গাফফার খান চৌধুরী ॥ এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় পলাতক চার বিদেশী ও লন্ডনপ্রবাসী দুই বাংলাদেশীর বিরুদ্ধে ইন্টারপোলে রেডওয়ারেন্ট জারির প্রস্তুতি চলছে। এ সংক্রান্ত আলোচনা চলছে স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাসগুলোতেও। মামলা তদন্তের স্বার্থে পলাতক আসামিদের পাওয়া জরুরী। গ্রেফতারকৃত পোল্যান্ডের নাগরিক পিওটর স্কেজেভান মাজুরেকের দেয়া তথ্য যাচাই করতেই এমন প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। এটিএম কার্ড জালিয়াতির ঘটনায় গ্রেফতারকৃত চারজনকে জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে প্রতারণার কবলে পড়া নতুন নতুন বেসরকারী ব্যাংক, চেন শপ, ট্রাভেল এজেন্সি, হুন্ডি ও ঢাকার বেশ কয়েকটি আবাসিক হোটেল ব্যবসায়ীর নাম। চক্রটি গত এক বছরে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ১৬শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
মামলার তদন্ত সংস্থা পুলিশের কাউন্টার টেররিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম এমন পিলে চমকানোর মতো তথ্যই জানালেন। তিনি আরও জানান, পুরো জালিয়াত চক্রটির সঙ্গে পলাতক লন্ডনপ্রবাসী দুই বাংলাদেশীর নাম বেরিয়ে এসেছে। এছাড়া পলাতক চার বিদেশী সম্পর্কে তথ্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে দুই বিদেশী সম্পর্কে ব্যাপক তথ্য দিয়েছে গ্রেফতারকৃতরা। তাদের গ্রেফতার করতে ইন্টারপোলের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। শনাক্ত হওয়া বিদেশীরা রুমানিয়া, বুলগেরিয়া ও ইউক্রেনের নাগরিক। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট দেশে দূতাবাসগুলোর সঙ্গে আলোচনা চলছে। গ্রেফতারকৃত বিদেশী বিশ্বের ৩-৪ দেশে মোস্টওয়ান্টেড। চক্রটি গত এক বছরে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১৬ বিলিয়ন ইউএস ডলার অর্থাৎ বাংলাদেশী প্রায় ১৩শ’ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকেই অন্তত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। যদিও এর পরিমাণ আরও বাড়তে পারে। কারণ পিওটর নিজেই জানে না সে এখন পর্যন্ত গত বছরে কত টাকা এটিএম বুথ থেকে তুলে নিয়েছে।
মনিরুল ইসলাম বলছেন, গত এক বছর ধরে চক্রটি বাংলাদেশে সক্রিয়। এ চক্রটি এটিএম কার্ড ছাড়াও ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড জালিয়াতির সঙ্গেও জড়িত। এছাড়া কার্ড দিয়ে কেনাকাটা করতে ব্যবহৃত পস মেশিন সরবরাহ ও ব্যবহারকারীরা এর সঙ্গে জড়িত। এ চক্রে পস মেশিন সরবরাহকারী, ব্যবহারকারী, সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের অসাধু কর্মকর্তাদের সহায়তায় চক্রটি বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। এসব টাকা ৫ থেকে ৭ লাখ করে একটি চালান হিসেবে হুন্ডির মাধ্যমে বাইরে পাঠিয়েছে। যেসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নামে এসব টাকা পাঠানো হয়েছে, তারা প্রকৃত পক্ষে সেই ব্যবসা করে না। এখন পর্যন্ত যাদের নাম প্রকাশ পেয়েছে তাদের গোয়েন্দা নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা যাতে দেশত্যাগ করতে না পারে এজন্য ছবিসহ বিশেষ বার্তা পাঠানো হয়েছে বিমানবন্দর ও সীমান্ত পয়েন্টগুলোতে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সবার আগে দুই বিদেশী এরপর আরও দুই বিদেশী এবং সর্বশেষ দেশ থেকে পালিয়ে যায় লন্ডনপ্রবাসী দুই বাংলাদেশী। জালিয়াতির ঘটনায় একটি বিদেশী ও সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা গ্রেফতারের পর বেরিয়ে আসছে এসব তথ্য। বেরিয়ে আসছে জালিয়াতির শিকার হওয়া নতুন নতুন বেসরকারী ব্যাংকের নাম। সেই তালিকায় যুক্ত হয়েছে বেসরকারী প্রাইম ব্যাংকের নামটিও।
জানা গেছে, চক্রটির সঙ্গে সিটি ব্যাংকের গ্রেফতারকৃত তিন কর্মকর্তা ছাড়াও বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের অনেক উর্ধতন কর্মকর্তার জড়িত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। সেসব কর্মকর্তার সম্পর্কে প্রাপ্ত তথ্য যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। এরপর শুরু হবে গ্রেফতার অভিযান।
গ্রেফতারকৃত বিদেশী পূর্ব ইউরোপের রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ থেকেও একইভাবে অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। মাজুরেকের কাছে জার্মান নাগরিকত্বের একটি পরিচয়পত্রও পাওয়া গেছে। ধারণা করা হচ্ছে মাজুরেক জার্মানি থেকে হয় প্রতারণা করে এসেছে, নতুবা বাংলাদেশ থেকে প্রতারণার উদ্দেশ্যে পালিয়ে জার্মানিতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। গ্রেফতার হওয়া পুরো চক্রটি এদেশে আদম ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিল।
সম্প্রতি জালিয়াতির ঘটনায় বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকে একের পর এক গ্রাহকদের তরফ থেকে অভিযোগ পড়তে থাকে। তারই প্রেক্ষিতে গত ১২ ফেব্রুয়ারি ইস্টার্ন ব্যাংক বনানী মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অন্তত ২১ গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এমন ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) একই থানায় একই ধরনের অভিযোগে একটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) একটি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়েছে। এরপর সেই তথ্য দিয়ে এটিএম কার্ড বানিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এ মামলার সঙ্গে এটিএম বুথে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত গ্রেফতারকৃত বিদেশীর ছবি দেয়া হয়। এছাড়া পল্লবী থানায় সিটি ব্যাংকের তরফ থেকে এমন অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরি করে একইভাবে কার্ড বানিয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্কিমিং ডিভাইসটি অন্তত ১২শ’ এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪০ কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিয়েছে চক্রটি। বাকি ১১শ’ ৬০টি কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এমন ঘটনার পর বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্রুত সব এটিএম বুথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে এক মাসের সময়সীমা বেঁধে দেয়। বুথগুলোতে নিরাপত্তা ডিভাইস বসাতে কড়া নিদের্শনা দেয়। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
তদন্তের ধারাবাহিকতায় গত ২১ ফেব্রুয়ারি এমন প্রতারণার সঙ্গে জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার করা হয় পোল্যান্ডের নাগরিক পিওটর স্কেজেভান মাজুরেক (৫০), সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ (৪৫), রেজাউল করিম শাহীন (৪০) ও রেফাত আহমেদ রনিকে (৪২)। তাদের ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। জিজ্ঞাসাবাদে বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর সব তথ্য।