ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

জাকারিয়া স্বপন

বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে ধস এবং প্রতিক্রিয়া

প্রকাশিত: ০৩:০৮, ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলাদেশের টেলিকম শিল্পে ধস এবং প্রতিক্রিয়া

গত সপ্তাহে ‘আমার দিন’ কলামে ‘বাংলাদেশে টেলিকম শিল্পে ধস’ শিরোনামে লেখাটি প্রকাশিত হওয়ার পর দুই ধরনের প্রতিক্রিয়ার শিকার হয়েছিলাম। আজকের পর্বে সেগুলো নিয়ে কথা বলা যেতে পারে। টেলিকম শিল্পের সঙ্গে যারা সরাসরি জড়িত তাদের কেউ কেউ বলেছেন, পৃথিবীতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান একত্রিভূত হওয়ার ঘটনা খুবই সাধারণ একটি বিষয়। আর হাইটেক শিল্পে তো সেটা আরও বেশি। বাংলাদেশেও সেটা হতে যাচ্ছে। তাহলে সেটাকে আমি উল্লেখ করছি না কেন? কেন আমি শুধু শুধু সমালোচনা করছি? অপরদিকে একজন পাঠক তার মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন, বাংলাদেশে টেলিকম শিল্পের ধসের পেছনে আরও একটি বড় কারণ রয়েছে, তা হলো অবৈধ ভয়েস অভার ইন্টারনেট (ভিওআইপি) ব্যবসা। সেটা আমি আমার আগের লেখায় কেন উল্লেখ করিনি। এবং তিনি বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়ে আমাকে দীর্ঘ একটি চিঠি লিখেছেন। তারপর বিষয়টি নিয়ে আমি বেশ কিছু মানুষের সঙ্গেও কথা বলেছি। দু’পক্ষেরই যুক্তিতে মেরিট আছে। তাই উপরের দুটো বিষয় নিয়েই এবারের লেখা। ॥ দুই ॥ মার্জার এ্যান্ড একুইজেশন (এমএ্যান্ডএ) একটি প্রচলিত প্রথা। নানা স্ট্রাটিজিক কারণে এক প্রতিষ্ঠান আরেকটি প্রতিষ্ঠানকে কিনে নেয়, কিংবা দুটি প্রতিষ্ঠান মিলে একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। হাইটেক শিল্পে এর পরিমাণ বেশি। হাইটেক কোম্পানিগুলো খুব দ্রুত বড় হয়ে যায় এবং একে অপরের মার্কেট শেয়ার নিয়ে ফেলার প্রতিযোগিতায় নেমে যাওয়ার প্রবণতা আছে। তখন প্রতিষ্ঠান কেনা-কাটার প্রয়োজন দেখা দেয়। এই গেল বছরেই অক্টোবর মাসে বিখ্যাত কম্পিউটার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ‘ডেল’ আরেকটি হাইটেক প্রতিষ্ঠান ‘ইএমসি’-কে ৬৭ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছে। এটা হলো হাইটেক শিল্পে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় মার্জার। টেলিকম শিল্পকে হাইটেক শিল্পের ভেতর গণ্য করা হয় না। টেলিকম একটি ভিন্ন খাত। টেলিকমে সবচেয়ে বড় মার্জার হয়েছিল ২০০০ সালে যখন ইংল্যান্ডের ‘ভোডাফোন’ জার্মানির ম্যানেসম্যানকে প্রায় ১৮১ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছিল। এর ফলে ভোডাফোন পৃথিবীর সবচেয়ে বড় টেলিফোন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তবে জার্মানির অনেকেই এর বিরোধিতা করেছিল। ২০০০ সালেই আমেরিকাতে বিখ্যাত ‘আমেরিকা অনলাইন’ (এওএল) টাইম ওয়ার্নারকে ১৬৪ বিলিয়ন ডলার দিয়ে কিনে নিয়েছিল। আমেরিকার