ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

লে. কর্নেল (অব.) ডা. নুরুল হুদা

সাজেক ভ্যালি

প্রকাশিত: ০৬:২৬, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সাজেক ভ্যালি

অন্যান্য বারের মতো এবারও বেরিয়ে পড়লাম ভ্রমণে আমার তিন ফ্যামিলি সংবলিত ৭ (সাত) সদস্যের একটি ভ্রমণপিপাসু দল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পার্বত্য চট্টগ্রামের বান্দরবন নীলগিরি, নীলাচল... মেঘলা শৈলপ্রপাত এবং খাগড়াছড়ির প্রাকৃতিক সৌন্দর্যময় সাজেক ভ্যালি দেখার জন্য। আমরা যথারীতি গত নবেম্বর মাসের ২৫ তারিখ রাত ১০টায় সেন্টমার্টিন এসি কোচে যাত্রা শুরু করি। ২৬ নবেম্বর ভোর ৭টায় আমরা বান্দরবান পৌঁছি। নীলগিরি ভ্রমণ বান্দরবান সেনানিবাসের অফিসার্স মেসে প্রাতঃরাশ সম্পূর্ণ করে আমরা নীলগিরির উদ্দেশে রওনা দেই। আগে থেকেই ‘চাঁদের গাড়ি’ নামক একটি জীপ যাহা নীলগিরি ও অন্যান্য পাহাড়ী এলাকার স্থানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখার সুবিধার্থে খোলা জীপ আমাদের জন্য প্রস্তুত ছিল। বান্দরবান থেকে নীলগিরি ৪৭ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত পাহাড়ের ওপর দিয়ে চলা আঁকাবাঁকা সর্পিল সরু পথে আমরা কিছুটা ভয় ও কিছুটা অনাবিল আনন্দে পুলকিত হয়ে স্বপ্নের নীলগিরির সৌন্দর্য দেখা ও উপভোগ করার জন্য যাত্রা শুরু করলাম। প্রায় ২ ঘণ্টার বেশি সময় লাগল নীলগিরি পৌঁছুতে। বান্দরবান থেকে নীলগিরি যাওয়ার পথে আমরা উপভোগ করলাম প্রকৃতির নৈসর্গিক সৌন্দর্য ও মনোরম দৃশ্য। পাহাড়ের এই আঁকাবাঁকা পথের দু’পাশেই রয়েছে গভীর বিপদ সঙ্কুল খাদ। পড়ে গেলে বাঁচার কোন উপায় নাই। আল্লাহর অশেষ কৃপায় আমরা ঠিকমতোই নীলগিরি পৌঁছে গেলাম। নীলগিরি পৌঁছে আমরা পূর্ব থেকে রিজার্ভ করা তিনটি বাংলোতে অবস্থান গ্রহণ করলাম। দুপুরের খাবার গ্রহণ শেষে আমরা বেরিয়ে পড়লাম সমতল ভূমি থেকে প্রায় ২৫০০ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত নীলগিরি দর্শনে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই নীল পাহাড়ের চূড়াটি প্রায় ১০ হাজার স্কয়ার ফুট এলাকা নিয়ে অবস্থিত। সেখানে রয়েছে অপূর্ব ও নয়নাভিরাম দৃশ্য ও সৌন্দর্য। নীলগিরির চূড়ায় রয়েছে ৬/৭টি অত্যাধুনিক কটেজ (বাংলো)। সেনাবাহিনীর ৫৯ পদাতিক কর্তৃক নির্মিত এই সুন্দর কটেজগুলো নির্মাণ করা হয়েছে পাহাড়ের চূড়ার ৩টি স্তরে বিন্যাস্ত করে। নীলগিরির সবচেয়ে উঁচু স্তরে স্থাপন করা হয়েছে ডাইনিং হলটি। সেখানে ভ্রমণকারীগণকে খাওয়া-দাওয়া পরিবেশন করান হয়। তার থেকে প্রায় ২০ ফুট নিচে ২ স্তরে নির্মাণ করা হয়েছে ২টি কটেজ এবং তারচেয়ে ১০-১৫ ফুট নিচে ৩য় স্তরে রয়েছে আরও ৪টি কটেজ। সর্বমোট ৭টি স্থাপনা রয়েছে ডাইনিং হলসহ। এরপরেও আরও কটেজ নির্মাণাধীন রয়েছে এবং নীলগিরির সৌন্দর্য বৃদ্ধির কাজ অব্যাহত রয়েছে। নীলগিরির উঁচু চূড়ায় দাঁড়িয়ে নিচে তাকালে দেখা যাবে শুধু নীল আর নীল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত পাহাড়ে এই নীলের সমারোহের জন্যই এই পাহাড়টি নীলগিরি নামে খ্যাত। আমরা নীলগিরির চূড়ায় দাঁড়িয়ে সন্ধ্যায় পূর্ণ পূর্ণিমার চাঁদ (ফোল মুন) উদয়ের নয়নাভিরাম দৃশ্য অবলোকন করলাম (এখানে একটি কথা বলে রাখা ভাল যে নীলগিরি দর্শনের সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হলো ‘পূর্ণিমার সময়’) তারপর যতই রাত বাড়ছিল ততই নীলগিরির সৌন্দর্য আরও বেশি প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছিল। নীলগিরির দৃশ্যটা এমনÑ একদিকে আকাশে ভরা পূর্ণিমা চাঁদের এই মনোমুগ্ধকর ও নয়নাভিরাম আলোর খেলা অন্যদিকে চাঁদের এই সৌন্দর্যময় আলোর বিচ্ছুরণ নীলগিরি চতুর্পার্শ্বস্থ পাহাড়ের ওপর ঘন কুয়াশার চাদরাচ্ছাদিত দৃশ্য নিজে না দেখলে ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। কুয়াশাচ্ছান্নিত নীলগিরিকে মনে হচ্ছিল সাগরের নীল পানি কিংবা মেঘ সমগ্র পাহাড়কে চাদর দ্বারা আচ্ছাদিত করে রেখেছে যা সরাসরি না দেখলে বোঝা যায় না। