ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পাতাদের সংসার ॥ বৃত্ত ভেঙ্গে নতুনে

প্রকাশিত: ০৬:৩৩, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পাতাদের সংসার ॥ বৃত্ত ভেঙ্গে নতুনে

নামটা শুনে প্রথমে একটু অবাক হয়েছিলাম- ‘পাতাদের সংসার’; সেকি! পাতার আবার সংসার হয় না কি? তবে লিটলম্যাগের নাম বলে কথা। নামকে চটকদার করতে সম্পাদকের অভিসন্ধিতে অসম্ভবের অবতারণা ঘটতেই পারে। কিন্তু ‘পাতাদের সংসার, গল্প ও সাক্ষাৎকার সংখ্যা’ যখন হাতে এলো তখন এর ‘সূচী পাতা’টিতে নজর রাখতেই বোধের কুয়াশা অপসারিত হলো। ‘পাতাদের সংসার’ যেহেতু ‘সাহিত্য-সংস্কৃতি বিষয়ক কাগজ’ এবং সাহিত্য-সংস্কৃতি যদি হয় একটি মহীরুহ, তবে এই সংসারে যাঁরা ঠাঁই পেতেছেন তাঁরা ঐ মহীরুহের একেকটি পাতা তো বটেই। হতে পারে পাতাগুলোর (গল্পকারগণ) কোনটি নবীন কিংবা কোনটি অর্বাচীন, কোনটি সতেজ সবুজ, কোনটি ফ্যাঁকাশে হলদেÑ পাতা তো বটে। এবং এ পাতারা মহীরুহের যে ক্ষুদ্র ডালটিতে সংসার পেতে বসেছে সেখানে আমন্ত্রণ পেয়ে কিছু কথা বলতে, কিছু অভিজ্ঞতা বিনিময় করতে যাঁরা হাজির (সাক্ষাৎকার অংশে) তাঁরা যে মহীরুহের কেবল পাতা নয়, প্রস্ফুটিত বা প্রস্ফুটোন্মুখ পুষ্প বিশেষ তা তাঁদের অনেকেই ইতোমধ্যে সুপ্রমাণ করেছেন। ‘পাতাদের সংসার’ এর এ সংখ্যাটির প্রথমেই চোখে পড়বে প্রচ্ছদ। সম্পূর্ণ পত্রিকাটিতে যে যতেœর ছাপ প্রচ্ছদের নান্দনিকতা যেন তারই মুখবন্ধ। মানসম্মত কাগজে পরিষ্কার মুদ্রণে যে কাগজটি একই সঙ্গে ১৯টি সুলিখিত গল্প ও ১৮টি বিদগ্ধজনের সাক্ষাৎকার সম্বল করে সাহিত্য-সংস্কৃতির আসরে আবির্ভূত হয়েছে সে যে এ দরবারে তার যোগ্য আসন দাবি করবে তাতে আর সন্দেহ কি। ‘পাতাদের সংসার’ বিভূষিত হয়েছে যে পাতা সকল দ্বারা তার সব শিল্পমান ও উৎকর্ষ বিচারে নিখুঁত কিংবা সার্থক নাও হতে পারে, থাকতে পারে তাতে কোন ব্যর্থ নিরীক্ষার ব্যতিক্রমী প্রয়াস। তবে মোটের উপর পত্রিকাটির সম্পাদনা যে প্রশংসার দাবিদার তা এর গল্প বাছাই, প্রুফ দেখা, মুদ্রণ, সাক্ষাৎকার গ্রহণ, সূচীবিন্যাসÑ এককথায় পত্রিকাটির সার্বিক ব্যবস্থাপনা বিবেচনায় নিলে স্পষ্ট হয়। আনোয়ারা আজাদের ‘জীবিকা’ থেকে হোসনে আরা মণির ‘সাইনবোর্ড’ পর্যন্ত প্রতিটি গল্প ভিন্ন ভিন্ন বিশিষ্ট্যতায় সমুজ্জ্বল। গল্প নির্বাচনে সম্পাদক যেমন বৈচিত্র্য পিয়াসের প্রমাণ রেখেছেন তেমনি বিচিত্রতার স্বাক্ষর রেখেছেন তার সাক্ষাৎকারী ব্যক্তিত্ব নির্বাচনে। সাক্ষাৎকার অংশটি পাঁচভাগে বিন্যস্ত