ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সিডনির মেলব্যাগ ॥ অজয় দাশগুপ্ত

পাক-ভারতের বিষয়ে সাবধানতার বিকল্প নেই

প্রকাশিত: ০৩:৪২, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পাক-ভারতের বিষয়ে সাবধানতার বিকল্প নেই

হংকং হয়ে ভারতে গিয়েছিলাম। হংকং চীনের কাছে চলে যাওয়া ব্রিটিশশাসিত দেশ; কিন্তু এখনও তার গায়ে ব্রিটিশ রাজত্বের ছাপ। একটা সময় ছিল যখন মুক্ত হওয়া মানেই ছিল সবকিছু উপড়ে ফেলে অন্য ধরনের হয়ে যাওয়া। নাম-নিশানা, বর্ণ-গন্ধ মুছে স্বাধীন হওয়ার কারণও থাকে বৈকি। যেমন ধরুন আমাদের স্বাধীনতা। এখনও পাকি ভূত আর পাকিদের নীরব ও পরোক্ষ অস্তিত্বের কারণে মুক্তি খুঁজে নিতে পারেনি। উপমহাদেশের বিপদসঙ্কুল পাকিস্তান নিজের ঘরের আগুন না নিভিয়ে পরের ঘরের আগুনে ইন্ধন দিতে ব্যস্ত। হংকং এক সময় ব্রিটিশদের অধীনে থাকায় তার গায়ে আধুনিকতার ছোঁয়া। চীনের সমাজতন্ত্র, কঠিন পরিশ্রমী মানুষের আয়-উপার্জন ও বুদ্ধি সে দেশকে এগিয়ে রাখলেও স্বাধীনতা দেয়নি। মানুষ সেখানে মুখ খুলতে পারে না, মানুষের কষ্ট বা দুঃখের কথা বলতে পারে না মন খুলে। বিধিনিষেধের বেড়াজালে থাকা মানুষের উন্নয়নও সীমাবদ্ধতা। অন্যদিকে হংকং এখনও অবরুদ্ধ নয়। কিন্তু মূল তফাতটা হলো ছেড়ে যাওয়া পরাশক্তি বা নতুন মালিক চীনারা কেউই তাকে নিয়ে ষড়যন্ত্রে মত্ত নয়। অন্যদিকে ব্রিটিশ চলে যাবার এত বছর পরও ভারত-পাকিস্তানের উন্মাদনা হ্রাস পায়নি। উভয়ের সীমান্তে পতাকা পরিবর্তনের মহড়া দেখে আমি নিশ্চিত কারও দিক থেকে এই উত্তেজনা হ্রাসের উদ্যোগ নেই। আমাদের গাড়ির ড্রাইভার ও গাইড শিখ যুবকদ্বয় বেশ লেখাপড়া জানা। ড্রাইভারটিকে আমার গাইডের চাইতেও বুদ্ধিমান মনে হয়েছে। শপিংমলে ড্রাইভার যুবকটির সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিয়েছিলাম। সে আমাকে বলল, পাঞ্জাবের অবস্থা জটিল। এদিক থেকে ফেনসিডিল আর সস্তা ভারতীয় মাদক যায় আর ওদিকে থেকে আসে বিদেশী যত ড্রাগস, কোকেন, হেরোইন, গাঁজাÑ কিছুই বাদ যায় না। তার আফসোসটাও জটিল ধরনের। চরিত্র নষ্ট বা যুবকদের জীবন ধ্বংস নিয়ে যতটা চিন্তিত নয় সে, তার ভয় এভাবে মাদকনির্ভর হয়ে পড়লে পাঞ্জাবি ভারতীয়রা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে জং লড়তে পারবে না। ফলে যুদ্ধে জয়টা কঠিন হয়ে উঠবে। আমার তো আক্কেল গুড়ুম। পরে অহরহ আসতে যেতে থাকে পাক ট্রাক, বাস, লরির কিছু মানুষেরও দেখা মিলেছিল। এরা কিঞ্চিৎ উগ্র তবে দিলদার। কয়েক শ’ রুপী বকশিশ দিয়ে ভারতের রাজ্যভিত্তিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা বেষ্টনী পেরিয়ে যাওয়া যায়। বকশিশ বা ঘুষ পাওয়া চেকার কিংবা রক্ষীরা খুলেও দেখে না বাক্সে কি খাবার, না হাতবোমা, না অন্য কিছু। ভাবছিলাম আমাদের সৌভাগ্য এদের সঙ্গে স্থল সীমান্ত নেই। আমরা অনেক দূরে থাকি বলে নানাভাবে নিরাপদ। না পারে