ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টানা তিন বছর ধরে স্প্রেড সীমা লঙ্ঘন

সুদের উচ্চ আসনে ব্র্যাক ব্যাংক

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সুদের উচ্চ আসনে ব্র্যাক ব্যাংক

রহিম শেখ ॥ বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও গত তিন বছর ধরে স্প্রেড সীমা লঙ্ঘন করছে বেসরকারী মালিকানাধীন ব্র্যাক ব্যাংক লিমিটেড। দীর্ঘ এই সময়ে মাত্র এক মাস ৯ শতাংশের নিচে নামে স্প্রেড। ঋণের ক্ষেত্রে মাত্রাতিরিক্ত সুদহার ও অতিরিক্ত সার্ভিস চার্জ কর্তন করছে বেসরকারী খাতের এ ব্যাংকটি। ব্র্যাক ব্যাংক বলছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জানিয়ে সবকিছু করা হচ্ছে। অন্যদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে, নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটি নিজেদের মতো কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ২০১৩ সালে স্প্রেডসীমা ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের নিচে নামিয়ে আনতে কঠোর নির্দেশ দিয়ে চিঠি দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পর ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রজ্ঞাপণের মাধ্যমে নির্দেশ দিয়েছিল, স্প্রেড কোন অবস্থায়ই ৫ শতাংশের বেশি হতে পারবে না। এমন প্রেক্ষিতে ব্যাংক নির্বাহীদের সংগঠন এ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশ (এবিবি) বৈঠক করে সিদ্ধান্ত নেয় যে, মেয়াদি আমানতের সুদহার ১২ দশমিক ৫ শতাংশের বেশি দেবে না তারা। আর চলতি মূলধনের ঋণের ক্ষেত্রে সুদহার হবে ১৫ দশমিক ৫ শতাংশ। গেল ডিসেম্বরে সরকারী ব্যাংকগুলো সিদ্ধান্ত নেয় ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশের নিচে আসবে। সেটা তারা বাস্তবায়ন করেছে। বেসরকারী ব্যাংকের গড় স্প্রেড বর্তমানে সহনশীল থাকলেও ব্র্যাক ব্যাংকের অবস্থা খুবই নাজুক। ব্যাংকটি শুধু সীমা লঙ্ঘন করেছে এমন নয়। মাসের পর মাস ধরে স্প্রেড সীমা প্রায় দ্বিগুণে অবস্থান করছে। সর্বশেষ ব্যাংকার্স সভায় তফসিলি ব্যাংকের ব্যবস্থাপকদের সতর্ক করে গবর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, নির্দেশিত সীমার মধ্যে স্প্রেড হার নামিয়ে না আনলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংককের স্প্রেড বিষয়ক মাস ভিত্তিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত ৩ বছর অর্থাৎ (৩৬ মাস) ধরে ব্র্যাক ব্যাংক স্প্রেড সীমা লঙ্ঘন করেছে। শুধু তাই নয় সীমার মাত্রা সেখানে ৫ শতাংশ এর নিচে থাকার কথা সেখানে ৯-এর ওপরে দাঁড়িয়েছে। সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গেল ডিসেম্বর মাস শেষে ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৪ দশমিক ৮৪ শতাংশ। এর মধ্যে সরকারী ব্যাংকগুলোর স্প্রেড ৩ দশমিক ৭ শতাংশ, বেসরকারী ব্যাংকের ৫ দশমিক ১৪ শতাংশ। এ মাসে ব্র্যাক ব্যাংকের স্প্রেড দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫৮ শতাংশ। ব্যাংকটি এ মাসে আমানত সংগ্রহ করে ৩ দশমিক ৯৬ শতাংশে এবং ঋণ বিতরণ করে ১৩ দশমিক ৫৪ শতাংশে। এর আগের মাসে নবেম্বরে আমানতের সুদ ৪ দশমিক ৪৭ শতাংশ ও ঋণের সুদ ছিল ১৩ দশমিক ৬৭ শতাংশ এবং ব্যাংকটির স্প্রেড ছিল ৯ দশমিক ২ শতাংশ। অক্টোবরে স্প্রেড ছিল ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ৬ শতাংশ, আগস্টে ৮ দশমিক ৯ শতাংশ, জুলাই মাসে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, জুনে ৯ দশমিক ৫২ শতাংশ, মে মাসে ব্যাংকটির স্প্রেড ছিল ৯ দশমিক ৯ শতাংশ, এপ্রিলে স্প্রেড ছিল ১০ দশমিক শূন্য ৩ শতাংশ, মার্চে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৬১ শতাংশ এবং জানুয়ারিতে ৯ দশমিক ১৭ শতাংশ। প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ২০১৪ সালের জানুয়ারি শেষে ব্যাংকটির স্প্রেড ছিল ৯ দশমিক ৮১ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক ৬৬ শতাংশ, মার্চে ৯ দশমিক ৮৬ শতাংশ, এপ্রিলে ৯ দশমিক ৮ শতাংশ, মে মাসে ১০ দশমিক শূন্য ১ শতাংশ, জুনে ১০ দশমিক ২৭ শতাংশ, জুলাই শেষে ১০ দশমিক ৩২ শতাংশ, আগস্ট মাসে ১০ দশমিক ৭৪ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ, অক্টোবরে ১০ দশমিক ৭৬ শতাংশ, নবেম্বরে ১০ দশমিক শূন্য ৮ শতাংশ এবং ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির গড় স্প্রেড ছিল ৯ দশমিক ৭৫ শতাংশ। প্রতিবেদন পর্যালোচনায় আরও দেখা গেছে, ২০১৩ সালেও ব্যাংকটির স্প্রেড সীমা ছিল ৯-এর উর্ধে। জানুয়ারি মাস শেষে ছিল ৯ দশমিক শূন্য ৫ শতাংশ, ফেব্রুয়ারিতে ৯ দশমিক শূন্য ৬ শতাংশ, মার্চে ৯ দশমিক ১৫ শতাংশ, এপ্রিলে ৯ দশমিক ১৯ শতাংশ, মে মাসে ৯ দশমিক ৩ শতাংশ, জুনে ৯ দশমিক ৪৪ শতাংশ, জুলাই শেষে ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ, আগস্টে ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ, সেপ্টেম্বরে ৯ দশমিক ১ শতাংশ, অক্টোবরে ৯ দশমিক ৪ শতাংশ, নবেম্বরে ৯ দশমিক ৩৩ শতাংশ এবং ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির স্প্রেড ছিল ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। স্প্রেড সীমা লঙ্ঘন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন জনকণ্ঠকে জানান, ব্র্যাক ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোন নির্দেশনা অমান্য করছে না। ব্যাংকটি যা কিছু করছে সব কিছু বাংলাদেশ ব্যাংককে জানিয়ে করা হচ্ছে। স্প্রেড প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ব্যাংকটির স্প্রেড ৫ শতাংশের বেশি নেই। কনজ্যুমার এবং এসএমই খাতে এ ব্যাংক অন্য ব্যাংকের তুলনায় বেশি ঋণ দেয়। এ খাতে সুদের হার একটু বেশি। তাই কেন্দ্রীয় ব্যাংক যদি এ খাত বাদ দিয়ে স্প্রেডের গড় হিসেব করে তবে এর সীমা ৫ শতাংশের নিচে চলে আসবে। তিনি আরও জানান, ব্যাংকটির কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা সাড়ে ৭ হাজার, যা অন্য ব্যাংকে প্রায় আড়াই হাজার। তাই এ ব্যাংকের সেবার মান ভাল। এ কর্মকর্তাদের বেতন ভাতা, পরিচালনা ব্যয় ও প্রভিশন রাখতে চার্জ একটু বেশি নেয়া হচ্ছে। জানতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক শুভঙ্কর সাহা জনকণ্ঠকে জানান, সব ব্যাংকের স্প্রেডসীমা ৫ শতাংশের নিচে আনতে বরাবরই নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকগুলোর গড় স্প্রেড ৫ শতাংশের নিচে রয়েছে। তারপরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের স্প্রেড সীমা ৫ শতাংশীয় পয়েন্টের ওপরে অবস্থান করছে। গত তিন বছর ধরে ব্র্যাক ব্যাংককের স্প্রেড বেশি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ব্যাংকটির স্প্রেড গত তিন বছর ধরে ৯ শতাংশের ওপরে অবস্থান করছে। নির্দেশনা থাকা সত্ত্বেও ব্যাংকটি নিজেদের মতো কাজ করছে। নির্দেশিত সীমার মধ্যে স্প্রেড হার নামিয়ে না আনলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে তিনি জানান।
×