হয়েছে। কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক-গবেষক, কবি, ছড়াকার, চিকিৎসক ও প্রতিষ্ঠাতা শিরোনামের ভেতর যাঁদের সাক্ষাৎকার রয়েছে বিষয়ের সঙ্গে বয়স বিচারেও রয়েছে বৈচিত্র্য। ১৯২৯ সালে জন্মগ্রহণ করা আহমদ রফিক থেকে ১৯৮৪ সালে জন্ম হওয়া তরুণ কবি পিয়াস মজিদ পর্যন্ত বলেছেন তাঁদের জীবনে সাহিত্য রচনা, সাহিত্যাভিজ্ঞতা অর্জন, পুরস্কার গ্রহণ, লেখক মনন-চিন্তন প্রভৃতি ব্যাপ্তিময় বিষয়ে। অনিবার্যভাবে তাই ফুটে উঠেছে আমাদের সাহিত্যে গত দশকের মাঝামাঝি থেকে বর্তমান পর্যন্ত সময়ব্যাপী বদল ও বিবর্তনের ছাপচিত্র। শুধু লেখা নয়, লেখা ও লেখককে যুগপৎভাবে জানার মধ্য দিয়েই স্বচ্ছভাবে চেনা হয় আমাদের বিদ্যমান ও বিবর্তিত সমাজের নানা কাল-বাঁক, স্তর কাঠামোর ঘুণ, সমাজমানসের ক্ষয় ও পচন, এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রের নানাবিধ ভাঙ্গাগড়া উত্তোরণ ও অবক্ষয়ের প্রমাণপ্রতীম ইতিহাস। তাই দেখা যায় লেখার পাশাপাশি লেখককে নিয়েও পাঠকের কৌতূহল বিস্তর। এমনকি কখনও কোন লেখকজীবন তার লেখার চেয়েও অধিক পঠিত হয়ে থাকে। সাক্ষাৎকার যদিও জীবনী নয়, কিন্তু জীবনের সারাৎসারের কিছু চুম্বক অংশ যে তাতে বিম্বিত হয় না এমন তো নয়। তাই পাঠক অদম্য কৌতূহল নিয়ে পাঠ করে থাকেন তার প্রিয় কবি-লেখক-ব্যক্তিত্বের সাক্ষাৎকার। আমাদের ‘পাতাদের সংসার এর গল্প ও সাক্ষাৎকার সংখ্যা’ পাঠকের এ চিরন্তন আগ্রহে কিছুটা হলেও তৃপ্তি যোগাতে সক্ষম। এ রকম সংখ্যা বহুসংখ্যক প্রকাশিত হলে তা বাংলা সাহিত্যপিপাসু পাঠকের পাঠতৃপ্তির পাশাপাশি জানাশোনার গ-িকে বিস্তৃত করে জ্ঞানকে করবে বহুমুখী এবং নবীন লেখকের জীবনাভিজ্ঞতায় সংযোজন করবে ভিন্ন ভিন্ন বোধের নানাবিধ মাত্রা, যা তার বুদ্ধিকে খানিকটা হলেও করবে শাণিত ও শীলিত। কেননা এ সময়ের অন্যতম কথাসাহিত্যিক জাকির তালুকদারের কথায় ‘একজন নতুন লেখককে প্রথম দিকে প্রচুর অবমাননা বা লাঞ্ছনার ভেতর দিয়ে যেতে হয় বা সারাজীবন যেতে হয়।’ এ উক্তিকে সত্য বলে মেনে বিভিন্ন লেখকের জীবনাভিজ্ঞতা পাঠ নবীন লেখকের নিজ জীবনের তিক্ততা বোধ কিছুটা হলেও প্রশমিত করতে এবং সৃষ্টির আনন্দেমত্ত মানসের প্রশান্তি জিইয়ে রেখে তাকে নবসৃষ্টিতে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম হতে পারে বৈকী। বস্তুত নবীন লেখককে অনুপ্রেরণা যোগাতে, সাধারণ পাঠককে পাঠের আনন্দ দিতে এমন একটি পত্রিকার যে অনস্বীকার্য অবদান আছে তা স্বীকারে কার্পণ্য না করে আমরা ‘পাতাদের সংসার’ এর বহুল প্রচার কামনা করতেই পারি।
×