ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বায়ান্ন বাজার তেপ্পান্ন গলি

মোরসালিন মিজান ॥ শুধু যে বৃষ্টি, তা নয়। শিলাবৃষ্টি। বসন্তের বর্ষণে ভিজে একাকার বায়ান্ন বাজার তিপ্পান্ন গলির শহর ঢাকা। হঠাৎ বৃষ্টি অনেকে উপভোগ করেছেন। দুর্ভোগও কম ছিল না। বিশেষ করে বলতে হয় অমর একুশের গ্রন্থমেলার কথা। এটি এখনও শহরের প্রধান আকর্ষণ। বুধবারের বৃষ্টি হানা দিয়েছিল এখানেও। রীতিমতো খাল বিল নদী নালা হয়ে গিয়েছিল মেলা প্রাঙ্গণ। বাংলা একাডেমি ও সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানÑ দুই অংশেই থৈ থৈ করেছে পানি। বৃষ্টির জলে ধুয়ে যাওয়া, ঝড়ে ল-ভ- প্রাঙ্গণ দেখে বুধবার শঙ্কা জেগেছিল মনে। এই মেলা কবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে? অনেকেই এমন প্রশ্ন মাথায় নিয়ে ঘুমোতে গেছেন। উত্তর জানা গেল বৃহস্পতিবার। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৫তম দিনে সেই আগের চেহারায় দৃশ্যমান হলো প্রাণের মেলা। প্রিয় প্রাঙ্গণ ঘুরে মন ভাল হয়ে যায়। গতদিন পুরো সময়টা পাওয়া হয়নি। পুষিয়ে নিতেই হয়ত আগে ভাগে এসেছিলেন প্রচুর বইপ্রেমী। দীর্ঘ লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে মেলায় প্রবেশ করেছেন। তারও আগে থেকে স্টল সংস্কার ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার কাজ করছিলেন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা। বিকেল তিনটায় মেলায় প্রবেশ করে দেখা যায়, অধিকাংশ স্টল খোলা। যথারীতি সাজিয়ে রাখা হয়েছে বই। একেবারে শুরুতেই ভিড় জমে যায় মেলার দুই অংশে। বই দেখা ও কেনার কাজ চলে। তবে হঠাৎ বৃষ্টিতে ভিজে নষ্ট হওয়া বই দেখে মন খারাপ হয়েছে। মেলার ইট বিছানো পথের দুই ধারে এসব বই শুকোতে দেয়া হয়েছিল। অনেকেই স্টলের সামনে ভেজা বইয়ের পাতা উল্টে রেখেছিলেন। বই নষ্টের হাত থেকে যতটা সম্ভব বাঁচাতে এই চেষ্টা। অবশ্য যাদের ভাল বুদ্ধিশুদ্ধি, তারা তেমন ক্ষতির মুখে পড়েননি বলে মনে হয়েছে। এ প্রসঙ্গে কথা হয় কাকলী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী এ কে নাসির আহমেদ সেলিমের সঙ্গে। তিনি জানান, এমন বাদল দিনের আশঙ্কা তিনি আগেই করেছিলেন। তাই স্টলের সব বই পলিথিন দিয়ে ভাল করে ঢেকে তার ওপর ইট চাপা দিয়ে রেখেছিলেন। এর ফলে তার কোন বই ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে জানান তিনি। অনিন্দ্য প্রকাশের আফজালও একই রকম তথ্য দেন। বলেন, পলিথিন দিয়ে সব বই ভাল করে বেঁধে রেখে গিয়েছিলাম। এ কারণে কোন ক্ষতি হয়নি। না, এমন দুই দশজন নয়, বহু প্রকাশক ঝড়- বৃষ্টির হাত থেকে নিজেদের বই রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছেন। অন্যদিকে কোন কোন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের বড় ক্ষতি হয়েছে। সময় প্রকাশনের স্টলে থাকা কয়েক শ’ বই ভিজে গেছে। এসব বই বিশেষ মূল্য ছাড়ে বিক্রির কথা ভাবছেন প্রকাশক। গ্রন্থমেলার সময়বৃদ্ধি বৃষ্টিতে ভেসে যাওয়া এক দিনের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সময় বাড়ানো হয়েছে মেলার। মেলা পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব ড. জালাল আহমেদ জানান, আজ শুক্রবার ও কাল শনিবার গ্রন্থমেলা সকাল ১১টার পরিবর্তে সকাল সাড়ে ১০টায় শুরু হবে। রবি ও সোমবার মেলা বেলা ৩টার পরিবর্তে শুরু হবে দুপুর ২টায়। শেষ হবে যথারীতি রাত ৮টায়। লেখক হত্যাকা-ের কালো দিন আজ লেখক ব্লগার অভিজিত রায় হত্যাকা-ের সেই কালো দিন আজ ২৬ ফেব্রুয়ারি। গত বছরের এই দিনে অমর একুশে গ্রন্থমেলা থেকে ফেরার পথে মৌলবাদী জঙ্গীদের হাতে নির্মমভাবে খুন হন প্রবাসী তরুণ। মুক্তমনা লেখকের রক্তে ভেসে