বিখ্যাত টেলিফোন কোম্পানি ভেরাইজন টেলিকমের ৪৫% শেয়ার ছিল ব্রিটেনের ভোডাফোনের। দীর্ঘদিন ধরে ভেরাইজন চেয়েছিল সেই শেয়ারটুকু কিনে নিতে। পরিশেষে ২০১৩ সালে ভেরাইজন ১৩০ বিলিয়ন ডলারের বিনিময়ে ভোডাফোনের শেয়ার কিনে নিয়ে পুরো কোম্পানিতে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে। ফলে ভেরাইজন নিজেদের পরিকল্পনা অনুযায়ী বিনিয়োগ করতে সমর্থ হয়। ২০০৬ সালের মার্চ মাসে আমেরিকার বিখ্যাত টেলিফোন কোম্পানি এটিএন্ডটি তাদের কাভারেজ বাড়ানোর জন্য ৮৬ বিলিয়ন ডলার দিয়ে ‘বেল সাউথ’ নামের আরেকটি টেলিকমকে কিনে নেয়। ২০০১ সালে কমকাস্ট ৭২ বিলিয়ন ডলার দিয়ে এটিএন্ডটি ব্রডব্যান্ডকে কিনে নেয়। ২০০০ সালের জুন মাসে ইতিহাসে আরেকটি বড় মার্জার হয়। বেল আটলান্টিক ৬৪.৭ বিলিয়ন ডলার দিয়ে জিটিই কর্পোরেশনকে কিনে নেয়। তারপর বেল আটলান্টিক দুটি প্রতিষ্ঠানকে একত্রে নতুন নামে পৃথিবীতে আসে। ইংরেজী ট্রুথ, ভেরিটাস ও হরাইজনÑ এই তিনটি শব্দের ল্যাটিন মিশ্রণ করে তৈরি করা হয় ‘ভেরাইজন কমিউনিকেশন’Ñ যা আমেরিকাতে বর্তমানে সবচেয়ে বড় মোবাইল অপারেটর। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের মতে, ২০১৫ সালটি ছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি মার্জার এ্যান্ড একুইজেশনের বছর। সারা বছরে প্রায় ১১২টির মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান একত্রিভূত হয়েছে। সব মিলিয়ে প্রায় ৪.৩ ট্রিলিয়ন ডলার মূল্যের মার্জার হয়েছে। এর আগে ২০০৭ সালের রেকর্ড ছিল ৪.২ ট্রিলিয়ন ডলার। ২০১৫ সালটিতে মূলত মার্জার হয়েছে ওষুধ এবং প্রযুক্তি খাতে। সারা বিশ্বের যদি এমন বড় বড় টেলিকম একত্রিভূত হয়ে যেতে পারে, বাংলাদেশেও পারবে না কেন? তারা প্রশ্ন করছেন, সিটিসেল তো ব্যবসা করতে না পেরে ধীরে ধীরে মৃত্যু পথযাত্রী। আমরা কি চাই এয়ারটেলও এভাবে মারা যাক? তাহলে এয়ারটেল এবং রবির মার্জারে এত বিতর্ক কেন? সিটিসেলের বিষয়টি আসলেই অদ্ভুত! কেউ কি একবারও প্রশ্ন করেছেন, সিটিসেলে সিঙ্গাপুরের সিংটেলের মতো বিশাল টেলিকমের বিনিয়োগ থাকার পরেও কেন ধুঁকে ধুঁকে চলেছে? এর পেছনে আবার অন্য কোন ডিল নেই তো? সিঙ্গাপুরে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা বাংলাদেশে কথা বলার জন্য সিংটেলের বিশেষ একটি প্যাকেজ পান, যেই কলগুলো বাংলাদেশে প্রবেশ করে সিটিসেলের মাধ্যমে। এই প্রশ্নের জবাবটা দেবে কে? এবারে আসি এয়ারটেল-রবি মার্জারে। প্রথমেই বলে রাখি, আমি নিজেও চাই না কোন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ক্ষতির মুখে পড়ুক। তাতে সকলের জন্যই ঝামেলা। বিশেষ করে, ওখানে যারা কাজ করেন তাদের অপ্রীতিকর পরিস্থিতির মুখে পড়তে হয়। এয়ারটেল-রবির বিষয়টি একটু ভিন্ন। এখানে কেউ কাউকে কিনে নিচ্ছে না। দুটো মিলে নতুন আরেকটি নতুন প্রতিষ্ঠান তৈরি করছে। একীভূত হওয়ার পর মালয়েশিয়ার ‘আজিয়াটা গ্রুপ বারহাদও’ জাপানের ‘এনটিটি ডোকোমো’-র কাছে থাকবে প্রতিষ্ঠানটির ৭৫ শতাংশ শেয়ার। বাকি ২৫ শতাংশের মালিকানা থাকবে ভারতীয় এয়ারটেলের। চলমান প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে বরাদ্দ দেয়া তরঙ্গও ব্যবহার করবে একীভূত প্রতিষ্ঠানটি। টুজি ও থ্রিজি লাইসেন্সের আওতায় প্রতিষ্ঠান দুটিকে বিভিন্ন ব্র্যান্ডে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে মোট ৩৯ দশমিক ৮ মেগাহার্টজ তরঙ্গ। এর মধ্যে টুজির তরঙ্গ হিসেবে ৯০০ মেগাহার্টজ ব্র্যান্ডে রবির ৭.৪ ও এয়ারটেলের ৫ মেগাহার্টজ এবং ১৮০০ মেগাহার্টজ ব্র্যান্ডে রবির ৭. ৪ ও এয়ারটেলের ১০ মেগাহার্টজ বরাদ্দ রয়েছে। এছাড়া থ্রিজির তরঙ্গ হিসেবে দুটি প্রতিষ্ঠানকেই ২১০০ মেগাহার্টজ ব্র্যান্ডে ৫ মেগাহার্টজ করে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সঙ্গত কারণেই কয়েকটি প্রশ্ন এখানে এসে গেছে। একটি দেশের দুটি বড় টেলিকম একত্রিভূত হয়ে নতুন আরেকটি কোম্পানি করছে, যেখানে কেউ কারো বাজার মূল্য প্রকাশ করছে না। আমরা জানি, এয়ারটেল মাত্র ১ লাখ ডলার দিয়ে ওয়ারিদকে কিনে ২০১০ সালে বাংলাদেশের বাজারে এসেছিল। যদিও বাংলাদেশে দেখানো হয়েছে বাজারমূল্য মাত্র ১ লাখ ডলার, কিন্তু ২০১০ সালেই আমেরিকার ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল রিপোর্ট করেছিল যে, ভারতীয় ওয়ারটেল ৩০০ মিলিয়ন ডলার দিয়ে ওয়ারিদকে কিনে নিয়েছে (সূত্র : ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল, ১২ জানুয়ারি ২০১০)। কোথায় ১ লাখ ডলার, আর কোথায় ৩০০ মিলিয়ন ডলার! আর এখন সেই প্রতিষ্ঠানটিই কি না রবির সঙ্গে একত্রিভূত হচ্ছে, যেখানে তাদের শেয়ার থাকবে ২৫%! তারপর এই দুটি প্রতিষ্ঠানের জন্মের পর একটিরও অডিট হয়নি। বিটিআরসির এদের অডিট করার কথা। মার্জ হয়ে যাওয়ার পর, সেই অডিট আর কবে হবে! ব্যবসার সুবিধা হলে, তারা মার্জ করুক। কিন্তু এই বেসিক প্রশ্নগুলোর উত্তর তো কোথাও লেখা থাকতে হবে! বাংলাদেশের মানুষকে, বাংলাদেশের সরকারকে, বাংলাদেশের প্রশাসনকে আর কতভাবে এরা বোকা বানাতে চায়, এই প্রশ্নটির উত্তর কি কেউ দেবেন? ॥ তিন ॥ রবি-এয়ারটেল মার্জার হয়ে গেলে আগামীতে বাংলাদেশে মূলত দুটি মোবাইল অপারেটর প্রতিযোগিতা করবে। প্রথমে থাকবে গ্রামীণফোন এবং দ্বিতীয় নম্বরে থাকবে রবি-এয়ারটেল যৌথ প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় স্থানে থাকবে বাংলালিংক। প্রশ্ন হলো, ১২ কোটি সিম বিক্রি করার পর হঠাৎ করেই বাংলাদেশ মার্কেট থেকে টেলিকম অপারেটরগুলো তাদের ব্যবসা সঙ্কুচিত করছে কেন? আগেই বলেছিলাম, একজন পাঠক এটার ভাল একটি উত্তর দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে তাদের ব্যবসা শেষ। কিন্তু কিসের ব্যবসা? অবৈধ ভিওআইপির ব্যবসা। কিভাবে? বাংলাদেশে ভয়েস ব্যবসা শেষের পথে। প্রতি মুহূর্তে এর পরিমাণ কমে আসছে। তবে রাতারাতি এত কমে যায়নি যে, তাদের ব্যবসা গুটিয়ে নিতে হবে। এর আরেকটি কারণ হলোÑ সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন। বর্তমান সরকার সিমকার্ড রেজিস্ট্রেশন বাধ্যতামূলক করে ফেলেছে। ফলে অবৈধ সিমের ব্যবহার শেষ হবে। তাতে মোবাইল অপারেটরদের রেভিনিউ আরও কমে যাবে। সেই পাঠকের প্রশ্ন হলো, টেলিফোন অপারেটররা এতদিন কেন সঠিকভাবে রেজিস্ট্রেশন করে সিমকার্ড বিক্রি করেনি? এটা তো লাইসেন্স নেয়ার প্রথম দিন থেকেই বাধ্যতামূলক ছিল। তবুও তারা সেই নিয়ম মানেনি। পোস্টপেইড সিমের ক্ষেত্রে তারা সঠিক তথ্য নিয়ে সিম রেজিস্ট্রেশন করিয়েছে; কিন্তু প্রি-পেইড সিমের ক্ষেত্রে তারা বিন্দুমাত্র নিয়মকানুন মানেনি। এমনকি যে ফর্মটি পূরণ করতে হয়, সেখানেও ইচ্ছে মতো উল্টাপাল্টা তথ্য দিয়ে রাখা হয়েছে। সেই কারণে শতকরা ৯০% সিমের তথ্য ঠিক নেই। এবং মোবাইল অপারেটররা এটাই চেয়েছিল। যারা অবৈধভাবে ভিওআইপি ব্যবসা করে, তারা ওই সিমগুলো কিনে ব্যবসা করত। তাতে মোবাইল অপারেটরদের লাভ বেশি হতো। এখন আর এই ব্যবসাটা থাকবে না। ভিওআইপি হলো এমন একটি ব্যবসা যারা একবার এর ভেতর ডুকেছেন, তারা আর এর থেকে বের হতে পারেননি। এর থেকে কাঁচা পয়সা আর কোথাও নেই। এখনও যেই চক্রটি এই ব্যবসার সঙ্গে জড়িত, তারাই মূলত বিগত ১৫ বছরের বেশি সময় ধরে নানা উপায়ে ব্যবসাটা করে যাচ্ছেন। কিন্তু সিমকার্ড দিয়ে বড় আকারে এই ব্যবসা করা যায়, তা আমার মাথায় ছিল না। যেখানে রাঘব-বোয়ালরা পুরো এসটিএম (বাংলাদেশে টেলিকম খাতে সবচেয়ে বড় সংযোগ) খুলে এই ব্যবসা করা হচ্ছে, সেখানে এই চুনোপুঁটিরা বেঁচে আছে সেটাই তো বিশাল বড় সংবাদ। তবুও পাঠকের এই তথ্য একটি অংশে সত্য হতে পারে। নইলে কেন একটি অপারেটরও গ্রাহকের তথ্য সঠিকভাবে নিয়ে সংযোগ প্রদান করেনি? কিছু গ্রাহকের তথ্য ভুল থাকতে পারে। কিন্তু শতকরা ৯০ ভাগ গ্রাহকের তথ্যই ভুয়া, এটা কোন শিল্পে হতে পারে? বাংলাদেশের মোবাইল খাতে যেটা হয়েছে তাহলো, বাংলাদেশের গ্রাহকদের কেউ নিজেদের গ্রাহক মনে করেনি। তাই গ্রাহকের সঠিক তথ্য রাখার প্রয়োজন বোধ করেনি। এই দেশের গ্রাহকদের ব্যবহার করে তারা এখন চলে যাচ্ছে। যদি এই দেশের গ্রাহকদের তারা কেয়ার করত, তারা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করত, তাহলে তাদের এটিচিউড ভিন্ন হতো। এই যে বাংলালিংকের কর্মীরা আজ মাঠে নেমেছেন, আর তারা ৭০০-এর মতো কর্মীকে ছাঁটাই করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ হলো এই প্রতিষ্ঠানটি কখনই বিটিআরসির নির্দেশনা মানেনি, তোয়াক্কা করেনি। তারা একবার গ্রাহকের প্রায় ১০০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছিল এবং বিটিআরসি বার বার বলার পরেও সেই টাকা ফেরত দেয়নি। এই যে গায়ের জোরে ব্যবসা করা, এই সুবিধা আর কোথায় পাওয়া যাবে? ॥ চার ॥ অবস্থা যেদিকে যাচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, আগামীতে বাংলাদেশে মূলত দুটি মোবাইল অপারেটর প্রতিযোগিতা করবে। প্রথমে থাকবে গ্রামীণফোন এবং দ্বিতীয় নম্বরে থাকবে রবি-এয়ারটেল যৌথ প্রতিষ্ঠান। তৃতীয় স্থানে থাকবে বাংলালিংক। এই টেলিকম প্রতিষ্ঠানগুলোর দিকে ভাল করে তাকালে দেখা যাবে, এরা মূলত মার্কেটিং কোম্পানি। সারাক্ষণ প্রচুর বিজ্ঞাপন দিয়ে তাদের পণ্যকে বিক্রি করার চেষ্টা, আর নানা ধরনের চটকদার অফার। একটা দুটো নয়, শত শত অফার। একটা সময়ে এদের অফার এমনি ছিল যে, সারারাত ধরে এই দেশের তরুণ-তরুণীরা মোবাইলে কথা বলেছে। কারণ, তাদের অফারগুলো তেমনি ছিল। এই দেশের মানুষকে এরা ডিজুস শিখিয়েছে, ভুল বাংলা প্রচলন করিয়েছে, দেশের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করেছে। এখনও একই কাজ করে যাচ্ছে। এরা বাংলাদেশে ইন্টারনেট প্রচলন করতে যাচ্ছে, কিন্তু দেখুন তাদের বিক্রি করার সিস্টেম। পাশাপাশি বিজ্ঞাপনগুলোও খেয়াল করুন। দেখে মনে হবে, এই গ্রহে ইন্টারনেটের জন্ম হয়েছে শুধু ফেসবুক ব্যবহার করার জন্য। এরা ফেসবুক বিনামূল্যে ব্যবহার করতে দিচ্ছে, শেয়ার করা, লাইক করা ইত্যাদি বিষয়গুলোকে বিনামূল্যে ছেড়ে বিশাল বিলবোর্ড আর ক্যাম্পেইন করছে। পুরো তরুণ প্রজন্মকে ফেসবুকে আসক্ত করাচ্ছে। কিন্তু খেয়াল করেছেন, কোন শিক্ষামূলক কার্যক্রমকে বিনামূল্যে দিচ্ছে না। আমি ফেসবুক ব্যবহারের বিপক্ষে নই। কিন্তু এরা এমনভাবে ফেসবুককে বাংলাদেশে প্রোমোট করছে যে, এটা ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। এবং আসলেই নেই। সেটা বলার জন্যই এতটা ভূমিকা লিখলাম। বাংলাদেশের টেলিকম কোম্পানিগুলো এই দেশে এসেছিল বর্গী হয়ে, লুটেরা হয়ে। তারা এই দেশে দীর্ঘমেয়াদী কোন পরিবর্তন কিংবা উন্নয়ন মাথায় নিয়ে নামেনি। এর সবচেয়ে বড় প্রমাণ হলোÑ এরা কখনই ইনোভেটিভ ছিল না। আপনি একটি উদাহরণ দেখাতে পারবেন, যেখানে এই টেলিকমগুলো বাংলাদেশের কোন সমস্যার সমাধান করেছে? একটি মাত্র উদাহরণ দিন তো? আমি বলতে চাইছি, প্রযুক্তিগত উদাহরণ। যে শিল্পের সামান্যতম ইনোভেশন নেই, সেই শিল্প দীর্ঘমেয়াদী বাঁচে কিভাবে? এদের ইনোভেশন আছে বিজ্ঞাপনে, মানুষকে ঠকিয়ে টাকা বানানোর কায়দায়, হাজারটা অফার দিয়ে আপনাকে বোকা বানানোর চেষ্টায়, আপনার অনুমতি না নিয়েই বিভিন্ন ধরনের প্যাকেজে সাবস্ক্রিপশন করে টাকা হাতিয়ে নেয়ায় এবং সরকারের সিদ্ধান্তকে কোর্টে গিয়ে আটকে রেখে দীর্ঘসূত্রিতা করার, সরকারের টাকা না দেয়ার ফন্দি করার। এর বাইরে আমাকে আর একটি ভাল উদাহরণ দিন, যা দিয়ে বোঝা যাবে এরা এই দেশের মানুষের কল্যাণে কোন কিছু করেছে? বাংলাদেশে ইন্টারনেট এসেছে সেই ১৯৯৪/৯৫ সালের দিকে, গত শতাব্দীতে। তখন এই দেশে ইন্টারনেট নিয়ে অনেক লাফালাফি হয়েছে। এদের কা-কারখানা দেখলে মনে হবে, ইন্টারনেটের জন্মই বুঝি সেদিন হয়েছে অনেকটা তাদের হাতে। দেশের মানুষকে এমন বোকা ভাবলে তো বিপদ। এরা বরং ইন্টারনেটকে ভিন্ন স্তরে নিয়ে যেতে পারত। ইন্টারনেটের