ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বিপিসি ও তেল বিপণন কোম্পানিতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৩, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিপিসি ও তেল বিপণন কোম্পানিতে স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ

রশিদ মামুন ॥ বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশন (বিপিসি) এবং তেল বিপণন কোম্পানি পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনার আর্থিক স্বচ্ছতা ফিরিয়ে আনতে কঠোর হচ্ছে সরকার। দুর্বল নিরীক্ষার সুযোগে জ্বালানি তেল আমদানি এবং বিপণন পর্যায়ে আর্থিক অস্বচ্ছতার অভিযোগ থাকায় জরুরীভিত্তিতে বিপিসি এবং বিপণন কোম্পানিতে আর্থিক পরামর্শক নিয়োগের নির্দেশ দিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। জ্বালানি বিভাগ মনে করছে এখন তেলের আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বাজারে বিক্রয়মূল্যের পার্থক্যে বিপিসি লাভ করছে। আগে সরকার জ্বালানি খাতে ভর্তুকি দিয়েছে এখন তেল বিক্রি থেকে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে বিপুল পরিমাণ অর্থ জমা হচ্ছে। বিগত ২০১৪ সালের জুন থেকে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম অব্যাহতভাবে কমতে শুরু করে। এই পুরো সময় জ্বালানি তেলে লাভ করেছে বিপিসি। বিপিসি তাদের প্রতিবেদনে জানিয়েছে ২০১৪-১৫ অর্থবছরে জ্বালানি তেল বিক্রিতে তারা লাভ করেছে ১০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। আর জ্বালানি তেলের বর্তমান দামে বিপিসি চলতি অর্থবছরে মুনাফা করবে ১২ হাজার কোটি টাকা। খোদ বিপিসির হিসাব বলছে ৬৮ টাকা প্রতি লিটার ডিজেল এবং কেরোসিন বিক্রি করে বিপিসি সরকারকে ভ্যাট-ট্যাক্স দেয়ার পরও ২৬ থেকে ২৭ টাকা লাভ করছে। প্রতি লিটার ফার্নেস অয়েল ৬০ টাকায় বিক্রি করে একই পরিমাণ লাভ হচ্ছে। অন্যদিকে পেট্রোল ৯৬ টাকা আর অকটেন ৯৯ টাকায় বিক্রি করে লাভ করছে ৩৬ থেকে ৩৭ টাকা। সঙ্গত কারণে বিপুল এ মুনাফার সঠিক হিসাব রাখা জরুরী বলে মনে করছে সরকার। জানা গেছে, বিপিসি দুর্বল নিরীক্ষা বিভাগ ও অস্বচ্ছ আয়-ব্যয়ের মধ্য দিয়ে চলছে। বেসরকারী পর্যায়ে কোন প্রতিষ্ঠানে এক হাজার কোটি টাকার বেশি টার্নওভার হলেই একাধিক প্রতিষ্ঠানকে দিয়ে নিরীক্ষা করানোর পাশাপাশি শক্তিশালী হিসাব বিভাগ থাকার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু ৩৫ হাজার কোটি টাকার বেশি লেনদেন হলেও বিপিসি এবং তেল বিপণন কোম্পানিতে তা নেই। জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, আমরা বিপিসিকে আর্থিক পরামর্শক নিয়োগ দিতে বলেছি। এক্ষেত্রে তাদের অভিজ্ঞতা মন্ত্রণালয় থেকে নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। বিপিসি ওই অনুযায়ী একটি গাইড লাইন তৈরি করে মন্ত্রণালয়ে জমা দেবে। ওই গাইড লাইনটি সরকার অনুমোদন করলে পরামর্শক নিয়োগ দিতে হবে। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আর্থিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বিপিসিতে একটি অডিট বিভাগ থাকলেও তা কার্যকর নয়। অভিযোগ রয়েছে, জ্বালানি তেল ক্রয়-বিক্রয়, পরিবহন ও জাহাজ ভাড়ায় অনিয়ম করতেই দীর্ঘদিন ধরে প্রতিষ্ঠানটির অডিট বিভাগকে দুর্বল করে রাখা হয়েছে। প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক আয়-ব্যয়, লাভ-লোকসানের আর্থিক বিবরণীও তৈরি করে না এ বিভাগ। বাইরের নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান (সিএ ফার্ম) দিয়ে বছর শেষে এটি তৈরি করা হয়। অর্থবছর শেষে বহিঃনিরীক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটির অডিট করার কথা থাকলেও গত তিন বছরেও তা করা হয়নি। সম্প্রতি বিপিসিকে দেয়া জ্বালানি বিভাগের উপসচিব আকরামুজ্জামান স্বাক্ষরিত পত্রে দেখা যায়, বিপিসির পরামর্শকদের আন্তর্জাতিকভাবে জ্বালানি তেলের মূল্য নির্ধারণে অভিজ্ঞতা থাকার পাশাপাশি অন্তত ১০ বছরের আর্থিক বিষয় পর্যালোচনা এবং আর্থিক পুনর্গঠন বিষয়ে অভিজ্ঞতা থাকার কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে ওই চিঠিতে বলা হয়েছে পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র আর্থিক পরামর্শক নিয়োগ দিতে হবে। এক্ষেত্রে কোন প্রতিষ্ঠানকে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেয়া যাবে না। বিপিসির হিসাব ও অডিট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আপত্তি জানিয়ে আসছে অর্থ মন্ত্রণালয়, কম্পট্রোলার এ্যান্ড অডিটর জেনারেলের (সিএজি) কার্যালয়। এর আগে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) বিদেশী প্রতিষ্ঠান দিয়ে বিপিসির অডিট করানোর জন্য সরকারকে চাপ দিলেও তা কাজে আসেনি। সিএজি তাদের ২০১৩-১৪ অর্থবছর এমনকি ২০১৪-১৫ অর্থবছরে বিপিসির আর্থিক অনিয়মের কথা বলছে। সিএজি সূত্রমতে, শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা বিভাগ না থাকায় স্বচ্ছ নিরীক্ষা ছাড়াই সব আয় ও ব্যয়ের বিল পাস হচ্ছে। ফলে বিপিসির সব ধরনের লেনদেন ও হিসাবনিকাশে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা থাকছে না। প্রতিষ্ঠানটির মতে, বিপিসির আওতাধীন পদ্মা, মেঘনা এবং যমুনা তেল বিপণন কোম্পানির বার্ষিক হিসাবের সঙ্গে বিপিসির হিসাব আট বছর মিলিয়ে দেখা হয়নি। কোম্পানিগুলোর হিসেবের সঙ্গে বিপিসির হিসাবে অস্বাভাবিক ও মাত্রাতিরিক্ত গরমিল রয়েছে। মন্ত্রণালয় বলছে, এখন লাভ হওয়ায় কোম্পানিগুলোর সিএআর তহবিলে প্রচুর অর্থ জমা হচ্ছে। এই অর্থ কিভাবে কোথায় খরচ করা হচ্ছে তাও জানানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিপণন কোম্পানির কাজে গতি আনতে তেল পরিবহন, বিতরণ এবং নিরাপত্তায় আন্তর্জাতিক মানের পরামর্শক নিয়োগ দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
×