেছেন। কিনেছেন। এটি অনেক বড় ব্যাপার। এই স্রোতটাকে সারা বছর কাজে লাগানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। ফিরে দেখা ॥ শেষ দিনের মেলায় অনেকেই একটু ফিরে দেখার চেষ্টা করেছেন। আর তখন একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে উঠেছে যে, এবারের মেলায় মান সম্পন্ন বইয়ের অভাব ছিল। নানাবিধ বিষয়ে লেখা মৌলিক গ্রন্থের অভাব ছিল। সেলিনা হোসেন, হাসান আজিজুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, নির্মলেন্দু গুণ, মহাদেব সাহার মতো লেখক ও কবিদের পুরনো রচনা নানা নামে নতুন মোড়কে প্রকাশিত হয়েছে। শ্রেষ্ঠ রচনা, রচনা সমগ্র, সেরা গল্প ইত্যাদি নাম দিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে বার বার পড়া গল্প উপন্যাস এবং কবিতা। এর ফলে পাঠকরা প্রায়শই প্রতারিত হয়েছেন। আশিকুর রহমান নামের এক পাঠকের অভিযোগ, অনুপম নামের একটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান হুমায়ূন আহমেদের দুটি উপন্যাস একত্রিত করে নতুন নাম দিয়ে বিক্রি করছে। এ প্রসঙ্গে উৎস প্রকাশনের স্বত্বাধিকারী মোস্তফা সেলিম জনকণ্ঠকে বলেন, মেলা যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কিছু বেশি অথবা কম বিক্রি করেছি। সে হিসাব করি না। কিন্তু অনেক মানসম্পন্ন মৌলিক বই সাজিয়ে রেখেছিলাম। সেগুলো বিক্রি হয়নি। একটি বই দেখিয়ে বললেন, এক কপিও যায়নি। এটি ভাবলে একটু হতাশ হই। ভাল বই চেনা ও কেনার ব্যাপারে পাঠকদের আরও সময় দেয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি। মেলায় স্টল বন্ধের বিষয়টিও বার বার আলোচনার বিষয় হয়ে এসেছে। এবারও ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাতের অভিযোগ এনে বন্ধ করে দেয়া হয় একটি স্টল। ‘ইসলাম বিতর্ক’ শিরোনামে প্রকাশিত বইয়ের জন্য ‘ব-দ্বীপ’র স্টলে পুলিশ হানা দেয়। এ ঘটনায় দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া। কারও কারও মতে, বইটি সব বিবেচনায় নিম্নমানের। অত্যন্ত অরুচিকর। মেলার সার্বিক ভাল চিন্তা করে স্টল বন্ধের সিদ্ধান্ত সময়োপযোগী হয়েছে। আবার একই ঘটনার প্রতিবাদ হয়েছে অনেক। লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে না দাঁড়ানো বাংলা একাডেমির কঠোর সামলোচনা করেছেন তাঁরা। এ নিয়ে শেষ কয়েকদিন উত্তপ্ত ছিল মেলা প্রাঙ্গণ। অবশ্য নীতিমালা ভঙ্গ ও কপিরাইট আইন অমান্য করায় রঙিন ফুলসহ আরও তিনটি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের স্টল বন্ধ করে দেয় মেলা কর্তৃপক্ষ। একাডেমির কথা একাডেমির বক্তব্য ॥ এবারের আয়োজন থেকে শিক্ষা নিয়ে ভবিষ্যতে মেলা আরও সফল করতে পারবে বলে মনে করে একাডেমি। মেলা শেষে এই প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, এটা অনেক বড় আয়োজন। আমরা আমাদের সামর্থ্যরে সবটুকু উজার করে দিয়ে মেলাটি আয়োজন করেছি। ছোটখাটো ভুল থাকতে পারে। আমরা ভবিষ্যতে সেসব ভুল ত্রুটি শুধরে নিশ্চয়ই সামনের দিকে এগিয়ে যাব। মেলামঞ্চের আয়োজন সমাপনী দিন মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয়েছে ‘নওয়াজেশ আহমেদ ও নাইবুদ্দিন আহমদকে স্মরণ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন শিল্প-সমালোচক অধ্যাপক নজরুল ইসলাম। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন অধ্যাপক বুলবন ওসমান, শামসুল আলম এবং নাসিম আহমেদ নাদভী। সভাপতিত্ব করেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। সমাপনী অনুষ্ঠান সন্ধ্যায় মেলার মূলমঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় অমর একুশে বইমেলার সমাপনী অনুষ্ঠান। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর। একাডেমির সভাপতি এমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতি সচিব আক্তারী মমতাজ, একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। মেলার প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ড. জালাল আহমেদ। অনুষ্ঠানে প্রবাসে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের চর্চায় অবদানের জন্য ফরাসি গবেষক ও অনুবাদক ফ্রাঁস ভট্টাচার্য ও প্রবাসী বাঙালী কথাশিল্পী মন্জু ইসলামকে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ পুরস্কার-২০১৫ আনুষ্ঠানিকভাবে প্রদান করা হয়। ২০১৫ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য মাওলা ব্রাদার্সকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০১৬, ২০১৫ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে গুণমান ও শৈল্পিক বিচারে সেরা গ্রন্থের জন্য ভূমেন্দ্র গুহ সম্পাদিত জীবনানন্দ দাশের মূলানগ পাঠ-ভূমিকা ও কবিতা গ্রন্থের জন্য বেঙ্গল পাবলিকেশনস্ লিমিটেড, বুলবুল আহমেদ সম্পাদিত ‘বুড্ডিষ্ট হেরিটেস অফ বাংলাদেশ’ গ্রন্থের জন্য নিমফিয়া পাবলিকেশন ও তাসলিমা মুন রচিত আমি একটি বাজপাখিকে হত্যা করতে চেয়েছিলাম গ্রন্থের জন্য পাঠসূত্রকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৬, ২০১৫ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ গ্রন্থের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০১৬ এবং ২০১৬ সালের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানসমূহের মধ্যে থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে সময় প্রকাশন, মধ্যমা পাবলিকেশন ও জ্যার্নিম্যান বুকস্-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০১৬ প্রদান করা হয়। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন শিল্পী ফরিদা পারভীন।
×