সঠিক ব্যবহারে এই দেশের মানুষকে অভ্যস্ত করাতে পারত। কিন্তু এদের যাবতীয় কার্যক্রম আটকে গেছে ফেসবুকে। যে শিল্পের মানুষরা একটি দেশ থেকে এত কিছু নিল, হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে গেল, আর সেই দেশের মানুষকে তৈরি করল না, এটা থেকেই বোঝা যায় তারা এই মার্কেটের প্রতি কমিটেড ছিল না। আর যারা কোন মার্কেটের প্রতি কমিটেড থাকে না, তাদের পরিণতি এই হয়। এরা সাধারণত মার্কেট থেকে দ্রুত টাকা নিয়ে সটকে পড়ে। বাংলাদেশের টেলিকম সেক্টরে হচ্ছেও তাই। সবাই তাদের টাকা নিয়ে সরে যাচ্ছে। ॥ পাঁচ ॥ গত সপ্তাহে ভারতের ‘দি হিন্দু’ পত্রিকার অনলাইন সংস্করণ পড়ছিলাম। সেখানে একটি তথ্যে চোখ আটকে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংকের বরাত দিয়ে সেখানে দেখানো হয়েছে, বাংলাদেশের পার্শ্ববর্তী কোন দেশ বাংলাদেশে কত বিনিয়োগ করেছে। সেখানে দেখা যায় ভারত ২০১০ সালে বিনিয়োগ করেছিল মাত্র ৪৩ মিলিয়ন ডলার, ২০১১ সালে সেটা কমে গিয়ে দাঁড়ায় ২৫ মিলিয়ন ডলার, ২০১২ সালে ২৮ মিলিয়ন ডলার, ২০১৩ সালে ৪৫ মিলিয়ন ডলার এবং ২০১৪ সালে ৬৭ মিলিয়ন ডলার। (অথচ ২০১৪ সালেই পাকিস্তান বাংলাদেশে বিনিয়োগ করেছে ১৩০ মিলিয়ন ডলার, আর চীন করেছে ৪৩ মিলিয়ন ডলার।) এর থেকেই বোঝা যাচ্ছে এয়ারটেল বাংলাদেশে কত বিনিয়োগ করতে পারে। উল্লেখ্য, ২০১৪ সালে ভারত সারা বিশ্বে ৫২ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। এদিকে ২০০৮ সালে ৩৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বিনিময়ে এ কে খান গ্রুপ তাদের ৩০ ভাগ শেয়ার জাপানের এনটিটি ডোকোমোর কাছে বিক্রি করে দেয়। তারপরেই রবি (তথা একটেল) পুরোটাই বিদেশীদের হাতে চলে যায়। বাংলাদেশের বড় চারটি মোবাইল অপারেটরই পুরোপুরি বিদেশীদের নিয়ন্ত্রণে। বিদেশী কোম্পানি হিসেবে এদের ফরেন ডিরেক্ট ইনভেস্টমেন্ট (এফডিআই) করার কথা থাকলেও এরা সবাই স্থানীয় ব্যাংকগুলো থেকে ঋণ নিয়েছে। অনেকটা কই-এর তেলে কই ভাজা যাকে বলে। তারপরেও আমরা কিভাবে আশা করি, তারা আমাদের দেশের উপকার করবে? এটা কি একটু বেশি আশা করা নয়? সবকিছুর শেষে যদি কিছু বলতে হয় তাহলে এটুকু বলতেই হয় যে, বাংলাদেশে টেলিকম খাতে যে ধস নামছে তার মূল কারণ হলো এই শিল্পের উদ্ভাবনী শক্তির অভাব। তারা নিজেদের একটি অনিয়ন্ত্রান্তিক ভয়েস কেন্দ্রিক ব্যবসার জন্য প্রস্তুত করেছিল। তারা দীর্ঘমেয়াদী কোন সুশৃঙ্খল ব্যবসার জন্য পরিকল্পনা করেনি। সে কারণে তারা সামান্য ‘সিঙ্গেল নম্বর পোর্টাবিলিটি’ পর্যন্ত করেনি। এই ধস অবধারিত ছিল। এর দায়ভার তাদের নয়, আমাদের। আমরা তাদের এখানে ব্যবসা করে গুটিয়ে যাওয়ার পথ করে দিয়েছি। সামনে আর কী দেব, সেটুকুই দেখার বাকি! ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬ লেখক : তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ এবং সম্পাদক, প্রিয়.কম [email protected]
×