ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মিথ্যাচার করতে করতে খালেদার রাজনীতি এখন সন্ত্রাসের পথে

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

মিথ্যাচার করতে করতে খালেদার রাজনীতি এখন সন্ত্রাসের পথে

রাজনীতি এক মহান সেবা। এর মাধ্যমে আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় মানুষ যেমন সমাজের ওপরে বসে ছড়ি ঘোরাতে পারে, তেমনি ধিকৃত হয়ে কক্ষচ্যুতও হয়ে যায়। পৃথিবীতে এমন অগণিত নজির আছে যে, একজন অতি সাধারণ মানুষও রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় আসীন হয়েছেন কেবল রাজনীতির পথেই। যেমন আমেরিকার জর্জ ওয়াশিংটন। অবশ্য পূর্ব ইউরোপের পতনেরও আগে পোল্যান্ডের ডানজিগ শহরের শ্রমিক নেতা লেস ওয়ালেসাও পোল্যাল্ডের সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর প্রেসিডেন্টের আসন দখল করেছিলেন। তবে সৎ রাজনীতি যেমন একজন মানুষকে বা রাষ্ট্রনায়ককে মরণজয়ী করে তোলে অর্থাৎ মৃত্যুর পরও মানুষকে তার আদর্শ ও নির্দেশিত পথে চলার পথ দেখায়, যুগের পর যুগ শতাব্দীর পর শতাব্দী। আবার এমন নজির আছে মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত রাজনীতি বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কোনটাই টিকে না, হয় ক্ষণস্থায়ী। যেমন পোল্যান্ডের লেস ওয়ালেসা, সাধারণ এক শ্রমিক নেতা পোল্যান্ডে ঝড় তুলে তৎকালীন সমাজতান্ত্রিক পোল্যান্ডের পতন ঘটিয়েছিলেন আশির দশকের প্রথমার্ধে। সিআইএ’র এজেন্ট সোভিয়েট ইউনিয়নের মিখাইল গর্বাচেভের মতো, মানুষের কিছু কিছু ক্ষোভের সুযোগ নিয়ে গর্বাচেভ গোটা সোভিয়েট ইউনিয়নকে তছনছ করে দিয়েছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে গোটা সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার পতন হলো। লেস ওয়ালেসা বা মিখাইল গর্বাচেভের পরবর্তী জীবন মোটেই সুখের ছিল না। গর্বাচেভ তো দেশান্তরী হলেন আর ওয়ালেসা প্রথমবার সব ভেঙ্গেচুরে পোল্যাল্ডের প্রেসিডেন্ট হলেও অল্পদিনেই আবার নির্বাচনে অপমানজনকভাবে হেরে গিয়ে পাবলিক হয়ে গেলেন, ঠিক গর্বাচেভের মতোই। লেস ওয়ালেসা আশির দশকের প্রথমার্ধে পোল্যাল্ডের এবং শেষার্ধে গর্বাচেভ সোভিয়েট ইউনিয়নের ত্রাণকর্তা হিসেবে আবির্ভূত হয়ে অল্পদিনেই জ্বালানিবিহীন প্রদীপের মতো ধপ করে নিভে গেলেন। আজ তাদের নাম কেউ নেয় না। নিলেও ঘৃণাভরে নেয় এবং সামনে ছবি থাকলে থুথু দেয়। ছেলেবেলায় একটি ইংরেজী কবিতা পড়েছিলাম, ‘চধঃৎরড়ঃ’ বা ‘দেশপ্রেমিক’। দেশপ্রেমিকও জনগণের রাজনীতি করতে করতে ফুলের মালায় ডুবে এবং রাজপথের দু’পাশ থেকে পুষ্প বৃষ্টিতে সিক্ত হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হলেন। কিন্তু অল্পদিনেই প্রমাণ হয়ে গেল দেশপ্রেমিকের সব কিছুই মিথ্যার ওপর প্রতিষ্ঠিত এবং যথারীতি ভেঙ্গে পড়তেও দেরি হলো না। দেখা গেল ‘চধঃৎরড়ঃ’ ক্ষমতাচ্যুত হয়ে যখন ফিরছিলেন তখন তার গলায় জুতোর মালা এবং দু’পাশ থেকে পাদুকাবৃষ্টি। অথচ এই পথেই ক্ষমতার মঞ্চে যাবার পথে তার গলায় ছিল ফুলের মালা এবং পুষ্পবৃষ্টি। সোভিয়েট ইউনিয়ন গেলেও মস্কো ঘুরে দাঁড়িয়েছে প্রেসিডেন্ট পুতিনের নেতৃত্বে। তার এই ঘুরে দাঁড়ানো বিশ্বরাজনীতিতে কিছুটা হলেও ব্যালান্স আসতে শুরু করেছে। পূর্ব ইউরোপের পতন কেবল সে সব দেশের জন্যেই বিপদ ডেকে আনেনি; আমাদের এ অঞ্চলও সাম্রাজ্যবাদী আমেরিকার হিংস্র্র ছোবলের শিকার হয়েছে, হচ্ছে। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া এবং সর্বশেষ সিরিয়াÑ এই সব দেশ আজ মার্কিনীদের শ্যেনদৃষ্টিতে পড়ে সর্বস্বান্ত হয়েছে। লাখ লাখ নিরীহ মানুষের প্রাণ কেড়ে নিচ্ছে। বিশেষ করে নারী-শিশুরা যেভাবে মানবেতর জীবনযাপন করছে এবং জীবন দিচ্ছে, তার নজির তো কেবল হিটলারের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার সঙ্গে তুলনা করা যায়। বাংলাদেশে ’৭১ সালে ওরা ৩০ লাখ মানুষ হত্যা এবং অসংখ্য মা-বোনের সম্ভ্রম ও জীবনহানি ঘটেছে। সিরিয়ায় এরই মধ্যে আড়াই লাখ নিরীহ মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, এখনও হারাচ্ছে। ইরাকে কেবল শিশু খাদ্যের অভাবে ৬ লাখ প্রাণ হারিয়েছে। এ সবই হয়েছে কিছু লোকের ভুল রাজনীতির খারাপ প্রতিক্রিয়ায়। ভুল রাজনীতির সুযোগ নিয়ে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্যসহ আমাদের এসব অঞ্চল পর্তুগীজ বা ব্রিটিশ বেনিয়াদের মতো লুট করার মানস নিয়ে ঢুকে পড়ছে আর লুট করেছে। লেস ওয়ালেসা বা মিখাইল গর্বাচেভের মতো শিখ-ি বসিয়ে কাজ হাসিল করছে। যেমন তারা এ অঞ্চলের ভারসাম্য বিনষ্ট করার জন্যে আল কায়েদার ওসামা বিন লাদেন বা আইএসের বাগদাদীকে নামিয়েছে। আল কায়েদা বা আইএস সরাসরি আমাদের এ ভূখ-ে সুবিধা করতে না পারলেও ওসামার শিখ-ি নওয়াজ শরীফের পাকিস্তানকে দিয়ে আমাদের দেশে নাশকতা চালাচ্ছে। আমাদের দেশ তাদের শিখ-ি হলো বেগম খালেদা জিয়া এবং তাদের রাজনৈতিক শক্তি হলো জামায়াত-শিবির। আর খালেদার ছেলে তারেক, সে তো এরই মধ্যে লন্ডনে পলাতক অবস্থায় জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে যেমন যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছে, পাশাপাশি এমন খবরও প্রচারিত হয়েছে, সে নাকি দুবাই এসে আন্তর্জাতিক টেরোরিস্ট এবং স্মাগলার দাউদ ইব্রাহিমের সাথে প্রতিনিয়ত বৈঠক করে চলেছে। এদের পরিণতিও হবে করুণ এবং এরই মধ্যে কিছু আলামতও দেখা যাচ্ছে। লেখার শিরোনামে বলেছি, মিথ্যাচারের রাজনীতির দিন শেষ হয়েছে। মানুষকে বেশি দিন মিথ্যাচার করে ভুলিয়ে রাখা যায় না। একটা প্রবাদ আছে 'You can be fool some people for all time; all people for some time, but you can not be fool all people for all the timeÓ কিছু মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায়, সব মানুষকে কিছু সময়ের জন্যে, কিন্তু সব মানুষকে সব সময়ের জন্যে বোকা বানানো যায় না। আমাদের দেশেও খালেদা-তারেক-জামায়াত-শিবির পবিত্র ইসলামের নামে কিছু সময়ের জন্যে বোকা বানিয়েছিল। কিন্তু তাদের সেই লক্ষ্য ভেস্তে গেছে। অবশ্য এটি শুরু করেছিলেন মিলিটারি জিয়া। ক্যুদেতার মাধ্যমে ক্ষমতায় বসে ভাবলেন শতকরা ৮৫ ভাগ মুসলিম জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে ইসলামের নামে বোকা বানানো সহজ হবে। কিছু সময়ের জন্যে জিয়া সফলও হয়েছিলেন। যেমন করে এরশাদ এবং খালেদাও। কিন্তু অল্প দিনেই মানুষের মোহ কেটে যায়। মানুষ বুঝতে পারে ওদের ইসলামপ্রীতি স্রেফ ভ-ামি এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের উপলক্ষ মাত্র। বাংলাদেশের