ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

তথ্য নেই ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহক সংখ্যারও ;###;এতদিন নির্বিঘ্নে ছিল ওদের বাংলাদেশের ঘাঁটি

সক্রিয় বিদেশী চক্র

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ১ মার্চ ২০১৬

সক্রিয় বিদেশী চক্র

মোয়াজ্জেমুল হক ॥ দেশে চলমান ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় অনিয়ম, দুর্নীতি, জালিয়াতি, লোপাট, অবৈধভাবে ঋণ নিয়ে পকেটস্থ করার ঘটনাবলীর সঙ্গে সর্বশেষ সংযোজন ঘটেছে এটিএম বুথ থেকে অত্যাধুনিক কারিগরি তৎপরতায় জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা। বিভিন্ন ব্যাংকে গ্রাহকদের সঞ্চিত অর্থ সাইবার জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট হয়ে যাওয়ার ঘটনা ব্যাংকসহ সাধারণ সকল মহলকে বিস্মিত করলেও এ ঘটনার পর কোন ব্যাংকের কী পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে এবং কী পরিমাণ গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা এখনও অঘোষিত রয়েছে। অথচ ঘটনার পরপরই ব্যাংকিং ব্যবস্থাপনায় তদন্তের মাধ্যমে এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য আসা উচিত ছিল বলে বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহলের দায়িত্বশীলরা মনে করেন। কিন্তু তা হয়নি; হয়েছে দেশে প্রচলিত আইনী ব্যবস্থায় সাইবার জালিয়াতি মামলা। কয়েকটি ব্যাংক তাদের লোপাটকৃত অর্থের প্রাথমিক যে হিসাব দিয়েছে তার সত্যতা নিয়ে বিভিন্নভাবে বিতর্ক উঠেছে। এ ঘটনায় বিদেশী নাগরিকসহ ব্যাংকের কয়েক কর্মকর্তা গ্রেফতার হয়েছেন। তাদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। তাদের প্রদত্ত বক্তব্যই গ্রাহকরা প্রতিনিয়ত মিডিয়ার সুবাদে অবহিত হচ্ছেন। কিন্তু এসব ঘটনার অন্তর্নিহিত রহস্য কোথায় এবং তা নিয়ে সত্যতা কতটুকুÑ সে বিষয়ে বড় ধরনের প্রশ্ন থেকেই যায়। এটিএম বুথে জালিয়াতির মাধ্যমে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা নিয়ে এত লুকোচুরি কেন, তা সকলকে ব্যাপকভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। জালিয়াতির সব ঘটনাই ঘটেছে রাজধানী ঢাকায় এবং যেসব ব্যাংকে অর্থ খোয়া গেছে সেগুলো দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক হিসেবেই চিহ্নিত। প্রসঙ্গত, বৈধ ও অবৈধভাবে বাংলাদেশে দিনের পর দিন অবস্থান করে বিদেশী নাগরিকদের অপরাধী একটি চক্র একের পর এক চাঞ্চল্যকর বহু ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। স্বর্ণ চোরাচালান, মাদক চোরাচালান, মানবপাচার, জঙ্গীবাদের সম্পৃক্ততার পর বিভিন্ন ব্যাংকে এটিএম বুথে জালিয়াতির মাধ্যমে বিপুল অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চাঞ্চল্যকর ঘটনা এদের সর্বশেষ সংযোজন। বিভিন্ন ব্যাংকের এটিএম কার্ড বিভিন্ন বুথে উন্নত কারিগরি পন্থায় লাগসইভাবে সংযোজনের মাধ্যমে গ্রাহকদের মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, ব্যাংক প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সকল মহলকে বিস্মিত করেছে। তবে বেসরকারী কয়েকটি ব্যাংক তাদের লোপাটকৃত অর্থের যে হিসাব ইতোমধ্যে দিয়েছে তা গ্রাহকদের কাছে বিশ্বাসযোগ্য হয়নি। কারণ যে চক্রটি এ কাজে লিপ্ত তারা ইতোমধ্যেই বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিপুল পরিমাণ অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার রেকর্ড গড়েছে। বাংলাদেশেও এরা স্থায়ীভাবে ঘাঁটি গেঁড়ে এ অপকর্ম নির্বিঘেœ চালিয়ে যাচ্ছিল। ঘটনা ফাঁস হওয়ার আগেই এসব চক্রের