ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তাপস মজুমদার

অন্তরালে

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ১ মার্চ ২০১৬

অন্তরালে

ঢাকা-২১৪ আজকাল যখন কথায় কথায় বিশ্বায়ন ও গ্লোবাল ভিলেজের কথা বলা হচ্ছে, তখন কেন যেন মনে হয়, আচ্ছা পৃথিবীর বড় বড় প্রধান শহর-নগর-বন্দরগুলোর নামকরণ নিছক একটি সংখ্যা তথা কোন নম্বর দিয়ে রাখলেই তো দিব্যি চলে যায়। আধুনিক বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তির শনৈ শনৈ উন্নতির বদৌলতে তাহলে সেটি প্রকৃত অর্থেই ডিজিটাল হয়ে উঠতে পারে। যেমন, শুধু ২১৪ অথবা ঢ-২১৪ বলা হলে আমরা সহজেই বুঝব যে, এটি বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা শহরের কথা বলা হচ্ছে এবং এটি বিশ্বের ২১৪তম বাসোপযোগী শহর। শহরগুলোর মতো অনুরূপ আলাদা নম্বর হতে পারে সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, নৌবন্দর ইত্যাদি। সংখ্যাধিক্য খুব বেশি হলে শ্রেণীকরণের সুবিধার্থে রাজধানী এবং প্রাচীন নগর-বন্দরগুলোর জন্য চাই কি আলাদা নম্বর হতে পারে। আপাতত প্রস্তাবটা কিছুটা উদ্ভট শোনালেও কম্পিউটার, স্মার্টফোন, তথা গাণিতিক হিসাব রাখার সার্বিক বিবেচনায় একদিন মানুষের জন্য এটিই উত্তম বলে বিবেচিত হতে পারে। বাস্তবতা হলো, এখনও পর্যন্ত দেশে দেশে সীমানা বিভক্তি, ভিসা-পাসপোর্ট, বহির্গমন-নির্গমন ইত্যাদি থাকলেও সেদিন বুঝি খুব দূরে নয় যেদিন এসব থাকবে না। বরং ব্যক্তি মানুষের যাবতীয় তথ্য-উপাত্ত থাকবে যৎসামান্য একটি মাইক্রোচিুেপ, যেটি এমনকি ধারণ করা যাবে অঙ্গুষ্ঠ পরিমাণ ডগায়। বর্তমানের মতো বিমানবন্দর, নৌবন্দরের হ্যাপাও বুঝি আর থাকবে না। বরং মানুষ সরাসরি ট্রান্সপোর্ট হয়ে যাবে মুহূর্তের মধ্যে এক শহর থেকে আরেক শহরে। লন্ডন থেকে নিউইয়র্ক, সিডনি থেকে এডেন অথবা দামেস্ক থেকে ঢাকায়। পাঠক, উদ্ভট শোনালেও বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর এই ধারণাটিই বাস্তবে রূপ পেতে পারে এই শতকের শেষে অথবা আগামী শতাব্দীর শুরুতে। এখন প্রবেশ করি মূল প্রসঙ্গে। ঢাকার ক্ষেত্রে ২১৪তম সংখ্যাটি প্রযোজ্য হলো কেন? যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপ প্রতিষ্ঠান মার্সার প্রকাশিত ‘কোয়ালিটি অব লিভিং র‌্যাঙ্কিং-২০১৬’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে ঢাকার স্থানাঙ্ক হয়েছে ২১৪। আর জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে সেরা বিবেচনায় ১ নম্বরে উঠে এসেছে স্থাপত্য ও সঙ্গীতের কেন্দ্র হিসেবে খ্যাত অষ্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা। বিশ্বের সব জরিপই কমবেশি বিতর্কিত ও প্রশ্নবিদ্ধ হতে বাধ্য। তবে এটি যে কৌতূহল উদ্দীপক এতে কোন সন্দেহ নেই। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বর-নবেম্বরে এই জরিপের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়। জরিপে জীবনযাত্রার মূল্যায়ন করা হয়েছে কোন শহরের ৩৯টি বিষয়কে বিবেচনায় রেখে। বসবাস উপযোগী শহর হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে নিরাপদ ও স্থিতিশীল পরিবেশ, নাগরিক সুযোগ সুবিধা, পরিবহন সুবিধা, আনন্দ-বিনোদনের ব্যবস্থা, খাদ্যাখাদ্য, প্রকৃতি ও পরিবেশ, ঠগ-জোচ্চুরি-প্রতারণা ইত্যাদি নানা বিষয়। তবে সর্বাধিক প্রাধান্য ও গুরুত্ব দেয়া হয়েছে মানুষের ব্যক্তিগত নিরাপত্তাকে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি সুস্পষ্ট হতে পারে। যেমন, সবাই প্রায় একবাক্যে প্যারিসকে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর ও বাসোপযোগী শহর বলে রায় দেবেন। মার্সার জরিপেও গত কয়েক বছর ধরে প্যারিসের অবস্থান ছিল প্রথম দিকে। তবে ২০১৫ সালে উপর্যুপরি সন্ত্রাসী হামলার পরিপ্রেক্ষিতে প্যারিসের অবস্থান পিছিয়েছে ১০ ধাপ। এই শহরটির অবস্থান এখন ৩৭ এবং ৩৯ নম্বর অবস্থানে আছে লন্ডন। তবে লন্ডন পিছিয়েছে বায়ুদূষণ, যানজট ও জলবায়ুর কারণে। আমরা আদার ব্যাপারী বিধায় ভিয়েনা, জেনেভা, সিডনি, মিউনিখ অথবা ভ্যাঙ্কুবারের খবরাখবর নিয়ে কাজ নেই। আমরা বরং প্রত্যাবর্তন করি স্বদেশে আয়নায় কিছুটা নিজেদের মুখ দেখব বলে। ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দিকটি মাথায় রেখে আমরা কী ঢাকাকে আদৌ বাসোপযোগী বলব? আমরা তো কোন ছাড়, বোধকরি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও তা বলবে না। সেই কবে গৃহভ্যন্তরে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি খুন হয়েছে। কোন কুল-কিনারা হয়নি আজও। এর অতি দুর্ভেদ্য রহস্য ভেদ করা বুঝি জেমস বন্ড অথবা শার্লক হোমসেরও অসাধ্য! একুশের বইমেলা থেকে সস্ত্রীক বেরিয়ে এসে বিজ্ঞানমনস্ক লেখক অভিজিৎ রায় ব্যাপক আইনশ্ঙ্খৃলা বাহিনীর উপস্থিতিতে যখন সর্বসমক্ষে চাপাতির ঘায়ে খুন হন নির্মমভাবে অথবা জাগৃতি প্রকাশনীর প্রকাশক ফয়সাল আরেফিন দীপনকে অফিসে কর্মরত অবস্থায় চাপাতির কোপে কবন্ধপ্রায় করে যায় নিষ্ঠুর ঘাতক, তখন সেই নিষ্ঠুর নিরাপত্তাহীনতা আমাদের প্রায় সবাইকে প্রায়ান্ধকার সরীসৃপের মতো গ্রাস না করে পারে না। এ রকম তামসিক উদাহরণ দেয়া যায় আরও, তবে তাতে পরিসর বাড়বে বটে, নিরাপত্তা নিশ্চিত হবে না। অবশ্য সান্ত¡নাও কিছু আছে বটে। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে অনিরাপদ শহর ইরাকের রাজধানী বাগদাদ, জীবনযাত্রার মানেও সবচেয়ে কমÑ ২৩০তম। আর যুদ্ধবিধ্বস্ত সিরিয়ার দামেস্ক ২২৯তম নিরাপত্তার দিক থেকে; তবে জীবনযাত্রার মানে ২২৪তম। তবে স্বীকার করতেই হবে যে, দেশ দুটি যুদ্ধাক্রান্ত ও বিধ্বস্তপ্রায়। আর পাকিস্তানের ইসলামাবাদ ১৯৩, লাহোর ১৯৯ ও করাচি ২০২তম অবস্থানে থাকলেও, আমরা জানি সবদিক থেকেই পাকিস্তান একেবারেই অনিরাপদ ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকার ওপরের দিকে। মাঝে মধ্যে মনে হয় দেশটি যেন আসলেই চলে গেছে মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী ও তালেবানের কব্জায়। মার্সার জরিপ সম্পর্কে এক প্রতিক্রিয়ায় বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের বিবেচনায় ঢাকাকে বসবাসের অনুপযোগী বলা যাবে না। তবে এটি শতভাগ অপরিকল্পিত শহর। তবে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন অবধারিত, ঢাকার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগুলো কি আমরা আদৌ বাঁচিয়ে রেখেছি? অথবা, সংরক্ষণের আদৌ কোন চেষ্টা আছে? ছোটকাটরা, বড়কাটরা, রূপলালহাউস, পরীবিবির মাজার অথবা অন্য কোন স্থাপনা? এর উত্তর নাসূচক হতে বাধ্য। ঢাকা দক্ষিণের মেয়র সাঈদ খোকন জরিপের মতামতকে অবশ্য গুরুত্ব দিয়েছেন। আর উত্তরের আনিসুল হক বলেছেন, তিন বছর পর ঢাকার এ অবস্থা থাকবে না। এবার আসি পরিবহনে। প্রতিদিন মিনিবাসে সিটিং সার্ভিসে মতিঝিলের শাপলা চত্বর থেকে বাংলামটর যেতে হয়। কতটুকু দূরত্ব? বড়জোর দশ মিনিট, না হয় পনেরো। বাস্তবে যেতে লাগে কমসে কম এক দেড় ঘণ্টা, কোন দিন আরও বেশি। দৈনিক বাংলার মোড় থেকে শাহবাগ পর্যন্ত ট্রাফিক জ্যাম তো ভুবনবিখ্যাত। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের রাস্তাটি মোটামুটি চওড়াই বলতে হবে। এর এক অংশ অর্থাৎ প্রায় অর্ধেক রাস্তা বলতে গেলে প্রতিদিনই বন্ধ থাকে মানববন্ধন, জনসভা, অবস্থান ধর্মঘট, অনশন ধর্মঘট ইত্যাদি নানা কারণে। মাঝে মধ্যে এমনকি ছুটির দিনেও সেখানে সমাবেশ হতে দেখা যায়। পৃথিবীতে বোধকরি হেন কোন সমস্যা ও দাবি-দাওয়া নেই, যা প্রেসক্লাবের সামনে উপস্থাপিত না হয়। বস্তিবাসী থেকে বৃহন্নলা বৃত্তান্তÑ সবই মেলে তোপখানায়। কেউ বা কোন সংস্থা জরিপ করলে অবশ্যই খুশি হবোÑ তবে এটুকু বলতে পারি যে, বাংলাদেশে ছোট বড় যত সংগঠন ও সমিতি আছে, বিশ্বের সব দেশ মিলেও বুঝি তা নেই। হাল আমলে চোখে পড়ল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে বিশাল বড় সাইনবোর্ড, রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্তÑ বাংলাদেশ হিজড়া কল্যাণ সমিতি। ভিক্ষুক সমিতি, পতিতা কল্যাণ সমিতি তো পুরনো। প্রতিদিন গজিয়ে উঠছে নিত্যনতুন সমিতি। কেবল বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধা নাম নিয়ে যত সমিতি-সংগঠন আছে, বোধকরি সেগুলো পরিসংখ্যান ব্যুরোও গুনে শেষ করতে পারবে না। আর যাবতীয় দাবি-দাওয়া-আহাজারি-আবেদন-নিবেদন নর্তন কুর্দন আনন্দ বিনোদন এমনকি ক্রন্দন পর্যন্ত মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরে আবর্তিত। মাঝে মধ্যে মনে হয়, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর হাতে যদি সত্যি সত্যিই আলাদিনের চেরাগ থাকত, তাহলেও তিনি সবার সব দাবি পূরণ করতে পারতেন না। কেননা, বাঙালীর দাবি-দাওয়ারও যেমন কোন শেষ নেই, তেমনি তা পাওয়ারও প্রশ্ন ওঠে না। স্বল্প পরিসরে ঢাকার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে আমরা কোন মন্তব্য করব না। তা একশ্রেণীর তথাকথিত ভোজনরসিক বা পেটুক আহা-বাহা যা-ই বলুন না কেন! শুধু বলব, ঢাকার প্রায় সব খাদ্যই ভেজালে ভেজালÑ কাঁচামাল থেকে পাকপ্রণালী পর্যন্ত। আর ভেজাল খাদ্য আর যা-ই হোক সুস্বাদু ও মুখরোচক হয় না; স্বাস্থ্যকর ও পুষ্টিমানসমৃদ্ধ তো নয়ই। আর তাই জাতি হিসেবেও আমরা অপরিপুষ্ট। ঢাকার পানি অবিশুদ্ধ, বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত সীসা, গাছপালা শ্বাস নিতে পারে না, মানুষের দম বন্ধ হয়ে আসে। এতসব, এত কিছুর পরও ২১৪তম অবস্থান নিয়ে