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা এই নৈসর্গিক দৃশ্য অবলোকন করলাম। পরের দিন খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠেই আমরা নীলগিরির সূর্যোদয়ের দৃশ্য দেখার জন্য ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। সে আর এক নয়নাভিরাম দৃশ্য। ঘন কুয়াশার আস্তরণের মধ্য থেকে এক অজানা স্থান থেকে যেন নীলগিরির সূর্যোদয়ের অকল্পনীয় সৌন্দর্য দর্শন করলাম। নীলগিরি ভ্রমণে গিয়ে আমরা আর একটি বিষয় জানতে পারলাম। বান্দরবানের মতো নীলগিরিতে পিডব্লিউ বা পল্লী বিদ্যুতের ব্যবস্থা নাই। নেই কোন ওয়াসার পানি সরবরাহ। তাই সেখানে সেনাবাহিনীর নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় জেনারেটরের মাধ্যমে সীমিত আকারে সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত এবং রাত ১০টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত সোলার বিদ্যুতের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই ব্যবস্থাপনা বেশ কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। প্রায় ২০০ ফুট নিচে গভীর নলকূপ থেকে শক্তিশালী মোটরের সাহায্যে পানি উত্তোলন করে (২য় স্তর) মাঝামাঝি একটি বড় ছড়ায় (মানে পানি জমানোর চৌবাচ্চা) পানি জমানো হয়। সেখান থেকে ৩য় স্তরে জেনারেটরচালিত শক্তিশালী পানি উত্তোলন মোটরের সাহায্যে নীলগিরির বিভিন্ন স্থাপনায়/কটেজে পানি সরবরাহ করা হয়। যা হোক নীলগিরির দর্শন ছাড়াও আমরা বান্দরবানের আরও অনেক দর্শনীয় স্থান যেমন নীলাচল, শৈলকুপা, চিম্বুকও দর্শন করলাম। নীলগিরির এই সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ শেষে আমরা প্রায় দুপুর ২টায় পুনরায় বান্দরবান পৌঁছি। সাজেক ভ্যালি সেখান থেকে সেনাবাহিনীর অফিসার মেসে দুপুরের খাবার শেষ করে বিকেলেই আমরা খাগড়াছড়ির উদ্দেশে রওনা দেই। খাগড়াছড়ি অফিসার মেসে পূর্ব থেকে আমাদের জন্য ৩টি রুম বুক করা ছিল। সেখানে রাত্রিযাপন করে পরের দিন ভোরে (২৭ নবেম্বর ’১৫) পার্বত্য অঞ্চলের আরও একটি সুন্দর দর্শনীয় স্থান ‘সাজেক ভ্যালি’ দেখার উদ্দেশে একটি মাইক্রোবাস যোগে যাত্রা শুরু করি। সাজেক ভ্যালি খাগড়াছড়ি থেকে ৬৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। প্রায় ৩ ঘণ্টার ভ্রমণ। সাজেক ভ্যালি যাওয়ার রাস্তাটি নীলগিরির রাস্তার মতো এত আঁকাবাঁকা ও বিপদসঙ্কুল নয়। দুদিকে উঁচু-নিচু পাহাড় পাশে গভীর খাদ তার মধ্য দিয়ে আঁকাবাঁকা রাস্তায় চলল আমাদের মাইক্রোবাস। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও মনোরম দৃশ্য অবলোকন করতে করতে আমরা যখন সাজেক ভ্যালি যাচ্ছি তখন রাস্তার পাশে অনেক পাহাড়ী বাড়ি থেকে ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা আমাদের মাইক্রোবাসের দিকে দৌড়ে এসে খুশিতে আমাদের হাত নেড়ে স্বাগত জানাচ্ছিল। আমরাও তাদের উপহারস্বরূপ মাইক্রোবাস থেকে চকোলেট, বিস্কুট ও অন্যান্য শুকনো খাবার ছুড়ে উপহার দিয়েছি। এই সামান্য উপহার পেয়ে তারা যারপরনাই খুশিতে আত্মহারা। এখানে উল্লেখ, এসব দর্শনীয় পাহাড়ী অঞ্চলে ভ্রমণ করার সময় ছোট শিশু ও ছেলে-মেয়েদের জন্য চকোলেট, বিস্কুট নিয়ে গেলে ভাল। সাজেক ভ্যালি সম্বন্ধে দুটি কথা ॥ সাজেক ভ্যালি একটি উপত্যকা যা সাজেক ভ্যালি নামে পরিচিত। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ১৮২৫ ফুট উঁচু এই উপত্যকায় রয়েছে বেশকিছু দর্শনীয় স্থান যেমন সাজেক রিসোর্ট, সাজেক অফিসার্স মেস (রিজিওনাল বল পিয়া), রুন্ময় রিসোর্ট ও ক্যান্টিন। তাছাড়া রয়েছে সিভিল রিসোর্ট, স্টোনময় গার্ডেন একটি ছোট ঝর্ণার নাম হাজাছড়ি ঝর্ণা পার্বত্য চট্টগ্রামের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত দর্শনীয় স্থানগুলোতে ভ্রমণ শেষ করে আমরা ২৯ নবেম্বর ঢাকা চলে এলাম।
×