ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা ॥ ভাষাসৈনিক পরিবারের দাবি

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদা ॥ ভাষাসৈনিক পরিবারের দাবি

প্রতি বছর শুধু আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ২১ ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা শহীদদের খোঁজ-খবর নেয়া বা শুধু সম্মানী ভাতা নয়, প্রয়োজন ভাষা আন্দোলনে শহীদ এবং সৈনিকদের এখন পরিপূর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও মর্যাদার। সেই সঙ্গে তাদের স্মৃতি যথাযথ মর্যাদায় সংরক্ষণ করা। মুক্তিযোদ্ধাদের মতো ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের উত্তরসূরিদের চাকরি ও ভর্তি কোটাসহ অন্যান্য রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধার দাবি করেছেন ভাষাশহীদ বরকত পরিবারের সদস্যরা। এছাড়া যে ক’জন ভাষাসৈনিক বর্তমানে বেঁচে আছেন মৃত্যুর পর তাদেরকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের দাবি করেছেন তারা। শহীদ বরকত পরিবারের সদস্যরা অসন্তোষ প্রকাশ করে বলেন, সম্প্রতি চাকরিজীবীদের বেতন ভাতাদি বৃদ্ধি করা হলেও বাড়েনি ভাষা শহীদদের সম্মানী ভাতা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে আগে অন্তত প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি এলে ভাষা শহীদদের খোঁজ-খবর নেয়া হয়েছে। কিন্তু এখন আর তেমন করে খোঁজ নেয়া হয় না। ভাষা শহীদদের পরিবারের সদস্যরা এখন অনেকটা অবহেলিত। বর্তমানে ভাষা শহীদ ও সৈনিকদের স্মরণে যে একুশের বইমেলা এবং রাষ্ট্রীয়সহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়, সেখানেও তাদের পরিবারের কাউকে আমন্ত্রণ জানানো হয় না। তবে দিবসটি উপলক্ষে শুধু সাংবাদিকরা খোঁজ নেন তাদের পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য। মহান ভাষা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের তরুণ আবুল বরকতের প্রিয় শহর ছিল ঢাকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষে এখানেই থাকার কথা ছিল তার। পড়াশোনা শেষ করতে না পারলেও তার সে স্বপ্ন সফল হয়েছে, এখানে রয়েছেন অন্তিম শয্যায়। বরকতকে এদেশে চির নিদ্রায় রেখে স্থির থাকতে পারেনি তার পরিবার। তাই প্রিয়জনের মায়ায় জন্মভূমি ছেড়ে তারাও এদেশে চলে আসে। আদরের বড় ছেলে আবুল বরকত ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনের মিছিলে শহীদ হওয়ার পর তার বাবা-মাও সিদ্ধান্ত নেন ঢাকায় আসার, যাতে অন্তত আজিমপুরের কবরস্থানে চিরনিদ্রায় ঘুমিয়ে থাকা ছেলের সান্নিধ্য পেতে পারেন। কিন্তু ১৯৬৩ সালের ২১ জুলাই বরকতের বাবা শামসুজ্জোহা ভুলু মিয়া ভারতে মারা যান। পরের বছর মা হাসিনা বানু ১৯৬৪ সালে আংশিক সম্পত্তি বিনিময় করে ভারত থেকে এদেশে চলে আসেন। নিবাস গাড়েন গাজীপুর মহানগরের চান্দনা গ্রামের ‘বাবলা বীথি’তে। শহীদ বরকতের একমাত্র ভাই আবুল হাসনাত রোগাক্রান্ত হয়ে ১৯৬৮ সালের ২১ সেপ্টেম্বর এখানেই মারা যান। তার তিন ছেলে ও তিন মেয়ে। বরকতের চার বোনই গত হয়েছেন ইতোমধ্যে। বরকতের ছোট ভাই আবুল হাসনাতের সন্তানরাই এখন আঁকড়ে ধরে আছেন ভাষা শহীদ বরকতের স্মৃতি। গাজীপুরের চান্দনা গ্রামে এখন বসবাস করছেন বরকতের তিন ভাতিজা। শহীদ বরকতের মা হাসিনা বানু ১৯৮২ সালের ২১ এপ্রিল এ বাড়িতেই মারা গেছেন। বরকত ও তাঁর মা, বাবা ও ভাইয়ের মৃত্যু যেন একই সূত্রে গাথা। এদের সবাই মারা গেছেন বিভিন্ন বছরের বিভিন্ন মাসের একই তারিখ একুশে। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আত্মদানকারী শহীদ বরকতের আদি নিবাস পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ভরতপুর থানার বাবলা গ্রামে। গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষা শেষে ১৯৪৫ সালে তালিবপুর হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে ১৯৪৭ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পাসের পর সে বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএ অনার্স শ্রেণীতে ভর্তি হন। শুরুতে তিনি ওঠেন মামা আবদুল মালেকের আজিমপুরের বাসায়। পরে ছাত্রাবাসে। ১৯৫১ সালে দ্বিতীয় শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান পেয়ে অনার্স পাস করে তিনি এমএ শেষ পর্বে ভর্তি হয়েছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন শুরু হলে তিনি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে আমতলায় সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদের ডাকে সমাবেশে যোগ দেন। পাকিস্তান সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা ভেঙে ছাত্র-জনতার সেøাগানে কেঁপে ওঠে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এক পর্যায়ে পুলিশের গুলিতে হোস্টেলের ১২ নম্বর শেডের বারান্দায় লুটিয়ে পড়েন বরকত। গুলিবিদ্ধ বরকত ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগে ভর্তি অবস্থায় রাত ৮টায় মারা যান। ওই রাতেই তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের উপস্থিতিতে ম্যাজিস্ট্রেটের তত্ত্বাবধানে আজিমপুর গোরস্তানে শহীদ বরকতকে দাফন করা হয়। শহীদ হওয়ার দীর্ঘ সময় পর ২০০০ সালে শহীদ আবুল বরকতকে মরণোত্তর একুশে পদক দিয়ে সম্মানিত করা হয়। স্বাধীনতা লাভের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রতি বছর ফেব্রুয়ারি মাসে হাসিনা বানু দেখা করতেন। বরকতের ভাতিজারা জানান, বঙ্গবন্ধু বরকতের মা হাসিনা বানুকে মা বলে সম্বোধন করতেন, আর হাসিনা বানু বঙ্গবন্ধুকে বলতেন ‘শেখজী’। ১৯৭৩-এর ফেব্রুয়ারিতে হাসিনা বানু মুর্শিদাবাদে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ভিসা ও বিমানের টিকেট পাঠিয়েছিলেন তাঁকে আনতে। ‘বাবলা বীথি’তে থাকেন শহীদ বরকতের ভাই মরহুম আবুল হাসনাতের তিন ছেলে আলাউদ্দিন বরকত, আইন উদ্দিন বরকত ও জালাল উদ্দিন বরকত। এদের একজন স্থানীয় বোতাম ফ্যাক্টরিতে চাকরি করেন। আর শেষোক্ত দু’জন ব্যবসা করেন। ১৯৮১ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ঢাকা-জয়দেবপুর সড়কের চান্দনা গ্রামসংলগ্ন নলজানী মৌজায় হাসিনা বানুকে ৬৮ শতাংশ জমি দান করেন। এই জমির একাংশে পরিবারের সদস্যরা নিজ উদ্যোগে শহীদ বরকত স্মরণে বরকত স্মৃতি পাঠাগার ও মসজিদ নির্মাণ করেন এবং অপর অংশে দোকান নির্মাণ করে তা দেখাশোনা করেন আবুল হাসনাতের ছোট ছেলে জালাল উদ্দিন বরকত। এ জমিতেই চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন হাসিনা বানু। সম্প্রতি স্থানীয় একটি প্রভাবশালী মহলের নজর পড়ে এ জমিটির ওপর। বরকত পরিবারকে ওই জমি থেকে উচ্ছেদ করতে বিষয়টি নিয়ে আদালত পর্যন্ত গড়ায়। মাসখানেক আগে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। বরকতের পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শহীদ পরিবারের সদস্য হিসেবে তাদের যেমন গর্ব আছে, তেমনি ক্ষোভ এবং অভিমানও রয়েছে। কারণ পারিবারিক উদ্যোগে বরকতের স্বজনরা চান্দনা গ্রামে তাদের বাসার সামনের রাস্তাটির নাম রেখেছেন ‘শহীদ বরকত স্মরণী’। স্থানীয় লোকজন এ ব্যাপারে সহযোগিতার হাত বাড়ালেও প্রশাসনিকভাবে সহযোগিতা করা হয়নি বলে আক্ষেপ ভাতিজা আলাউদ্দিন বরকতের। তিনি বলেন, আমরা চাই অন্তত গাজীপুরে শহীদ বরকতের নামে কোন বড় প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করা হোক। তার মতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম-বরকত হল ছাড়া দেশে বরকতের নামে আর কোন প্রতিষ্ঠান নেই। -মোস্তাফিজুর রহমান টিটু গাজীপুর থেকে
×