পৃথিবীতে আমরা বেঁচে বর্তে আছি কী করে? আসলে আমরা বেঁচে আছি কাফকার মেটামরফোসিস গল্পের সেই গ্রেগর সামসার মতো, প্রায় বিবর্তনহীন তেলাপোকার মতো, যদি আদৌ একে বেঁচে থাকা বলে! মহাবিশ্বের মহাসঙ্গীত মহাসিন্ধুর ওপারের সঙ্গীতের অপূর্ব সুরমূর্ছনা আমরা শুনেছি কমল দাশগুপ্তের অপার কল্যাণে। এবার বুঝি অধীর আগ্রহে কান পেতে থাকতে হবে মহাশূন্যের মহাসঙ্গীত শোনার জন্য। তবে তার আগে মহাশূন্য বলতে ঠিক কী বোঝায় তা যৎকিঞ্চিৎ ব্যাখ্যা করা ভাল। তারও আগে অনুমান করা যেতে পারে যে, বিশ্ব ব্রহ্মা-কে বাইরে থেকে অবলোকন করলে একে ঠিক কেমন দেখাবে? প্রকৃতপক্ষে মহাশূন্য সুবিশাল সুবৃহৎ একটি চাকতির মতো, অথবা সুপরিসর ক্রমাগত সম্প্রসারমান একটি ভারি ত্রিপলের মতো, রং নিকষ অন্ধকারাচ্ছন্ন হওয়াই অধিকতর সঙ্গত। সেখানে একাধিক সূর্য, তারা, গ্রহ, উপগ্রহ, গ্রহাণু, ধূমকেতু, ব্ল্যাকহোল বিভিন্ন রকম গতিবেগে ক্রমাগত ভেসে বেড়াচ্ছে, ছুটছে দিগি¦দিক, কখনও কাছে টানছে, কখনও দূরে ঠেলছে, কখনও একে অপরের সঙ্গে লিপ্ত হচ্ছে সংঘাত-সংঘর্ষে, আবার কখনওবা একটি আরেকটির মধ্যে বিলীন হয়ে যাচ্ছে অবলীলাক্রমে। সেক্ষেত্রে ত্রিপল বা চাকতি যা-ই বলি না কেন, এটি কি একেবারেই ফাঁকা তথা শূন্য? প্রচলিত পদার্থবিজ্ঞান ও সৃষ্টিতত্ত্ব মানলে, একেবারে শূন্য বা ফাঁকা থাকা সম্ভব নয়। এর মর্মমূলে অবশ্যই থাকার কথা কোন একটি মাধ্যমেরÑ যে মাধ্যমে সৃষ্টি, স্থিতি (স্পেস), কাল (টাইম বা সময়) ও লয় একাকার হয়ে যায়। একে বলে গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষীয় তরঙ্গ। স্রোতও বলা যেতে পারে। বিজ্ঞানীদের অনুমান, প্রাইমর্ডিয়াল গ্র্যাভিটি ওয়েভ সৃষ্টি হয়েছিল বিগ ব্যাং থেকে এক হাজার ৪০০ কোটি বছর আগে। অবশ্য একেবারে নির্ভুল হিসাব কষে সুনির্দিষ্ট সন-তারিখ বের করা বুঝি অসম্ভব। যা হোক এক শ’ বছর আগে মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইন এ সস্পর্কে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন তার জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি বা আপেক্ষিকতাবাদে। এই তত্ত্বের গাণিতিক পূর্বাভাস মিলেছিল আগেই, চার বছরের মধ্যে। ১০০ বছর পর মিলেছে পাথুরে প্রমাণ। অর্থাৎ, গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ বা মহাকর্ষ তরঙ্গের হদিস মিলেছে। এতদিন পর্যন্ত গবেষকরা মহাবিশ্বকে তড়িৎ চৌম্বক তরঙ্গ বা ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ওয়েভের ধারণা নিয়েই বিবেচনা করেছেন। এখন বিবেচনা করতে হবে মহাকর্ষীয় তরঙ্গের নিরিখে। মহাকর্ষীয় এই তরঙ্গকে শনাক্ত করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের লেজার ইন্টারফেরোমিটার গ্র্যাভিটেশনাল ওয়েভ অবজারভেটরির (লিগোর) এক দল বিজ্ঞানী, যার মধ্যে বাংলাদেশ-ভারতসহ বিশ্বের কমপক্ষে এক হাজার গবেষক জড়িত। বাংলাদেশী দু’জন গবেষকের নাম ড. দীপঙ্কর তালুকদার এবং ড. সেলিম শাহরিয়ার। ভূগর্ভে স্থাপিত লিগোবের অতি সূক্ষ্ম যন্ত্রপাতির মাধ্যমে বিজ্ঞানীরা ১৩০ কোটি আলোকবর্ষ দূরে দুটি কৃষ্ণগহ্বরের (ব্ল্যাকহোল) সংঘর্ষের ফলে সৃষ্ট