ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

এক পরিবারের শিশুসহ দুই ভাইয়ের মৃত্যু ॥ মা-বাবা জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে ॥ এক ভাই আশঙ্কামুক্ত

ছারখার সাজানো সংসার ॥ উত্তরায় ফ্ল্যাটের গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ

প্রকাশিত: ০৫:২২, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ছারখার সাজানো সংসার ॥ উত্তরায় ফ্ল্যাটের গ্যাসলাইনে বিস্ফোরণ

স্টাফ রিপোর্টার ॥ রাজধানীর উত্তরায় একটি ফ্ল্যাটের গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে আগুনে দুই ভাইয়ের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হচ্ছেন, ১৪ মাসের শিশু জারান বিন নেওয়াজ ও তার বড় ভাই শাহালিন মিলন নেওয়াজ (১৫)। তাদের বাবা গৃহকর্তা মার্কিন দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শাহনেওয়াজ (৫০) ও মা সুমাইয়া আক্তার (৪০) জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। তাদের বার্ন ইউনিটের আইসিইউতে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে। আরেক ভাই জারান (১১) দুই হাত ও পা পুড়ে গেছে। তার অবস্থা আশঙ্কামুক্ত। সর্বনাশা আগুনে ছারখার হয়ে যায় একটি আনন্দে ভরা সাজানো সংসার। ঢামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটের আবাসিক চিকিৎসক পার্থ শংকর পাল জানান, নিহত শাহালিনের ৮৮ শতাংশ ও নিহত ১৪ মাস বয়সের জারানের ৭৪ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল। শুক্রবার বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে শিশু জারানের মৃত্যু হয। সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শাহালিনের মৃত্যু হয়। আর তাদের বাবা শাহনেওয়াজের শরীরের ৯৫ শতাংশ ও মা সুমাইয়া আক্তারের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। তাদের অবস্থা আশঙ্কাজনক। আর তাদের ভাই জারিফের দুই হাত ও দুই পাসহ ৬ শতাংশ পুড়ে গেছে। সে শংকামুক্ত। প্রতিবেশীরা জানান, শুক্রবার সকাল ৭টার দিকে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর সাততলা ভবনের সপ্তম তলার ফ্ল্যাটের মার্কিন দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার মোঃ শাহনেওয়াজের রান্নাঘরে চুলা জ্বালাতে গেলে গ্যাস লাইন বিস্ফোরণে আগুন লাগে। কে জানত শীঘ্রই ভয়ঙ্কর বিপদ নেমে আসবে ইঞ্জিনিয়ার শাহনেওয়াজ, তার স্ত্রী ও তিন সন্তানের সুখের সংসার জীবনে। ওই ফ্ল্যাটের গৃহকর্ত্রী সুমাইয়া রান্না ঘরে গ্যাসের চুলায় আগুন ধরাতে যাবেন। তিনি দেশলাইয়ের কাঠি জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে গ্যাস লাইনে বিস্ফোরণ ঘটে। নিমেষে আগুনের লেলিহান শিখা ছড়িয়ে পড়ে ৮০০ বর্গফুটের ফ্ল্যাটে। মুহূর্তের মধ্যে আগুনে ঝলসে যায় তিন সন্তানসহ ইঞ্জিনিয়ার শাহনেওয়াজ ও স্ত্রী সুমাইয়া। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের দুটি ইউনিট ঘটনাস্থলে গিয়ে আগুন নেভায়। ফায়ার সার্ভিস নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা আতিকুল আলম চৌধুরী জানান, ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনেন। পরে দগ্ধদের উদ্ধার করে স্থানীয়দের সহায়তায় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে পাঠানো হয়। নিহতের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী মনিরুজ্জামান জানান, তার পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী শাহনেওয়াজ আমেরিকান দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার। শুক্রবার ভোর সাড়ে ছয়টার দিকে প্রচ- বিস্ফোরণের শব্দ হয়। মনে হচ্ছিল ভূমিকম্প হচ্ছে। এতে মনে হচ্ছিল বাড়িটি ভেঙে পড়ছিল। এতে আতঙ্কিত হয়ে ঘরের দরজা খুললে দেখি, পাশের ফ্ল্যাটে আগুন ধরেছে। ছটফট করতে করতে ফ্ল্যাট থেকে লোকজন বের হয়ে আসেন। ওই ফ্ল্যাটের পাঁচজনকে উদ্ধার করে প্রথমে স্থানীয় একটি হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে থেকে তাদের এ্যাপোলো হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানেও চিকিৎসার কোন কূলকিনারা না হওয়ায় তাদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বিকেল সাড়ে ৫টার দিকে তাদের অবুঝ ১৪ মাসের শিশু সন্তান জারান মারা যায়। এর পৌনে এক ঘণ্টা পর সন্ধ্যা পৌনে ৭টার দিকে তাদের আরেক সন্তান শাহালিন মারা যান। কয়েকজন বাসিন্দা জানান, আগুন লাগার পর ওই বাসার বাসিন্দা ইঞ্জিনিয়ার শাহনেওয়াজ আগুনে দগ্ধ অবস্থায়ই বের হওয়ার সময় অন্য ফ্ল্যাটগুলোর দরজা ধাক্কা দেন। ফ্ল্যাটগুলোর দরজায় পোড়া চামড়ার ছিন্নভিন্ন অংশ লেগে আছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, ফ্ল্যাটটির দুটি কক্ষ, রান্নাঘর ও খাবার ঘর সবই ছিল ল-ভ-। ওই ফ্ল্যাটের সব জিনিসপত্র কিছু না কিছু পুড়ছে। তবে বেশি পুড়েছে ফ্ল্যাটের পেছন দিকে থাকা রান্নাঘরটি। প্লাস্টিকের জিনিস ও দাহ্য বস্তু সবই পুড়ে গেছে। সব কক্ষের দেয়ালে লেগে ছিল পোড়া চামড়া। ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের ধারণা, ওই বাসার গ্যাসের চুলা বা লাইনে সমস্যা ছিল। এর ফলে রান্নাঘরে গ্যাস জমে যায়। আর শুক্রবার সকালে রান্না করার জন্য গ্যাস চুলাতে আগুন ধরাতে গিয়ে অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটে। আগুন পরে দ্রুত ওই ফ্ল্যাটে ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই পরিবারের ৫জন মারাত্মক দগ্ধ হন। তদন্ত করে আসল ঘটনা জানানো হবে বলে ফায়ার সার্ভিসের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ওই কর্মকর্তা জানান। ঢামেক হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোজাম্মেল হক জানান, আবুল হাসনাত নামের এক ব্যক্তি সকাল ৮টার দিকে ওই পাঁচজনকে হাসপাতালে নিয়ে যান। পরে সন্ধ্যার দিকে দুজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। তিনি জানান, সকালে ওই বাড়ির রান্নাঘর থেকে বিকট শব্দ হয় এবং আগুন ধরে যায়। পরে তা ছড়িয়ে পড়ে। এতে ওই ফ্ল্যাটের সকলে দগ্ধ হয়। পরে তাদের মধ্যে সন্ধ্যার দিকে এক ঘণ্টার ব্যবধানে দু’জনের মৃত্যু হয়। বার্ন ইউনিটের চিকিৎসক মুন্নী মমতাজ জানান, পাচঁজনের মধ্য চারজনেরই শ্বাসনালি পুড়ে গেছে। এদের মধ্যে ১৪ মাসের জারান ও তার বড় ভাই শাহালিন মার যায়। তাদের বাবা শাহনেওয়াজ ও মা সুমাইয়ার শরীরের ৯৫ ভাগ পুড়েছে। এ ধরনের দগ্ধ মানুষের বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কম। বার্ন ইউনিটে দগ্ধ শাহনেওয়াজের ফুফাত বোন আরমিন নিশাত জানান, হাসপাতালে ছটফট করার সময়ও আমার ভাই বলছিল যে, আপা আমারে আগুন ধাক্কা দিয়েছে। বাড়িওয়ালাকে গ্যাস লিক হওয়ার কথার বলেছিলাম। এত বড় একটি ঘটনা। পাঁচজন পুড়ে গেল! কিন্তু বাড়িওয়ালা একবারের জন্যও হাসপাতাল কিংবা ঘটনাস্থলে যাননি। কিন্তু ভাই শাহনেওয়াজ জানে না তার দুই সন্তান মারা গেছে। সর্বনাশা আগুনে ওদের সাজানো সংসার তছনছ হয়ে গেছে। শাহনেওয়াজের ভাগ্নে নাজমুস সাকিব জানান, বাড়িতে ওঠার পর গ্যাস জাতীয় গন্ধ ছড়ানোর বিষয়টি মামা বাড়িওয়ালাকে জানিয়েছিলেন। বৃহস্পতিবারও একই অভিযোগ করা হয়। তবে ভবনের মালিক দেলোয়ার হোসেনকে পাওয়া যায়নি। বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক সালেক জানান, এখানে প্রায়ই গ্যাস থাকে না। গ্যাস না থাকার বিষয়ে স্থানীয় তিতাস গ্যাস কার্যালয়ে একটি অভিযোগ দেয়া হয়েছিল। শাহনেওয়াজের স্বজন ও পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দাদের ভাষ্য, নতুন ফ্ল্যাটে ওঠার পর বাড়িওয়ালা দেলোয়ার হোসেনের কাছে গ্যাস লাইনের ছিদ্র থেকে গ্যাস বের হওয়ার কথা জানিয়েছিলেন তারা। কিন্তু তারপরও ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। গ্যাস লাইনের কাজ করানো হলে হয়ত এই পরিবারের সাজানো সংসারকে বাঁচানো যেত। বাড়িওয়ালার গাফিলতির কারণে সুন্দর এই সংসারের দুটি তাজা প্রাণ ঝরে গেল।
×