বেশকিছু সদস্য দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনা ঘটেছে। এসব সন্দেহজনক বিদেশীদের বাংলাদেশে আসা ও যাওয়া এবং অবস্থান নিয়ে যথাযথ ব্যবস্থার দিকটি অনুপস্থিত বলেই প্রতীয়মান। পুলিশের দায়িত্বশীল কয়েকটি সূত্রে জানানো হয়, বাংলাদেশে বিদেশীদের প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে বড় ধরনের কোন কড়াকড়ি আরোপ নেই। ফলে সহজেই ইউরোপ, আমেরিকা, আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নাগরিকরা বিভিন্ন কর্মকা-ের ব্যানারে বাংলাদেশে নিয়মিত আসা-যাওয়া করছে। এ সুযোগে ঢুকছে অপরাধীদের বিভিন্ন চক্রের সদস্যরা। বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে সংঘবদ্ধভাবে অপরাধী চক্র চোরাচালান, মাদক চালান, মানবপাচার, জাল টাকা তৈরি, জঙ্গীবাদ তৎপরতাসহ বিভিন্ন চক্রের সঙ্গে গোপন অপকর্মে লিপ্ত। এসব চক্রের অপকর্মের সর্বশেষ উদ্ঘাটন এটিএম বুথ থেকে গ্রাহকদের মোটা অংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা। বর্তমানে এসব অপকর্মে ইউরোপীয় নাগরিকদের জড়িয়ে পড়ার ঘটনা সকল মহলকে রীতিমতো বিস্মিত করেছে। ইউরোপ, আমেরিকায় অপরাধ তৎপরতা যে নেই তা নয়। কিন্তু সুদূর বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে এসে এরা অপরাধে ফাঁদ পেতে অর্থ কামানো কর্মকে বেছে নেবে, তা আগে খুব বেশি ভাবা যায়নি। তবে তা এখন প্রমাণিত সত্য। ইতোপূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের নাম উঠে এলেও সর্বশেষ এটিএম বুথগুলো থেকে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনায় সুনির্দিষ্টভাবে পোলিশ নাগরিকের নাম বেরিয়ে আসায় তা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকেও রীতিমতো চমকে দিয়েছে। এসব অপরাধী চক্রের সঙ্গে দেশীয় ব্যাংক, ট্রাভেলিং এজেন্টসহ বিভিন্ন সংস্থার লোকজনদের নামও উঠে এসেছে, যা নিয়ে জোরালো তদন্ত চলছে। ইতোমধ্যে তদন্তে বিভিন্ন এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা উদ্ঘাটিত হয়েছে। বেসরকারী ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যে চিহ্নিত হওয়া ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকদের অর্থ ফিরিয়ে দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে এবং কয়েকজনের হাতে আনুষ্ঠানিকভাবে হাতিয়ে নেয়া পরিমাণ অর্থ ফেরতও দিয়েছে, যা নিঃসন্দেহে দ্রুত কার্যকর একটি উদ্যোগ। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে, অত্যাধুনিক ডিভাইস ব্যবহারের মাধ্যমে বিদেশী নাগরিকদের জালিয়াত চক্র দেশীয় সুযোগ সন্ধানীদের সহায়তায় এ ধরনের অপকর্মে লিপ্ত হওয়ার সুযোগ একদিনে পায়নি। এতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে এবং বিভিন্ন কারিগরি দিক ব্যবহার করে এদের সফল হতে হয়েছে। সফল হওয়ার পর থেকে কত ব্যাংকের কী পরিমাণ গ্রাহকের অর্থ এটিএম বুথ থেকে ওই চক্রটি হাতিয়ে নিয়েছে তার এখনও সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। অভিযোগে জানা গেছে, যেসব গ্রাহকের অর্থ এটিএম বুথে জালিয়াতির মাধ্যমে লোপাট হয়েছে এদের অনেককে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ নিজ উদ্যোগে ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করে তা আর বেশিদূর এগোতে দিচ্ছে না। কারণ এতে ব্যাংকের ভাবমূর্তিতে বড় ধরনের আঘাত হানছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি সংঘটিত বিভিন্ন এটিএম বুথে জালিয়াতির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ লোপাট হয়েছে এবং এতে কোন কোন ব্যাংকের কী পরিমাণ খোয়া গেছে, তা এখনও জনসমক্ষে প্রকাশ করা হয়নি; যা করা হয়েছে তা প্রথমদিককার। পরবর্তীতে লোপাট হওয়া অর্থের পরিমাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত গ্রাহকের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে বলে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উঠেছে। ব্যাংকসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দেশে এটিএম বুথ থেকে কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের ব্যাপক অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা এই প্রথম। ইতোপূর্বে আড়ালে আবডালে এ ধরনের ঘটনা ঘটেছে কিনা, তা গ্রাহককুল জানতে পারেনি। অথবা সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কর্তৃপক্ষ জানতে দেয়নি নিজেদের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে। দেশে এ ঘটনা ভয়াবহ হিসেবে চিহ্নিত হলেও এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ দায়সারাভাবে বিষয়টি এড়িয়ে চলেছে বলে জোরালো অভিযোগ উঠেছে। অপরাধী চক্রের এক বিদেশী হোতা ও দেশীয় একটি ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য মিলছে তাই মিডিয়ার মাধ্যমে গ্রাহকসহ সাধারণ মানুষ অবহিত হচ্ছে। কিন্তু এর ভেতরে আরও বড় ধরনের অপকর্মের ঘটনা রয়ে গেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে বলা হচ্ছে, দুর্নীতিবাজ এক শ্রেণীর ব্যাংক কর্মকর্তাসহ অন্য বিভিন্ন সেক্টরের এক্সপার্ট লোকজন ছাড়া এ ধরনের এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকদের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা রীতিমতো অসম্ভব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন নির্বাহী পরিচালক সোমবার জনকণ্ঠকে জানান, ঘটনা ঘটার পর বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে হস্তক্ষেপ করা হয়েছে এবং বিভিন্ন দিকনির্দেশনাও প্রদান করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কোন ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের এ অপকর্মে সম্পৃক্ততা পাওয়া গেলে তাদের বিরুদ্ধে আইনগতসহ কার্যকর কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনাও প্রদান করা হয়েছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, এটিএম বুথ থেকে জালিয়াতির মাধ্যমে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার ঘটনা কী পরিমাণ অর্থ খোয়া গেছে এবং কতজন গ্রাহক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান এখনও সংশ্লিষ্ট ব্যাংকগুলোর পক্ষে প্রদান করা হয়নি। ঘটনার পর তাৎক্ষণিকভাবে যে হিসাব দেয়া হয়েছিল এর বাইরে নতুন করে আর কিছু পাওয়া যায়নি। তবে ইতোমধ্যে পুলিশী তদন্ত শুরু হওয়ায় পুরো ঘটনার দেখভাল ও তদন্ত করা হচ্ছে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার পক্ষ থেকে। অপরদিকে বেসরকারী একটি ব্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তা এ ব্যাপারে জনকণ্ঠকে জানান, দেশের বড় বড় শহরগুলোতে যেভাবে এটিএম বুথ প্রতিষ্ঠা পাচ্ছে সে অনুযায়ী এর নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থা গড়ে উঠেনি। এর পাশাপাশি অত্যাধুনিক কারিগরি জালিয়াতির পদ্ধতিতে অর্থ উঠিয়ে নেয়ার ঘটনা ইতোপূর্বে চিন্তাও করা যায়নি। এখন দেশের সব ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে ব্যাপক সতর্কতা অবলম্বনের পাশাপাশি উন্নত বিশ্বে যেভাবে এটিএম বুথ পরিচালিত হচ্ছে সে ব্যবস্থার দিকে নজর দিতে হবে। অন্যথায় এভাবে ভবিষ্যতে আরও জালিয়াতির ঘটনা ঘটলে আশ্চর্যের কিছুই থাকবে না।
×