মানুষ অর্থাৎ বাঙালী, পাহাড়ী, আদিবাসী, মুসলিম, হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীস্টান সবাই ধর্মভীরু কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তারা রীতিমতো ধর্মীয় উপাসনা করে এবং তাদের উপাসনার লক্ষ্য হলো মহান সৃষ্টিকর্তা ও তার প্রেরিত পুরুষের নির্দেশিত পথে এগিয়ে যাওয়া। মিলিটারি জিয়া-এরশাদ গেছে, খালেদাও যায় যায়। তবে খালেদার ধারণা, তারেক বাবা আসবে এবং তাকে এক চেয়ারে এবং অপরটিতে সে নিজেই বসে পড়বে। আর লক্ষ্য খালেদা সঙ্গীরা হেন মিথ্যা নেই যা বলছে না, হেন অপকর্ম নেই যা করছে না। রীতিমতো নাশকতার পথে এগুচ্ছে। গত ২০ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাত অর্থাৎ ২১ ফেব্রুয়ারির প্রথম প্রহরে রাজধানী ঢাকাসহ দেশব্যাপী বাংলাপ্রেমী মানুষ শহীদ মিনারে যায় এবং প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, এরপর বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ ফুল দিয়ে একুশে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে বাড়ি ফিরে যায়। কিন্তু এবার খালেদা জিয়া হঠাৎ করে ২১-এর প্রথম প্রহরে যাবার আরজি পেশ করে এবং কর্তৃপক্ষ তাকে রাত ১টার পরে সময় দেয়। তখন বোঝা গেছিল শহীদ মিনার আর সেই ভাব-গাম্ভীর্যের শহীদ মিনার থাকবে না। ঘটেছেও তাই। অতীতে খালেদা জিয়া সকাল ৯টার দিকে শহীদ মিনার যেতেন। কিন্তু দেখা যেত তিনি বেদির কাছে তার ছাত্রদল-যুবদলের ছেলেমেয়েরা জুতা স্যান্ডেল পরেই শহীদ বেদিতে উঠে যেত এবং বেদিতে যত ফুল রয়েছে (জনগণ দিয়ে গেছে) সব তুলে নিয়ে খালেদা জিয়াকে ছিটাতো। এবার তাই হয়েছে। রাত ১০টা বাজার সাথে সাথে অনেক হোন্ডা করে এবং মিছিল করে সহস্র্রাধিক ছাত্রদল-যুবদল-জাসাস-এর ক্যাডাররা অতর্কিতে জাতীয় প্রেসক্লাব কম্পাউন্ডে ঢুকে পড়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে গোটা প্রেসক্লাবের পুনরুদ্ধারকৃত পরিবেশ তছনছ করে দেয়। ওদের সংখ্যা হাজারের মতো হবে। দারোয়ান এবং কয়েকজন সদস্য তাদের বাধা দিলে তারা তাদের মারতে উদ্যত হয়। তারপর শহীদ মিনারের পরিস্থিতিও তাই হয়। খালেদা জিয়া বেদির কাছে তার সঙ্গী কর্মীরা জুতো না খুলেই বেদি চত্বরে উঠে যায় এবং একইভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের ধারণা, খালেদা জিয়াকে ফুল ছিটালে বুঝি নেতার আসন পাকা হবে। প্রায় এক ঘণ্টার ওপর খালেদা বাহিনীর তা-ব চলে। অথচ এটা নিয়েও চরম মিথ্যাচার চলে। খবরটি সংবাদপত্রে ছাপা হয়। বিএনপির মিথ্যা বাচাল নেতা রিজভী কি বললেন? বললেন, ওটা নাকি আওয়ামী লীগের কর্মীরা করছে। রিজভীর উদ্দেশ্য কি বলা যাবে? এটাই কেবল বলা যায়, রিজভীর নেত্রী ও ভাইয়া একুশে ফেব্রুয়ারি কি এবং মর্যাদা আজ কোন্্ পর্যায় তা তাদের জানার কথা নয়। একুশের শহীদদের আত্মত্যাগের কথা তারা কি জানবে? তারা তো জানবে গোলাম আযম-নিজামী-মুজাহিদ-সাকা-সাঈদীর মতো একাত্তরের রাজাকার ও আযমের পাকি জঙ্গীদের তৎপরতার কথা। মিথ্যাবচন তাদের আজ এ পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। ঢাকা ॥ ২৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৬ লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও সভাপতি, জাতীয় প্রেসক্লাব [email protected]
×