ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আসছে ‘সুপার টুইসডে’

প্রকাশিত: ০৩:০৯, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

আমেরিকার প্রেসিডেন্ট  নির্বাচনে আসছে ‘সুপার টুইসডে’

আগামীকাল টুইসডেতে হতে যাচ্ছে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে দলীয় প্রার্থী নির্বাচনের এক বিশাল ভোটাভুটি ‘সুপার টুইসডে’। এই মঙ্গলবার ১৩টি অঙ্গরাজ্যে একই দিনে অনুষ্ঠিত হবে যুগপৎ প্রাইমারি ও ককাস। রাজ্যগুলো হলো আলাবামা, আলাস্কা, আরকানসাস, কলোরাডো, জর্জিয়া, ম্যাসাচুসেটস, মিনেসোটা, ওকলাহোমা, টেনেসী, টেক্সাস, ভারমোন্ট, ভার্জিনিয়া ও আমেরিকান সামোয়া। নির্বাচনে সুপার মঙ্গলবার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ দিন। এহেন মঙ্গলবার কোন কোন প্রার্থীর জন্য মঙ্গল বারতা বয়ে আনবে সে বিষয়ে নির্বাচনী পোলগুলো ইতোমধ্যেই ধারণা দিতে শুরু করেছে। ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞরা বলেছেন যে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের মঙ্গলবারকে কিছু দিয়ে আটকানো যাবে না। তারা আরও বলছেন, সম্ভবত সুপার মঙ্গলবার হিলারি ক্লিনটনের জন্য শক্তিশালী ভিত গড়বে। হারাধনের দশ ছেলের চাইতে শুরুতে আরও সাত জন বেশি ছিল রিপাবলিকান দলের মনোনয়নপ্রার্থী। তারা সংখ্যায় ছিলেন সর্বমোট ১৭ জন। অথচ দলের বাইরে থেকে আসা নিউইয়র্ক ধনকুবেরের সঙ্গে প্রাথমিক প্রতিযোগিতাতেই ঝরে পড়লেন এক ডজন রিপাবলিকান মনোনয়নপ্রত্যাশী। সবশেষে লাইফ সাপোর্টে থাকা জেব বুশ বিদায় নিলেন নেভাদা থেকেই। বুশ ডাইনেস্টির বিদায় ঘণ্টা চলতি নির্বাচনে এত শিগগিরই বেজে যাবে সেটা ভাবা যায়নি। অথচ গভর্নর জন কেসি এবং কৃষ্ণাঙ্গ নিউরো সার্জন বেন কার্সন সিঙ্গেল ডিজিট নিয়ে জেবের পেছনে থেকেও রয়ে গেলেন রেসে। এ পর্যন্ত চারটি রাজ্যের প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়ে রিপাবলিকান দলের মনোনয়নপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প এককভাবে বিজয়ী হয়ে গেলেন তিন তিনটি রাজ্যে। সুপার মঙ্গলে ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া, ওকলাহোমা এবং ভারমন্টেও তিনি এগিয়ে। তবে টেক্সাসে সিনেটর টেড ক্রুজের সঙ্গে হবে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। এখন পর্যন্ত মনোনয়ন দৌড়ে এগিয়ে থাকা বিলীয়নিয়র ট্রাম্পকে বলা হচ্ছে রিপাবলিকান দলের বাধাহীন ফ্রন্ট রানার। কিন্তু তিনি কি পারবেন তার এই অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে? নাকি অন্য কেউ সেই গতি দেবে থামিয়ে। কার পক্ষে তা সম্ভব, সিনেটর মার্কো রুবিও নাকি সিনেটর টেড ক্রুজ? ক্রুজের পক্ষে এন্ডোর্সমেন্টে টেক্সাস গবর্নর গ্রেগ এ্যাবোট তাকে বর্ণনা করেন ‘তিনি আমাদের মূল্যবোধগুলোকে পুনরুদ্ধার করতে পারবেন বলে আমরা বিশ্বাস করতে পারি।’ এ্যাবোট আরও বলেন, ‘টেক্সাস রক্ষণশীলদের মনে রাখা প্রয়োজন এটাই আমাদের সময়- টেড ক্রুজ আমাদের প্রার্থী।’ বলা হয় রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ তাদের প্রার্থী হিসেবে চান কোন ব্যবসায়ী নয়, রাজনৈতিক ব্যক্তিকে। অন্যদিকে নিউজার্সির গবর্নর যিনি রিপাবলিকান পার্টি এস্টাবলিশমেন্টের অন্যতম ধরা হয়- তিনি তার এন্ডোর্সমেন্টে বলেন, হিলারির মতো প্রার্থীকে পরাস্ত করতে ট্রাম্পই হলেন যোগ্যতম। এ কথা বলতেই হয় রিপাবলিকান শিবিরে প্রায় প্রতিদিনই বাজছে নতুন বিতর্কের ঢাকঢোলক- যার কেন্দ্রে রয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। সুপার টুইসডের আগে শনিবার সাংবাদিকদের দুর্দান্তভাবে তুলোধুনো করে বলে ফেললেনÑ এরা হলো ‘মোস্ট ডিজঅনেস্ট হিউমান বিয়িং অন আর্থ!’ এর আগেও অবশ্য ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল সম্পর্কে বলেছিলেন পত্রিকাটির প্রতি আমার কোন ‘রেসপেক্ট’ নেই। কারণ তাদের এডিটোরিয়াল নিকৃষ্ট ও পোলগুলো বানোয়াট। কর্তৃপক্ষের উচিত যারা ওই সব লেখেন সেইসব সাংবাদিককে বিদায় করা। ২০১৬ সালের প্রথম নির্বাচনী প্রচারে ট্রাম সাহেব একহাত দেখে নিয়েছিলেন মেক্সিকানদের। আমেরিকায় পাড়ি দেয়া ওই দেশের অবৈধ মানুষের উদ্দেশে ‘কিলার্স’ ও ‘রেপিস্ট’ এসব অকথ্য গালিগালাজের সঙ্গে হুমকি দিয়েছিলেন তাদের স্বদেশে ফেরত পাঠানোর। আমেরিকা ও মেক্সিকো বর্ডারে দেয়াল তোলার ঘোষণাও তিনি দিয়েছিলেন। তার নির্বাচনী সভায় এ বিষয়ে একজন হিস্পানিক জার্নালিস্ট প্রশ্ন করা মাত্র বডিগার্ড দিয়ে তাকে তিনি বের করে দেন সে স্থান থেকে। আর কি আজব কা-, এরপর থেকেই ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা যেন স্কাই রকেটিং হাই! আরও বিস্ময়ের ব্যাপার, মেগ্যান ক্যালি নামে ফক্স টিভিতে বিতর্ক সঞ্চালনকারী মহিলা জার্নালিস্টকে সারাদেশের সামনে অশালীন ভাষায় আক্রমণ করার পরও এদেশের সাংবাদিক সমাজকে বাংলাদেশের মতো সরগরম হতে দেখা গেল না। উল্টো ফক্স টেলিভিশন ক্ষমা চাইবার পরও ট্রাম্প সাহেব তাদের আয়োজিত পরবর্তী বিতর্কে যাননি। কারণ মেগ্যানকেই সেখানে আবার রাখা হয়েছিল সঞ্চালক হিসেবে। কিন্তু বিতর্কে না যাওয়াটা নাকি আইওয়াবাসী পছন্দ করেননি। ফলে সেখানে তার পরাজয় ঘটেছিল। এমনকি ক্যাথলিক দুনিয়ার রাজাধিরাজ পোপ ফ্রান্সিসের সঙ্গেও তিনি বিতর্কে জড়াতে দ্বিধা করেননি। মেক্সিকো সফর শেষে রোম ফেরার পথে সম্প্রতি এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি সীমান্তে ট্রাম্পের দেয়াল তোলা প্রসঙ্গে বললেন, ‘সেটা যেখানেই হোক যে ব্যক্তি ব্রিজ ও দেয়াল নির্মাণ করার কথা ভাবে সে ব্যক্তি খ্রিস্টান নয়।’ হোন না তিনি সর্বজন শ্রদ্ধেয় পোপ; কিন্তু কারও মুখের কথা তো মাটিতে ফেলে দেয়ার অভ্যেস নেই ট্রাম্প মহোদয়ের। তাৎক্ষণিকভাবে গুলি বেরুলো তার জবানের বন্দুক থেকেÑ ‘ডিসগ্রেসফুল!’ সঙ্গে নানান ক্রুদ্ধ মন্তব্যে আরও বললেন, ‘যদি ভ্যাটিক্যানকে কখনও আইসিস আক্রমণ করে তবে পোপ তখন ডোনাল্ড ট্রাম্পকেই আমেরিকান রাষ্ট্রপতি হবার জন্য প্রার্থনা করবেন।’ অবশ্য পরের দিনই ক্যাথলিক সামাজের হৃদয়ের আঘাতে আরোগ্যের পরশ বুলিয়ে সাউথ ক্যারোলিনায় সিএনএন ডিবেটে বললেন, আমি পোপের সঙ্গে বাহাস করতে চাই না, বরং তার ব্যক্তিত্বকে আমি পছন্দ করি। আই লাইক হোয়াট হি রিপ্রেজেন্ট। আসলে মিডিয়াগুলো যেভাবে রিপোর্ট করেছিল সেটা সঠিক নয় আর পোপের মন্তব্য ছিল ‘মাচ নাইসার’। সুপার টুইসডের আগে ২৫ ফেব্রুয়ারি রিপাবলিকানদের ডিবেটকে মিডিয়া বলেছে যেন ১০ বছরের বালকের ঝগড়াতুল্য। সিনেটর মার্কো রুবিও এবং সিনেটর টেড ক্রুজ একসঙ্গে কামান দেগেছেন ডোনাল্ড ট্রাম্পকে। বলা ভাল, তারা হঠাৎ করে ভূমিকা বদল করে ব্যক্তিগত আক্রমণের মাধ্যমে নিজেদের নিয়ে যাচ্ছেন ট্রাম্প চরিত্রে। রুবিও বললেন, মঞ্চের পেছনে দেখলাম ট্রাম্প ঘামছেন, তার গোফ দিয়ে ঘাম গলে পড়ছে। মনে হয় প্যান্টও ভিজে গেছে। এবার ডেমোক্র্যাট প্রসঙ্গে আসি। প্রথমে এ দলের সাফল্যে তিনজন প্রতিযোগীকে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু সেই তৃতীয় প্রার্থী ভার্জিনিয়ার সাবেক গভর্নর মার্টিন ও’ ম্যালি কখন সটকে পড়লেন অলক্ষ্যে কে জানে। রিপাবলিকানদের তুলনায় ডেমোক্র্যাট শিবিরের চালচিত্রে বড়সড় বাকবিত-া নজর তেমন কাড়ে না। শুধু প্রচার অভিযানে স্বামীকে পাশে নিয়ে হিলারি ক্লিন্টনের মুখের হাসি বর্তমানে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর। আইওয়া, নেভাদা ও সাউথ ক্যারোলিনা বিজয়ের পর তাকে যেন সুস্থির করেছে তার ব্যাগে রাখা জয়ের তিন। আসছে টুইসডেতে টেক্সাস, ভার্জিনিয়া, জর্জিয়া, আলাবামা ও আরাকানসাসে হিলারি ক্লিন্টন জয়ী হবেন এমন ধারণা সবার। সাউথ ক্যারোলিনায় ভোট প্রার্থনা করে জিমনেশিয়াম থেকে চার্চ সর্বত্র চষে বেড়িয়েছেন ক্লিনটন দম্পতি। লক্ষ্য ছিল শুধু জয় নয়, মহাজয়ের রশ্মিতে সুপার টুইসডের ভোটারদের