যায় টিএসসির ফুটপাথ। আহত হন আরেক লেখক অভিজিতের স্ত্রী বন্যা। তবে, কালো দিনটি স্মরণে কোন কর্মসূচী নেই বাংলা একাডেমির। নতজানু নীতির একাডেমি এড়িয়ে গেলেও সাধারণ পাঠক আজ অভিজিতের আক্রান্ত হওয়ার স্থানে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবে বলে জানা গেছে। তোয়াব খান ও কামাল লোহানীর সঙ্গে কথোপকথন গ্রন্থ আকারে দুই পথিকৃৎ সাংবাদিক। একজন তোয়াব খান। অন্যজন কামাল লোহানী। উভয়ই স্বনামধন্য। যারপরনাই বিখ্যাত। কত যে ঘটনাবহুল জীবন! কত কত দেখা! ইতিহাসের সঙ্গে থেকেছেন। নিজেরা ইতিহাস রচনা করেছেন। অথচ তাঁদের সাংবাদিকতার জীবন, অভিজ্ঞতা বই আকারে আসেনি বললেই চলে। এই অভাবটুকু অনুভূত হচ্ছিল। আর তার পর গত বছর একটি কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেন পিআইবির মহাপরিচালক শাহ আলমগীর। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে আয়োজন করা হয়েছিল ‘অগ্রজের সঙ্গে কথোপকথন’ শীর্ষক অনুষ্ঠানমালার। সেই কথোপকথনে অংশ নেন তিনজন। কথোপকথনের চৌম্বক অংশ নিয়ে প্রকাশ করা হয়েছে দুটি পৃথক বই। অমর একুশে গ্রন্থমেলার ২৫তম দিনে বই দুটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। বাংলা একাডেমির নজরুল মঞ্চে অগ্রজ তোয়াব খান ও কামাল লোহানীর কথোপকথন নিয়ে প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রীর তথ্য উপদেষ্টা ইকবাল সোবহান চৌধুরী। এ সময় পিআইবির মহাপরিচালক শাহ আলমগীর, সাংবাদিক নেতা কুদ্দুছ আফ্রাদ, কবি রবীন্দ্রগোপ প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। মোড়ক উন্মোচন করে ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, কামাল লোহানী ও তোয়াব খান দুই প্রথিতযশা সাংবাদিক। আমাদের সাংবাদিকতার পথিকৃৎ। তাঁরা এখন আর ব্যক্তি হয়ে নেই। নিজেরাই এক একটি প্রতিষ্ঠান। কামাল লোহানী প্রগতিশীল চিন্তার অগ্রপথিক। স্বাধীন বাংলা বেতারের সংগঠক। এখনও তিনি বিভিন্ন প্রগতিশীল আন্দোলন সংগ্রামে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তোয়াব খানও আমাদের গুরুজন। অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের হাতেখড়ি হয়েছে তাঁর কাছে। এখন তাঁরা বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাপটের সঙ্গে কাজ করছেন। অগ্রজদের নিয়ে কর্মসূচী গ্রহণ ও বই প্রকাশের উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, এর ফলে দুই কীর্তিমানের বর্ণাঢ্য কর্মজীবন সম্পর্কে জানার সুযোগ পাবে আজকের প্রজন্ম। এর আগে শাহ আলমগীর বলেন, আমাদের দুই অগ্রজ সাংবাদিকের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতার কথা নিয়ে বই দুটি প্রকাশ করা হয়েছে। কামাল লোহানী অনেক বই লিখেছেন বটে। সাংবাদিকতা নিয়ে তেমন কোন বই তিনি লিখেননি। আর তোয়াব খান তো বরাবরই দুর্লভ। নিজের অফিসের বাইরে কোথাও যান না। কোন অনুষ্ঠানে চাইলেই পাওয়া যায় না তাঁকে। ‘অগ্রজের সঙ্গে কথোপকথন’ কর্মসূচীতে তাঁকে পাওয়াও সহজ ছিল না। কামাল লোহানীই আমাকে বলেছিলেন, তোয়াব খানকে পান কিনা দেখুন। আরও অনেকেই বলেছেন, পাওয়া যাবে না। আমরা শেষতক তাঁকে আনতে পেরেছিলাম। সেই কথোপকথনের অডিও হয়েছে। ভিডিও হয়েছে। আর এখন আসল বই আকারে। বই দুটির স্ক্রিপ্ট তোয়াব খান ও কামাল লোহানীর কাছে পাঠানো হয়েছিল। তাঁরা অনাপত্তি দেয়ার পরই প্রকাশ করা হয়েছে। প্রখ্যাত সাংবাদিক কলামিস্ট আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর কথোপকথন নিয়ে আরেকটি বই শীঘ্রই আসবে বলে জানান তিনি। বই দুটি বাংলা একাডেমির পুকুরপাড়ে অবস্থিত পিআইবির স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। আমাদের বাঁচার দাবি : ৬ দফার ৫০ বছর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৬ দফা প্রস্তাবের পঞ্চাশ বছর পূর্তি উপলক্ষে বাংলা একাডেমি সম্প্রতি প্রকাশ করেছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ রচিত গ্রন্থ ‘আমাদের বাঁচার দাবি : ৬ দফার ৫০ বছর’। বৃহস্পতিবার বিকেল একাডেমির আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ মিলনায়তনে গ্রন্থটির মোড়ক উন্মোচন করা হয়। