ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

অবশেষে লেখক হত্যার প্রতিবাদ, বই কেনার শেষ সময়

প্রকাশিত: ০৫:২৭, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অবশেষে লেখক হত্যার প্রতিবাদ, বই কেনার শেষ সময়

মোরসালিন মিজান ॥ একেবারেই শেষ সময়ে মেলা। এ সময়টা কেবলই বই সংগ্রহের। প্রকৃত পাঠক ভেতরে একটা তাগিদ অনুভব করছেন। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৬তম দিনে শুক্রবার মেলা ঘুরে এমনটি মনে হয়েছে। ছুটির দিন হওয়ায় লোক সমাগম শুধু বেশি হয়নি, কয়েকগুণ হয়েছিল। এদিন ছিল শেষ শিশুপ্রহরও। ফলে মেলার প্রবেশদ্বার খুলে দেয়া হয় সকালবেলায়। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, সকাল ১১টার পরিবর্তে সাড়ে ১০টায় মেলার সূচনা হয়। এ সময় বাবা, মা ও অভিভাবকের সঙ্গে মেলা ঘুরে পছন্দের বই কিনেছে কচিকাঁচারা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আসতে শুরু করেন সব বয়সী পাঠক। দুপুরের পর সৃষ্টি হয় জনস্রোত। বিকেলে মেলায় প্রবেশের জন্য অপেক্ষারতদের লাইন দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হয়। হতে থাকে। এদিন বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান অংশ ঘুরে দেখা যায়, মানুষ আর মানুষ। প্রায় প্রতিটি স্টলের সামনে গায়ে গায়ে লাগা ভিড়। পছন্দের বই পরের দিনের জন্য রেখে যেতে চাননি কেউ। রেদওয়ান ও শামীমা আখতার দম্পতি এসেছিলেন দুই ছেলে-মেয়ে নিয়ে। উভয়ই ছোট। ভিড়ের মধ্যেই তারা বেশ মজা করে বই দেখছিল। রেদওয়ান জানালেন, ছোট হলেও বাচ্চাদের পছন্দ আছে। কার্টুন, বিজ্ঞান ও গণিত বিষয়ক বই ওদের খুব পছন্দ। যার যা পছন্দ, কিনে দিয়েছেন বলে জানান তিনি। মেলায় এসেছিলেন সাবেক সরকারী কর্মকর্তা জয়নুল আবেদিন। বয়স হয়েছে। তাই সঙ্গে দু’জন সহযোগী। বেশ কিছু বই তাদের হাতে। জনকণ্ঠকে এই বইপ্রেমী বলেন, প্রতিবারই শেষ সময়ে এসে বই কিনি। কারণ, এ সময় নতুন সব বই পাওয়া যায়। আগেই করে রাখা তালিকা ধরে বই কিনেছেন বলে জানান তিনি। বাংলা একাডেমি ॥ ব্যাপক সমালোচনার মুখে শুক্রবার প্রথমবারের মতো লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যার আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ জানাল বাংলা একাডেমি। বিজ্ঞান লেখক ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যার কালদিনে শুক্রবার এ কর্মসূচী পালন করা হয়। গ্রন্থমেলা চলাকালীন বিকেল চারটায় নিহত লেখক স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন মেলামঞ্চে উপস্থিত বিশিষ্টজনরা। মেলা সামনে রেখে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এই প্রতিবেদক প্রস্তাব করেছিলেন, উদ্বোধনী দিন প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হোক। সে প্রস্তাব পাশ কাটিয়ে যান একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান। আর তারপর ব্যাপক সমালোচনার মুখে শুক্রবার লেখক- প্রকাশক হত্যার প্রতিবাদে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। গত বছরের এই দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে ধর্মীয় জঙ্গীগোষ্ঠীর হাতে নির্মমভাবে খুন হন অত্যন্ত মেধাবী এই তরুণ। মুক্তমনা লেখকের রক্তে ভেসে যায় টিএসসির ফুটপাথ। আহত হন অভিজিতের স্ত্রী লেখক বন্যা। এই ঘটনায় সারা দেশে তোলপাড় হলেও বিস্ময়করভাবে নীরব থাকে বাংলা একাডেমির মতো জাতীয় প্রতিষ্ঠান। এমন নতজানু নীতির তীব্র সমালোচনা চলছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এমনকি জাতীয় প্রতিষ্ঠানটির ‘মেরুদ- নেই’ এমন কথা লিখে ব্যানারও টানানো হয়েছিল টিএসসির রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে। এই অবস্থায় শুক্রবার কিছুটা যেন টনক নড়ে কর্তৃপক্ষের। এদিন অভিজিৎ রায় স্মরণ ও তার হত্যাকারীদের গ্রেফতারের দাবিতে এক মিনিট নীরবতা পালন করে বাংলা একাডেমি। মূল মঞ্চে এ সময় বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, লেখক ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। সকলেই অভিজিৎ হত্যার বিচারের দাবিতে দাঁড়িয়ে এক মিনিট নীরবতা পালন করেন। এসময় অভিজিৎ রায়কে স্মরণ করে একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান বলেন, মৌলবাদী-সাম্প্রদায়িক চক্র মুক্তবুদ্ধির লেখকদের হত্যার মধ্য দিয়ে দেশে অন্ধকারের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। তাদের অপতৎপরতার বিরুদ্ধে আমাদের সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। নামমাত্র প্রতিবাদ, তবু প্রতিবাদ তো। মুক্ত চিন্তায় বিশ্বাসী মানুষ এর প্রশংসা করেছেন। নতুন বই ॥ ২৬ তম দিনে একাডেমির তথ্য কেন্দ্রে জমা পড়েছে নতুন ১৯৬টি বই। নির্বাচিত বই ॥ কথা প্রকাশ থেকে এসেছে মুনতাসীর মামুনের বই ‘জেনারেলের সঙ্গে’। ২৫ বছর আগের বইটি পরিবর্ধিত রূপে প্রকাশ করা হয়েছে। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে সুপা সাদিয়ার বই ‘বায়ান্নর ৫২ নারী’। এতে ৫২ নারী ভাষাসৈনিকের তথ্য সন্নিবেশিত করা হয়েছে। জার্নিম্যান প্রকাশ করেছে ‘বঙ্গবন্ধুর সহজপাঠ’। লিখেছেন আতিউর রহমান। সাবলীল লেখা ও অত্যন্ত দৃষ্টিনন্দন প্রকাশনাটি বঙ্গবন্ধুর সত্যি সহজপাঠ। একই প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে সাদিকুর রহমান পরাগের ‘প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তের কবি রিলকে’। আধুনিক বিশ্ব সাহিত্যের অত্যন্ত জনপ্রিয় লেখক জার্মানভাষী কবি রাইনার মারিয়া রিলকে সম্পর্কে অনেক কিছু জানার সুযোগ এই বই। ঐতিহ্য থেকে এসেছে ‘রসিক রবীন্দ্রনাথ’। লিখেছেন তাপস রায়। এতে কবিগুরুর খেয়ালি মনের পরিচয় তুলে ধরার প্রয়াস পায়। জয়তী থেকে এসেছে ‘বিশ্বসাহিত্যের শ্রেষ্ঠ গল্প’। অনুবাদ করেছেন রাফিক হারিরি। বেঙ্গল প্রকাশ করেছে ‘জয়নুল আবেদিন; জন্মশতবার্ষিক শ্রদ্ধাঞ্জলি’। এটি শিল্পচার্যের ওপর চমৎকার সংকলন গ্রন্থ। চন্দ্রাবতী একাডেমি থেকে এসেছে আবুল মাল আবদুল মুহিতের ‘সোনালী দিনগুলি’। মেলামঞ্চের আয়োজন ॥ গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে এদিন অনুষ্ঠিত হয় ‘২০২১ সালের বাংলাদেশ’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল এবং রাশিদ আশকারী। সভাপতিত্ব করেন শিক্ষাবিদ অধ্যাপক একে আজাদ চৌধুরী। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশ এখন অপার সম্ভাবনাময় এক দেশের নাম। তবে সর্বস্তরে মাতৃভাষা বাংলা প্রচলনের জন্য আমাদের আরও পথ পাড়ি দিতে হবে। দেশের উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে শিক্ষার মাধ্যম মূলত বাংলা হলেও বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়, কারিগরি, মেডিক্যাল এবং অন্যান্য শিক্ষার মাধ্যম এখনও ইংরেজী। এ ক্ষেত্রে বাংলা মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় আরও ব্যাপক প্রস্তুতির প্রয়োজন। মনে রাখা দরকার যে, ইংরেজী বা অনুরূপ অন্যান্য আন্তর্জাতিকভাবে ব্যবহৃত ভাষা এখন শুধুই একটি ভাষা নয় বরং এর গুরুত্ব এখন প্রযুক্তি এমনকি উৎপাদনের উপাদানের মতো। জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসারে ইংরেজী ভাষার সকল প্রয়োজনীয় মূল জ্ঞানের আধার বইসমূহ প্রথমেই বাংলায় অনুবাদ করে নিতে হবে; নইলে দর্শন, ইতিহাস, গণিত, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, রসায়ন, চিকিৎসাবিদ্যা, প্রযুক্তিবিদ্যা, প্রাণীবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা সম্পর্কে যে জ্ঞানভা-ার ইংরেজী ও অন্যান্য বিদেশী ভাষার বইতে সংরক্ষিত রয়েছে, তা থেকে বঞ্চিত রেখে উচ্চশিক্ষার্থীগণকে সত্যিকারভাবে জ্ঞানী করে তোলা যাবে না। আলোচকরা বলেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানবিক উন্নয়নের সকল সূচকে বাংলাদেশ এখন সমগ্র বিশ্বে এক বিস্ময়ের নাম। এখন দেশের উন্নয়নের জন্য আমরা আর দাতা সংস্থার পরামর্শের ওপর নির্ভরশীল নই। নিজস্ব সম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে জাতীয় উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এখন প্রয়োজন সুশাসন নিশ্চিতকরণ এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সঙ্গীত পরিবেশন করেন কণ্ঠশিল্পী ফকির আলমগীর, আবদুল জাব্বার, তিমির নন্দী, মনোরঞ্জন গোষাল, নমিতা ঘোষ, শিবু রায়, বিশ্বজিৎ রায়, মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, শফিউল আলম রাজা, পল্লবী সরকার মালতী এবং আরিফ রহমান।
×