মাদক, না জঙ্গী ঢুকিয়ে দিতে। আমার তো মনে হয়েছে ভারতকে এর মাসুল দিতে হবেই। আরেকটা বিষয় লক্ষণীয়Ñ উপমহাদেশের রাজনীতি এখনও তার অখ- ভারতের ধারাবাহিকতা মেনে চলছে। সেই হিন্দু মুসলমান, সেই সাম্প্রদায়িকতা, একে অপরের তোষণ অথবা শোষণ, পাঞ্জাব দিল্লী জয়পুর গয়ার পর কলকাতা এসে মনে হয়েছে এখানে সময় কেমন ছিল। একটা কথা মানি, গণতান্ত্রিক দেশ ও সার্বিক উন্নতির অংশীদার বলে এরাও ভারতের সঙ্গে স্থিত ও চলমান। সমাজ স্থিত, অর্থনীতি প্রবহমান। কিন্তু আমাদের মতো কর্মযজ্ঞ নেই কোথাও। আমরা অস্থির, কলহপ্রবণ ও রাজনীতিতে অসহিষ্ণু বটে; কিন্তু জাতির রক্তে আছে কর্মচাঞ্চল্য। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও মমতা ব্যানার্জীর তুলনায় শেখ হাসিনা একশ’ কদম এগিয়ে। সুবেশী, প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ প্রধানমন্ত্রী আমাদের। এমনকি এখন এখানে যারা নেতা তারাও পিছিয়ে। একুশের দিন আনন্দবাজারে চোখ বুলিয়েছিলাম। সম্পাদকীয় পাতায় একটি মাথাভারি নিবন্ধ ব্যতীত কোথাও কোন খবর ছিল না। অথচ এদের অনেকেই একুশের চেতনার অংশীদার হতে ইচ্ছুক। একুশের চেতনা বা কৃতিত্ব বাঙালীর অর্জন। সেটা এদের সরকারী মহল চাপের মুখে স্বীকার করে নিলেও কোন দায় নেই তাদের। তারুণ্য বা নতুন প্রজন্মের কাছে একুশে বড় অচেনা। সৌরভ গাঙ্গুলীকে দেখলাম লাইভ শোতে প্রশ্ন করেছিলেন এ নিয়ে। যেমন প্রশ্ন তেমনি তার উত্তর। কেউ তো বলতে পারলই না, স্বয়ং প্রশ্নকর্তা যা বললেন তাও গোলমেলে। তার মতে একুশে নাকি মুক্তিযুদ্ধের ফসল। কোন্টি কিসের ফসল বা কে জননী কে সন্তান সেটাও গুলিয়ে ফেলেছেন এরা। এটা কিন্তু না জানার দোষ নয়, এ হচ্ছে উপেক্ষা। একুশের বুকভরা অহঙ্কার আমাদের। দাদারা ভাগ নিলেও যা না নিলেও তা। তবু তারা বাংলাভাষী। বাংলা সংস্কৃতির কিছুটা তাদের অবদানে সমৃদ্ধ। ঐতিহ্য অতীতে একক, অভিন্ন। কিন্তু তাদের মুখ্যমন্ত্রী একটা মূর্তি উন্মোচন করে যেমন ভাবেন কাজ শেষ, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীরও ভাবনায় বাংলা তেমন গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। সব মিলিয়ে আমার মনে হয়েছে পাকিস্তান ও ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক নির্ধারণ ও উন্নয়ন বা অবনতির ব্যাপারে সতর্ক থাকা প্রয়োজন। একতরফা বন্ধু বা শত্রু ভাবার দিন শেষ। বিশেষত কোন জাতি যখন তার মাথা উঁচু করে বাঁচতে চায় বা আগের অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে সামনে এগোয় প্রতিবেশীরা তার উন্নতিতে বাগড়া না দিলেও খুব একটা খুশি হয় না। পাছে সে তাদের ফেলে এগিয়ে যায়। তবে একটা বিষয় শেখার আছেÑ নিয়ম, গণতান্ত্রিকতা আর এরা বিশ্বাস করে সেটা রক্তের স্রোতের বাইরেও প্রবহমান। তাই এখন কংগ্রেসের কলিকাল। নতুন নেতৃত্ব ও যোগ্যতা নিরূপণে এদের ভাবনাকে নেয়া ব্যতীত বাকি বিষয়ে সাবধানতাই আমাদের রক্ষাকবচ।
×