মহাকর্ষীয় তরঙ্গ শনাক্ত করেন গত বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর। উল্লেখ্য, আলো সেকেন্ডে ১ লাখ ৮৬ হাজার মাইল গতিতে চলে এক বছরে যত দূর যায়, তাই এক আলোকবর্ষ দূরত্ব। দীর্ঘ কয়েক মাস গবেষণার পর বিজ্ঞানীদের যুগান্তকারী ঘোষণাটি আসে বৃহস্পতিবার ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬। এর ফলে বিশ্বব্রহ্মা-, তথা মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও বিবর্তন, কৃষ্ণগহ্বর, নিউট্রিনো তারকাসহ আরও নানা কিছু সম্পর্কে অনেক রহস্যের উন্মোচন সম্ভব হবে আগামীতে। এই আবিষ্কারের গুরুত্ব সম্পর্কে যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বিএস সত্যপ্রকাশ বলেন, ‘আমরা এখন মহাবিশ্বকে শুনতে পাব। আগের মতো তা কেবল তাকিয়ে দেখার মধ্যেই সীমিত থাকবে না।’ এবার মহাবিশ্বকে শুনতে পাওয়ার ব্যাপারটা একটু বলি। যুক্তরাষ্ট্রের মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার ২০০৮ সালে প্রকাশিত এক ‘ডিক্লাসিফাইড’ বা গোপনীয় নথিতে দেখা যায়, ১৯৬৯ সালে এ্যপোলো ১০-এর তিন নভোচারী চন্দ্র প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে কিছু ‘অপার্থিব চিৎকার ও গোলামাল’ শুনে বিস্মিত হয়েছিলেন। এরা ছিলেন টমাস পি স্ট্যাফোর্ড, জন ডব্লিউ ইয়ং ও ইউজেন একারনান। তিন নভোচারীর হেডফোনে ধারণকৃত কথোপকথনে শোনা যায়, একজন আরেকজনকে বলছেন, ‘তুমি শুনেছ? শিসের মতো সুর? হুউউউ!’ প্রত্যুত্তরে অন্য নভোচারী বলেন, ‘এ তো, মহাশূন্যের সুর। এই সুর বড় অদ্ভুত।’ প্রাথমিকভাবে বিজ্ঞানীরা এই সুরকে চৌম্বক ক্ষেত্র বা বেতার তরঙ্গের সঙ্গে চাঁদের বায়ুম-লের প্রতিক্রিয়াজনিত বললেও, চাঁদে এর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না। আর বায়ুম-ল থাকার তো প্রশ্নই ওঠে না। তাহলে কি এই সুর মহাবিশ্বের মহাসঙ্গীত? চাঁদের বুকে অবতরণকারী নাসার এ্যাপোলো-১৪ মিশনে অংশ নিয়েছিলেন মার্কিন নভোচারী এডগার মিচেল। তিনি সেখানে নয় ঘণ্টা হাঁটাহাঁটি করেন। প্রায় ৪৫ কেজি পাথর ও কাঁকর চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে সংগ্রহ করে প্রত্যাবর্তন করেন পৃথিবীতে। অভিযান শেষে মিচেল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন, তার মনে হয়েছে মহাবিশ্বের সবকিছুই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত একটি একক সত্তা। আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন, ‘মহাকাশযানে হঠাৎ উপলব্ধি হয় আমার দেহের আণবিক কণা এবং ধাতব মহাকাশযানের অণুকণা বহু আগে অন্য কোন নক্ষত্রে তৈরি হয়েছিল’। এই এডগার মিচেল মারা গেছেন ২০১৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি ফ্লোরিডার একটি হাসপাতালে ৮৫ বছর বয়সে। কবি অমিয় চক্রবর্তী সেই কবে আক্ষেপ করে লিখেছিলেন, ‘তোমার সৃষ্টি, আমার সৃষ্টি, তাঁর সৃষ্টির মাঝে/যত কিছু সুর, যা-কিছু বেসুরো বাজে/মেলাবেন, তিনি মেলাবেন’Ñ(সংগতি)। পাঠক, ব্ল্যাকহোলের মৃত্যু থেকে মহাকর্ষীয় তরঙ্গ, মহাশূন্যের মহাসঙ্গীত সর্বশেষ নভোচারী তথা মানুষের মৃত্যুচিন্তাÑ আপনি কী কিছু মেলাতে পারছেন?
×