ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

বুলবুল চৌধুরী

অন্য ধারার চয়ন

প্রকাশিত: ০৬:৩৪, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

অন্য ধারার চয়ন

নবীন লেখক শাহরিয়ার হোসেনের ‘স্বর্ণপ্রাতে’র পাতা ওলটাতে গিয়ে, উপন্যাসটির উপস্থাপনা এবং অপার অভিনবত্ব কারও চোখ এড়িয়ে যাওয়ার মতো নয়। গ্রন্থটির ভূমিকা পড়ে মনে হতে পারে, এটির হারিয়ে যাওয়া কোন জনপদের ইতিহাস। কিন্তু কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পরই সেই ভ্রান্তির নিরসন ঘটে। স্থাপত্যবিদ্যায় পারদর্শী হতে আগ্রহী এক তরুণীর যাত্রা দিয়ে উপন্যাসটির সূচনা। পানাম নগরের জরাজীর্ণ অট্টালিকা দেখতে দেখতে সে অভিভূত হয় এবং এন্তার ছবি তোলে। আশ্চর্য হয়ে ভাবে, এতকাল আগে কীভাবে সম্ভব, গ্রিক বরাক, মুসলিম ও ঔপনিবেশিক ঘরানার স্থাপত্য শৈলীকে একত্রে ধারণ করার ক্ষমতা অর্জন? সে উত্তরও তরুণী পেয়ে যায় তার অনুসন্ধিৎসু মন দিয়ে। ইতিহাসবিদদের ধারণা যে, আঠারো শতকের শেষ দিকে বসতি শুরু হয়েছিল এখানে। আজ যে বাড়িগুলো রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধ অবস্থায় দেখা যায়, সেগুলো নির্মিত হয়েছিল অনেক পরে, ইংরেজ আমলে। প্রধানত বস্ত্র-ব্যবসায়ীরাই ছিলেন এসব অট্টালিকার মালিক। পানাম নগরে তাদের বসতি স্থাপনের মূল কারণ ব্যবসায়। এই অঞ্চলের মসলিনসহ নানা ধরনের কাপড়ের সুনাম ছিল দুনিয়াব্যাপী। ব্রহ্মপুত্র, মেঘনা ও শীতলক্ষ্যা নদ অঞ্চলটির কাছে থাকায়। মালামাল পরিবহনের সকল সুবিধা ছিল এখানে। লেখক শাহরিয়ার হোসেন এসব তথ্য আমাদের জানিয়েছেন উপন্যাসটির সূত্রধর তরুণী রোহিনীর কণ্ঠ দিয়ে। আমরা এও জানতে পারি, মুসলিম, খ্রিস্টান কিংবা বৌদ্ধ আমলের আগেও সোনারগাঁও কিংবা পানাম নগরীকে ঘিরে ছিল বিস্তৃত ও সমৃদ্ধ এক জনপদ। এই অঞ্চলের ঐতিহাসিক গুরুত্বের জন্যই এখানে বারো শতকে এসেছিলেন চীনের পরিব্রাজক মা-হুয়ান, তেরো শতকে মরক্কোর ইবনে বতুতা। এসব তথ্য জানতে জানতে আমরা রোহিনীর সঙ্গে অগ্রসর হই এবং নতুন চোখে পুরনো এলাকাটি আরেকবার মুগ্ধ চোখে দেখে নেই। দীর্ঘশ্বাস জমে বুকে। তবে তা দুঃখের না, এক ধরনের বিস্ময় ও আনন্দের। বেদনাটি শুধু হারিয়ে যাওয়ার! তরুণী রোহিনী আরো তথ্য সংগ্রহ করতে পরিচিত হন এক অশীতিপর বৃদ্ধের সঙ্গে; দোকানিরা অভয় দেন বুড়া দাদা আপনাকে অনেক কিছু বলতে পারবেন, যা এই এলাকার অনেকেই জানেন না, সুতরাং তার সঙ্গে যাওয়া বিফল হবে না। রোহিনীর কাছে এই ‘বুড়ো দাদা’কে ভালো ঠেকে না। কারণ এরকম বীভৎস চেহারার কোনো বুড়োকে সে জীবনেও দেখেনি। প্রকৃতপক্ষে রোহিনী যেমন এই উপন্যাসের সূত্রধর, বুড়োও তেমনি আরেক অধ্যায়ের ছুতো ধরিয়ে দেয় লেখককে, যা পাঠক ঘুণাক্ষরে আঁচ করতে পারেননি। প্রসঙ্গান্তরে কিংবা অধ্যায়ন্তরে যাওয়ার এই কৌশল সত্যিকার অর্থেই অভিনব এবং প্রশংসার দাবিদার। রোহিনী আমাদের নিয়ে গেল ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দের পানামনগরে। শুরু হলো আরেক কাহিনীর মানচিত্র