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন ড. রেহমান সোবহান, অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, অধ্যাপক সৈয়দ আনোয়ার হোসেন, অধ্যাপক এম এম আকাশ এবং বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। গ্রন্থকারের অনুভূতি প্রকাশ করবেন অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদ। বক্তারা বলেন, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা ছিল মূলত বাঙালীর বাঁচার দাবি এক দফাÑ অর্থাৎ আমাদের স্বাধীনতা। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত অধ্যাপক হারুন-অর-রশিদের এই বই ছয় দফার পঞ্চাশ বছর পূর্তিতে দেশবাসীর জন্য এক বিশেষ উপহার। এর মধ্য দিয়ে পাঠক আমাদের জাতীয় ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা লাভ করবেন। বইটির মূল্য ২০০ টাকা। নতুন বই মেলায় নতুন বই এসেছে ৭৪টি। অনিন্দ্য প্রকাশনী থেকে এসেছে ‘পৃৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গল্প’। ভাষান্তর ও সম্পাদনা করেছেন মোস্তফা মীর। অ্যাডর্ন পাবলিকেশন থেকে এসেছে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের উল্লেখযোগ্য ১১টি গল্পের সঙ্কলন ‘বদলে যাওয়া ও অন্যান্য গল্প’। একই প্রতিষ্ঠান থেকে এসেছে মহাভারতকেন্দ্রিক উপন্যাস ‘অনার্যজন’। লিখেছেন আবুল কাসেম। মেলা মঞ্চের আয়োজন গ্রন্থমেলার মূল মঞ্চে অনুষ্ঠিত হয় ‘বাংলাদেশে নারী জাগরণ : সমস্যা ও সম্ভাবনা’ শীর্ষক আলোচনা অনুষ্ঠান। এতে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ড. মাসুদুজ্জামান। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন সুলতানা কামাল এবং মুহম্মদ শহীদ উজ জামান। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান। প্রাবন্ধিক বলেন, বাংলাদেশ যেভাবে অর্থনৈতিকভাবে অগ্রসর হচ্ছে, মধ্য আয়ের দেশে এসে পৌঁছেছে, তাতে বৈশ্বিক এবং অভ্যন্তরীণ প্রয়োজনের চাপেই বা চাহিদার নিরিখেই নারী জাগরণ ঘটবে। ইতোমধ্যে সেই সম্ভাবনা অনেকখানি উন্মুক্ত হয়েছে। নারী উন্নয়নের যেসব বৈশ্বিক সূচক প্রকাশ পাচ্ছে তাতে বিপুলভাবে নারী অগ্রগতির তথ্য মিলছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অর্থনীতি, রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন ইত্যাদি নানা ক্ষেত্রে নারী অগ্রগতির পথের রেখাটি সুস্পষ্ট। নারীদের নিজেদের যেমন তেমনি সরকার এবং সাধারণ মানুষেরও বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না যে সমাজের নানা ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। নারী সংগঠনগুলোও নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক বা নির্যাতনমূলক কোন ইস্যুতেই নীরব থাকছে না। একসময় যে ফতোয়ার ঘটনায় তোলপাড় ছিল দেশ, এখন সেই ফতোয়ার কথা তেমন শোনা যায় না। এ্যাসিড নিক্ষেপের ঘটনাও কমে এসেছে। এখন ধর্ষণের মতো ঘটনা প্রায়শই ঘটেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুসারে নারী নির্যাতনও বেড়েছে। তিনি বলেন, সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে এ অবস্থার পরিবর্তন হবে বলে আমরা আশা করি। সন্ধ্যায় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা নিয়ে আসে স্পর্শ, আরশিনগর এবং হামিবা সাংস্কৃতিক একাডেমির শিল্পীরা।
×