প্রভাবিত করা। ভোটারদের অর্ধেকই কালো ছিল বলে এই অঙ্গরাজ্যে তার প্রতিদ্বন্দ্বী যে ব্যাপকভাবে জিতবেন বার্নি স্যান্ডার্সও বিষয়টা নিশ্চিতভাবে জানতেন। এমনকি পূর্ববর্তী নেভাদা নির্বাচনে পর্যন্ত ৭৬% কৃষ্ণাঙ্গ ভোটার হিলারিকে ভোট দিয়েছেন। ব্যাপারটা সমঝে নিয়েই স্যান্ডার্স সাউথ ক্যারোলিনায় প্রচারের সময়টি পার করেছেন সুপার টুইসডের কোন কোন রাজ্যে। সেখানে ভোট প্রচারের চাইতে নিজেকে জানানোর ব্যাপারটি ছিল মুখ্য। বিপরীতে প্রায় তিন দশক ধরে সমগ্র আমেরিকাতেই ক্লিনটনরা বহুলভাবে পরিচিত। নেভাদায় পরাজয়ের পর থেকেই বার্নিকে বারবার প্রশ্ন করা হচ্ছেÑ তিনি কি এবার সরে যাবেন নির্বাচনী লড়াই থেকে? কিন্তু ৭৪ বছরের তরুণ তার যৌবনদীপ্ত অল্পবয়সী সাথীদের নিয়ে এখনও অবিচলিত চিত্ত। পথ চলতে চলতে তিনি জানাচ্ছেনÑ ৭ জুন ক্যালিফর্নিয়া প্রাইমারি পর্যন্ত শেষ শক্তি দিয়ে লড়ে যাব। উল্লেখ্য, এই রাজ্যে রয়েছে সমগ্র আমেরিকার মোট ডেমোক্র্যাট ডেলিগেটদের ২০%। নিজ রাজ্য ভারননসহ ম্যাসাচুসেট্স ও ওকলাহোমায় বার্নি ভাল করবেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ধারণার চাইতেও যদি অভাবনীয় ভাল কিছু ঘটান তবে আগামী বসন্ত পর্যন্ত তিনি সন্দেহাতীতভাবে থাকবেন রেসে। জানানো ভাল, রিপাবলিকান পার্টির মোট ডেলিগেটস ২,৪৭২ জন। দলের মনোনয়নের টিকেট পেতে হলে দরকার ১,২৩৭ ডেলিগেটস। নেভাদা ককাসের পর ট্রাম্পের ঝুলিতে পড়েছে ৬৭ ডেলিগেটস, টেড ক্রুজ পেলেন ১১ এবং মার্কোর বিও ১০। ডেমোক্রেটিক পার্টির মতো এদের সুপার ডেলিগেটস নেই। অন্যদিকে ২০১৬ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রাইমারি ও ককাসে ডেলিগেটস রয়েছে মোট ৪,৭৬৩ জন। এর মধ্যে সুপার ডেলিগেটস ৭১২। বলা ভাল, এই সুপাররা ভোটাভুটির মাধ্যমে নির্বাচিত নন। পদাধিকার বলে প্রেসিডেন্ট, সিনেটর, কংগ্রেসম্যান, গবর্নর ও পার্টির উর্ধতন কর্মকর্তারাই সুপার ডেলিগেটস। বলাবাহুল্য এদের অধিকাংশেরই সমাজতন্ত্রী বার্নিকে নাপছন্দ। এদের মাত্র ৭০ জন তার পক্ষে এবং বাদবাকি ডেলিগেটস হিলারির। ডেমোক্র্যাট দলের মনোনয়ন পেতে একজন প্রার্থীর প্রয়োজন ২,৩৮৩ ডেলিগেটস। সুপার টুইসডে ডেমোক্র্যাটিক পার্টিতে ১,০০৪ এবং রিপাবলিকান দলে ৫৯৫ ডেলিগেটস নির্বাচিত হবেন। ১ ফেব্রুয়ারি আইওয়া ককাসের মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া দলীয় মনোনয়নের দৌড় শেষ হবে ১৪ জুন ওয়াশিংটন ডিসিতে। তবে আপাতত এখন সবার মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দু সুপার টুইসডে। লেখক : আমেরিকা প্রবাসী সাংবাদিক। [email protected]
×