ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ঘটনার রহস্য উন্মোচন ॥ হত্যাকা-ে ব্যবহৃত চাপাতি ও পিস্তল উদ্ধার

পঞ্চগড়ে পুরোহিত হত্যার হোতাসহ ৩ জেএমবি জঙ্গী আটক

প্রকাশিত: ০৫:৩১, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পঞ্চগড়ে পুরোহিত হত্যার হোতাসহ ৩ জেএমবি জঙ্গী আটক

এ রহমান মুকুল, পঞ্চগড় থেকে ॥ দেবীগঞ্জের শ্রীশ্রী গৌড়ীয় মঠের পুরোহিত মহারাজ যজ্ঞেশ্বর রায়কে গলা কেটে নৃশংসভাবে হত্যার ঘটনায় মূল হোতাসহ তিন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। এদের নীলফামারীর ডিমলা ও পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা সকলেই জেএমবি সদস্য। আটক জেএমবি সদস্যদের মধ্যে পুরোহিত হত্যায় সরাসরি জড়িত মূল হোতাও রয়েছে। এর আগে ২১ ফেব্রুয়ারি পুরোহিত হত্যাকা- ঘটনার পর গ্রেফতার হওয়া দুই জেএমবি সদস্য ও এক শিবিরকর্মীকে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তাদের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী পুলিশ বৃহস্পতিবার রাতে পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ ও পার্শ্ববর্তী নীলফামারী জেলার ডিমলা উপজেলা থেকে আরও তিন জেএমবি সদস্যকে গ্রেফতার করে। এ সময় এক জেএমবি সদস্যের বাড়ির গোয়ালঘর থেকে একটি নাইন এমএম, একটি সেভেন পয়েন্ট সিক্স এমএম পিস্তল, তিনটি ম্যাগাজিন, দুটি ককটেল, পাঁচ রাউন্ড গুলি, একটি চাপাতি, দুটি ছুরি ও একটি বাইসাইকেল উদ্ধার করা হয়। এর মধ্যে সন্ত গৌড়ীয় মঠের পুরোহিতের হত্যাকা-ে ব্যবহৃত চাপাতি এবং পিস্তল রয়েছে। শুক্রবার দুপুর বারোটায় দেবীগঞ্জ থানা চত্বরে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি হুমায়ুন কবির এসব তথ্য জানান। তিনি জানান, দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি, সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনের মধ্যে আতঙ্ক এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বন্ধে জঙ্গীগোষ্ঠী এই নৃশংস হত্যাকা-টি ঘটিয়েছে। দেবীগঞ্জ থানায় প্রেস ব্রিফিং অনুষ্ঠানে উদ্ধার হওয়া অস্ত্র ও গোলাবারুদ প্রদর্শন করা হলেও অজ্ঞাত কারণে গ্রেফতারকৃত তিন জেএমবি সদস্যকে হাজির করা হয়নি। গ্রেফতারকৃতদের সংখ্যা উল্লেখ করলেও নাম ও পরিচয় জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে ডিআইজি বলেন, পুরোহিত হত্যাকা-ে পাঁচ সদস্যের একটি দল উপস্থিত ছিল। এর মধ্যে তিনজনকে গ্রেফতার করা হলেও অন্য দু’জনকে গ্রেফতারে পুলিশী অভিযান চলছে। আগে আটককৃতদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মূল পুরোহিত হত্যাকারী, পথ নির্দেশদাতা ও অপর একজনকে দেবীগঞ্জ এবং নীলফামারীর ডিমলা এলাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়। তিনি বলেন, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে একজন চাপাতি দিয়ে জবাই করে পুরোহিত যজ্ঞেশ্বরকে হত্যা করার কথা স্বীকার করেছে। অপর দু’জন কয়েকদিন আগে থেকে পথ নির্দেশ এবং পরিকল্পনায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। তিনি আরও বলেন, যজ্ঞেশ্বর হত্যাকারীরা একটি সংঘবদ্ধ জঙ্গীগোষ্ঠীর সদস্য। তারা জেএমবির স্থানীয় ও বিভাগীয় পর্যায়ের নেতা। দেশের উন্নয়নের গতিধারাকে বাধাগ্রস্ত এবং দেশ অস্থিতিশীল করার জন্যই ঘটনাটি ঘটিয়েছে। গ্রেফতারকৃতরা ঘটনায় সরাসরি অংশ নেয়। জব্দ অস্ত্রগুলো বিদেশী। এর মধ্যে একটি আমেরিকায় তৈরি নাইন এমএম পিস্তল, আরেকটি ৭ পয়েন্ট ৬৫ পিস্তল পার্শ¦বর্তী দেশে তৈরি হতে পারে। রংপুরে বিদেশী হত্যাসহ উত্তরাঞ্চলের এ ধরনের বিভিন্ন ঘটনায় এসব অস্ত্রই ব্যবহৃত হচ্ছে। ডিআইজি জানান, যজ্ঞেশ্বর হত্যাকা-ে জড়িতদের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে বিচারের ব্যবস্থার চেষ্টা করা হবে। সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ সুপার গিয়াসউদ্দিন আহমদ, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার দীন মোহাম্মদ, এএসপি সার্কেল কফিল উদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। প্রেস ব্রিফিংয়ে ডিআইজি গ্রেফতারকৃতদের নাম না বললেও ভিন্ন একটি বিশ্বস্ত সূত্রে দু’জনের নাম জানা গেছে। এরা হলোÑ আব্দুল হারেছ (৩২), পিতা- মৃত মোজাম্মেল। বাড়ি- দেবীগঞ্জ উপজেলার সুন্দরদীঘি ইউপির কালিরডাঙ্গা গ্রামে। হারেছ পেশায় রিক্সা-ভ্যান চালক। অন্যজন নীলফামারী জেলার ডিমলার রমজান আলী। পুলিশ অবশ্য ঘটনার পর হারেছকে আটকের পর ছেড়ে দিয়েছিল। অথচ জঙ্গী নেতা হারেছই পুরোহিত হত্যাকা-ের মূল হোতা ও তার বাড়ির গোয়ালঘর থেকেই আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধার করা হয়। গত ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে দেবীগঞ্জ উপজেলার করতোয়া ব্রিজসংলগ্ন সন্ত গৌড়ীয় মঠে পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর দাসাধিকারী (৫০) নামে হিন্দু পুরোহিতকে গলা কেটে হত্যা করা হয়। সন্ত্রাসীদের গুলি ও ককটেলের আঘাতে আহত হয় আরও দুই পুরোহিত। তারা তখন পূজার কাজের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পুরোহিত যজ্ঞেশ্বর স্নান সেরে ফুল নিয়ে সকালের পূজার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। এ সময়ই একটি মোটরসাইকেলযোগে আসা দুই দুর্বৃত্ত গৌড়ীয় মঠে ঢুকে মঠের প্রধান পুরোহিত ও অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়ের ঘরের দরজায় নক করলে তিনি বের হয়ে আসামাত্রই দুর্বৃত্তরা তার ওপর হামলা চালায়। এ সময় ব্রিজের ওপর মোটরবাইক স্টার্ট রেখে অপেক্ষা করছিল আরেক দুর্বৃত্ত। যজ্ঞেশ্বরকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে ও জবাই করে হত্যা করা হয়। এদিকে মন্দিরের পূজারি গোপাল (৩৫) টের পেয়ে চিৎকার করলে তার হাতে ও পায়ে গুলি করে দুর্বৃত্তরা। অপর পূজারি নিতাইপদ দাস চিৎকার করলে তাকে ককটেল ছুড়ে আহত করে দুর্বৃত্তরা মোটরবাইকে চেপে পালিয়ে যায়। নিহত যজ্ঞেশ্বরের বড় ভাই রবীন্দ্রনাথ রায় দেবীগঞ্জ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। এছাড়া পুলিশ বাদী হয়ে বিস্ফোরক আইনে আরেকটি মামলা দায়ের করে। অন্যদিকে ঘটনার পর থেকেই ক্ষোভে উত্তাল হয়ে ওঠে দেবীগঞ্জ। এ ঘটনায় জড়িতদের গ্রেফতারের দাবিতে মানববন্ধন করে দেবীগঞ্জবাসী।
×