ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

দুই সৎ ভাই খুন ॥ হবিগঞ্জে চার শিশুকে হত্যার পর কুমিল্লায় নৃশংসতা

প্রকাশিত: ০৫:০৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

দুই সৎ ভাই খুন ॥ হবিগঞ্জে চার শিশুকে হত্যার  পর কুমিল্লায় নৃশংসতা

মীর শাহ আলম, কুমিল্লা ॥ পূর্বশত্রুতার রোষানলের হাত থেকে রক্ষা পাচ্ছে না কোমলমতি শিশুরাও। অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের ওপর রোমহর্ষক নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। হবিগঞ্জের বাহুবলে পূর্বশত্রুতার জের ধরে চার শিশুকে হত্যার পর এবার কুমিল্লায় বৈমাত্রেয় ভাইয়ের হাতে খুন হতে হলো দুই সহোদর শিশুকে। হত্যা বা পৈশাচিক নির্যাতনের শিকার হওয়া শিশুরা জানেও না কী তাদের অপরাধ? অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি অপরাধীদের এক ধরনের মানসিক বিকৃতির লক্ষণ। পাশাপাশি শিশুদের পবিবার বা পিতামাতাকে মানসিকভাবে চিরদিনের জন্য দুর্বল করে দেয়ার কৌশল। শনিবার বিকেল সাড়ে তিনটার দিকে কুমিল্লা সদরের দক্ষিণ উপজেলাধীন দক্ষিণ রসুলপুরের ঢুলিপাড়ায় নৃশংস এ হত্যাকা-ের ঘটনা ঘটে। মেহেদী হাসান জয় ও মেজবাউল হক মনি নামের সহোদর দুই ভাইকে গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হত্যার অভিযোগ উঠেছে নিহতদের বৈমাত্রেয় (সৎভাই) ভাই মোঃ আল শফিউল ইসলাম ছোটনের বিরুদ্ধে। ছোটন ঢাকার বেসরকারী ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির বিবিএ (ব্যাচেলর অব বিজনেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন) শেষবর্ষের ছাত্র। সে ব্যবসায়ী আবুল কালামের প্রথম স্ত্রীর সন্তান। নিহতদের পিতা আবুল কালাম জানান, পারিবারিক কলহের জের ধরে তার প্রথম স্ত্রী রোকেয়া বেগমের ছেলে ছোটন দ্বিতীয় স্ত্রী ও তার সন্তানদের ওপর ক্ষিপ্ত। তার জের ধরে ছোটন সুযোগ বুঝে বাড়িতে অবস্থান করতে থাকে। শনিবার বিকেল সাড়ে ৩টায় স্থানীয় হলিচাইল্ড প্রি-ক্যাডেট স্কুলের প্রথম শ্রেণীর ছাত্র মেহেদী হাসান জয় (৭) ও একই স্কুলের নার্সারি শ্রেণীর ছাত্র মেজবাউল হক মনি (৫) প্রতিদিনের মতো বাড়িতে ফিরে। সে সময় বাড়িতে তেমন কেউ ছিল না। ছোটন তাদের দুই ভাইকে ঘরে ডেকে নিয়ে যায়। ঘরে নিয়ে খেলার ছলে দরজা আটকায়। এরপর দুই ভাইয়ের মুখ বাঁধে। পরে তাদের গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। হত্যার পর লাশ ঘরের খাটের উপর রেখে দরজায় তালা লাগিয়ে পালিয়ে যায়। ঘটনার সময় ব্যবসায়ী আবুল কালাম দ্বিতীয় স্ত্রী রেখা বেগমকে নিয়ে কুমিল্লা সদরের ব্রাহ্মণপাড়া উপজেলার ভাল্লক গ্রামে শাশুড়ির চেহলাম অনুষ্ঠানে ছিলেন। প্রথম স্ত্রীর ছোট মেয়ে তানজিনা মোবাইল ফোনে জয় ও মনির মৃত্যুর খবর জানায়। পরে তিনি স্ত্রীসহ বাড়িতে ছুটে আসেন। জানা গেছে, আবুল কালামের প্রথম স্ত্রী রোকেয়া বেগমের ৩ কন্যা ও এক পুত্রসন্তান রয়েছে। এদের মধ্যে আইরিন আক্তার ও তাহমিনা আক্তারের বিয়ে হয়েছে। ছেলে মোঃ আল শফিউল ইসলাম ছোটন। ছোট মেয়ে সুফিয়া আক্তার তানজিনা স্থানীয় নেউরা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে। দ্বিতীয় স্ত্রী রেখা বেগমের নিহত দুই সন্তানই ছিল। স্থানীয়রা বলছেন, পারিবারিক কলহ এবং সম্পত্তির লোভে এ নৃশংস খুনের ঘটনা ঘটে থাকতে পারে। সম্প্রতি আবুল কালাম তার দ্বিতীয় স্ত্রী ও নিহত দুই শিশু ছেলের নামে ১৭ লাখ টাকায় জমি ক্রয় করেন। এতে প্রথম স্ত্রীর ছেলে আল শফিউল ইসলাম ছোটন ক্ষিপ্ত হয়। এমন ঘটনার সূত্র ধরেই ছোটন হত্যাকা-টি ঘটিয়ে থাকতে পারে। খবর পেয়ে কুমিল্লার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলী আশরাফ ভূঁইয়া, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মোঃ আজিজুর রহমান, সদর দক্ষিণ মডেল থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ আইয়ুবসহ পুলিশ ও র‌্যাবের কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে যান। পুলিশ ঘটনাস্থল থেকে তাদের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য কুমিল্লা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল মর্গে প্রেরণ করে। নৃশংস এ ঘটনায় এলাকায় সর্বস্তরের জনগণের মাঝে শোকের ছায়া নেমে এসেছে। মা ও স্বজনদের আহাজারিতে সেখানকার আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোঃ আলী আশরাফ ভূঁইয়া জানান, পারিবারিক কলহের জের ধরে এ ঘটনা ঘটেছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে। ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতারে চেষ্টা চলছে। অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। আরও অনেককেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। ময়নাতদন্তের পর শিশুদের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যাবে। তবে প্রাথমিকভাবে শিশুদের গলায় রশি পেঁচিয়ে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। কারণ শিশুদের গলায় রশির দাগ রয়েছে। গত ১২ ফেব্রুয়ারি হবিগঞ্জের বাহুবলের সুন্দ্রাটিকি গ্রাম থেকে চার শিশুকে তুলে নিয়ে হত্যার পর হবিগঞ্জসহ দেশ-বিদেশে আলোচনার ঝড় বইতে থাকে। নিহত স্কুলছাত্র শুভ, তাজেল, মনির ও মাদ্রাসাছাত্র ইসমাইলকে নির্মমভাবে হত্যার ঘটনায় ফুঁসছে গোটা দেশ। এমন ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই আবারও দুই সহোদরকে হত্যার ঘটনা রীতিমতো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে। সারাদেশ যেন ক্ষোভে ফুঁসছে। গত বছর ৮ জুলাই সিলেটে শিশু রাজনকে খুঁটির সঙ্গে বেঁধে নৃশংসভাবে পিটিয়ে হত্যার ঘটনা ঘটে। পিটিয়ে আহত করার সেই দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সারাদেশে ব্যাপক আলোচনার জন্ম হয়। এ ঘটনার তদন্ত শেষে ১৩ জনকে আসামি করে আদালতে চার্জশীট দাখিল করে পুলিশ। আসামিদের মধ্যে ১০ জনকে আগেই গ্রেফতার করে আদালতে সোর্পদ করা হয়। ঘটনার ২ দিন পর মামলার অন্যতম আসামি কামরুল ইসলাম জেদ্দায় পালিয়ে যায়। প্রবাসী বাংলাদেশীরা সেখানে কামরুলকে আটক করে সে দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে সোর্পদ করে। গত বছর কামরুলকে ইন্টারপোলের মাধ্যমে দেশে ফেরত আনা হয়। এর আগে খুলনায় শিশু রাকিবকে পায়ুপথে বাতাস দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। শিশু রাজন ও রাকিবের মামলার বিচার হয়েছে। কয়েকজনকে দ্রুততার সঙ্গে ফাঁসির দ-াদেশ দিয়েছে আদালত। শুধু শিশুরা নয়, এমন নির্মম পৈশাচিক হত্যাকা-ের শিকার হচ্ছে কিশোররাও। গত বছরের ১১ এপ্রিল গরুচোর ভেবে চার ঘণ্টার নির্যাতনের পর হাত-পা বেঁধে রাজধানীর দক্ষিণখান থানাধীন এলাকা দিয়ে বয়ে যাওয়া কালীগঞ্জের বালু নদীতে ফেলে দিয়ে কিশোর নিজাম উদ্দিনকে হত্যা করা হয়। ঘটনার পাঁচ দিন পর নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ থানা-পুলিশ নিজাম উদ্দিনের গলিত লাশ অজ্ঞাত হিসেবে নদী থেকে উদ্ধার করে। নিজাম উদ্দিনের পরিচয় শনাক্ত হওয়ার পর বেরিয়ে আসে নিজাম উদ্দিন হত্যারহস্য। এ ঘটনায় ঢাকার সিআইডি পুলিশ সাতজনকে গ্রেফতার করেছে। সম্প্রতি শিশু বা কিশোরদের ওপর নির্যাতন বা অধিকহারে শিশু হত্যাকা-ের শিকার হওয়ার বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলছেন, সমাজব্যবস্থায় পরিবর্তন আসছে। মানুষের সক্ষমতা বাড়ছে। একটি সমাজ যখন উন্নত সামাজিক ব্যবস্থার দিকে প্রবেশ করতে থাকে, তখন সামাজে বেশকিছু বিষয়ে পরিবর্তন আসতে থাকে। তার মধ্যে অন্যতম মানুষের আর্থিক সক্ষমতা। মানুষ আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছে। চাহিদা আরও বাড়ছে। পরিবর্তিত সমাজব্যবস্থায় যারা পিছিয়ে থাকে তাদের মধ্যে জেদ, মন কষাকষি, ক্ষোভ, না পাওয়ার আকুতি, আফসোসসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা দেখা দেয়। ফলে অনেক মানুষই নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করে ফেলার চেষ্টাও করে থাকে, যা অনেক সময়ই সঠিকভাবে হয় না। অযৌক্তিক কারণে এসব চাহিদা অনেকেই অর্জন করার চেষ্টা করে। বেশিরভাগ সময় অপরাধের মাধ্যমে অনেকেই এসব অর্জন করার চেষ্টা করে। যার পরিণতি মারাত্মক অপরাধ। এছাড়া প্রতিপক্ষকে মানসিকভাবে দুর্বল করে দিতেও জেদ বা রাগের বশবর্তী হয়ে পরিকল্পিতভাবে শিশু নির্যাতন বা হত্যাকা-ের মতো মারাত্মক সব অপরাধ করে থাকে। এসব ক্ষেত্রে অনেক সময়ই শিশুরা শিকারে পরিণত হয়।
×