গড়া। সঙ্গত কারণে হবু-স্থপতি রোহিনী এখানে নেই। তার বন্ধু, আর্কিটেকচার পড়াটা যার ভুল হয়েছে বলে মনে করে, সেই রাফিদও নেই। মোগড়াপাড়া বাসস্ট্যান্ডের কোলাহল এখানে সম্পূর্ণ অনুপস্থিত, রিকশার টুংটাং শব্দ খোঁজা অযৌক্তিক। কেননা, সালটা ১৯২৪। রিপোর্টাজ ভাষাও তাই বদলে যায়। আমরা অনুপ্রবেশ করি স্বর্ণবতীর সংসারে। ‘সুদীপ্ত, মহীয়সী রমণী তিনি। সহজাত গুণে মানুষের নজর কাড়েন। সাজসজ্জা যেমন তাঁর মার্জিত, চেহারাখানিও তেমন ভাস্কর। পরনের ঘিয়া সুতির শাড়িখানা তার কড়কড়ে হয়ে রয়েছে মাড়ের টানে। টকটকে লাল এর পাড়টি। ঘিয়া ব্লাউজখানার লম্বা হাতে মোটা লাল পাড়। তার শেষ প্রান্তে কুরুশের কাজ করা সাদা লেস। দু’হাত ভরা শাখা, পলা, লোহা আর স্বর্ণের চুড়ি-কঙ্কন সুর ধরেছে তার পায়ের তলে।’ [পৃষ্ঠা ২৭] অন্দরমহল থেকে পাঠকমহলকে নিয়ে আসা হয় বহির্জগতে; এখানকার অধিপতি পুরুষ। তিনি বিত্তবান ও দাপুটে। ‘লাগাম টেনে সজোরে ব্রেক কষে সুনিপুণ তরিকায় এক্কা গাড়িখানা থামাল কোচোয়ান পরেশ। ঘড়ঘড় করে কয়েকবার শ্বাস ফেলে ঘোড়াটি শান্ত হওয়ার আগেই লাফ দিয়ে নেমে কোচের দরজাখানা খুলে সে সরে দাঁড়াল। কর্তাবাবুর মেজাজ আজ ভালো, তবে কখন কী কারণে ক্ষেপে যান বলা মুশকিল। দুই যুগ ধরে কর্তাবাবুর খেদমত করে এই মুখ্য বিষয়টি হাড়ে হাড়ে উপলব্ধি করেছে পরেশ। দরজাটি ধরে নমনীয় কায়দায় ঘাড় নিচু করে সে কর্তার অপেক্ষায় রইল।’ [পৃষ্ঠা ৩২] সেই কর্তার নামটিও জানা হয়ে যায়; তিনি রাজেন্দ্রমোহন রায় চৌধুরী, পরেশের শীর্ণকায় কাঁধে ভর করে বিশাল বপুর এ মানুষটি নিত্য যাওয়া-আসা করেন। তার গাড়ির শব্দ পাওয়ামাত্র বাড়িতে কোলপাড় লাগাটা স্বাভাবিক। যাকে দিয়ে এই উপন্যাসের সূচনা, সেই রোহিনী ফিরে এল শেষ অধ্যায়ে। ফলে ঐতিহাসিক উপন্যাস হওয়ার অনেক সম্ভাবনা রহিত হয়ে যায়। মির্জা আযমকে নিয়ে একটি উপন্যাস লিখেছিলেন আবদুন নুর। ঐতিহাসিক উপাদান ছিল সেই গ্রন্থের। কিন্তু তিনি আর ধারাবাহিকতা বজায় রাখেননি। আমরা আশা করব লেখক ভবিষ্যতে এ ধরনের উপন্যাস যখন লিখবেন তখন কয়েকটি বিষয়ে তাঁর সচেতনতা আবশ্যক। প্রচ্ছদের ছবিটি কী রাজেন্দ্রমোহন-পরিবারের? তাহলে প্রচ্ছদপটের একটি পরিচিতি দরকার। এসব সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও লেখক-প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। বাংলা উপন্যাসে বিষয়-বৈচিত্র্যে সম্প্রতিককালে এক ধরনের দৈন্যদশা চলছে। বেশিরভাগ উপন্যাস রচিত হচ্ছে মধ্যবিত্ত পরিবারকেন্দ্রিক। সেই একই কাহিনী এবং পুনরুক্তি। এসব ডামাডোলের ভেতরে জনপ্রিয় হওয়ার লক্ষণ এই লেখকের মধ্যে আপাতত নেই, বোঝা যায় তিনি ভিন্নভাবে ভিন্ন একটি কাহিনী বলার চেষ্টা করেছেন। পুরনো দিনের কাহিনী বলা সহজ। কেননা, সব লেখকই গতদিনের গল্প লেখেন, কিন্তু সেই প্রাচীনগন্ধী-আবহ সৃষ্টি করতে পারেন ক’জন? গ্রন্থটির দ্বিতীয় সংস্করণে, উপন্যাসের অধ্যায় এবং রোহিনীর প্রত্যাবর্তন কতটুকু যুক্তিযুক্ত, লেখককে ফের ভেবে দেখতে বলব।
×