ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রেল বিদ্যুত জ্বালানি খাতে ঋণ প্রস্তাব যাচ্ছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংকে

প্রকাশিত: ০৫:২০, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রেল বিদ্যুত জ্বালানি খাতে ঋণ প্রস্তাব যাচ্ছে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যাংকে

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ প্রথম পর্যায়ে তিন খাতে ঋণ দিচ্ছে এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)। এগুলো হচ্ছে রেল, বিদ্যুত ও জ্বালানি। পরবর্তীতে যুক্ত হবে সড়ক অবকাঠামো খাত। তাই এসব খাতের প্রকল্প তৈরি করছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। প্রকল্প তৈরিতেই বিশেষ তদারিক করছে ব্যাংকটি। তবে কতটি প্রকল্পে কত টাকা পাওয়া যাবে সেসব বিষয়ে এখনও নিশ্চিত হয়নি বলে জানিয়েছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)। অন্যদিকে বাংলাদেশ নতুন এ ব্যাংকটির এখনও সদস্য হতে পারেনি এমন বিষয়টি ঠিক নয় বলে জানা গেছে। কেননা প্রথম পর্যায়েই এআইআইবির প্রতিষ্ঠাতা সদস্য পদ পায় বাংলাদেশ। সেই স্ট্যাটাসই বহাল রয়েছে এবং থাকবে। তবে শেয়ারমূল্য বাবদ ৬৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার পরিশোধ করা হচ্ছে শীঘ্রই। এর মধ্য দিয়ে সদস্য পদ পাকাপোক্ত হবে। ইআরডি বলছে এখনও চলতি বছরের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত এই শেয়ার মূল্য পরিশোধের সময় রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি এআইআইবির উদ্বোধনী অনুষ্ঠান থেকে ফিরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছিলেন বাংলাদেশ এখনও ব্যাংকটির স্থায়ী সদস্যপদ পায়নি। বিষয়টি পুরোপুরি ঠিক নয়। কেননা শুরুতেই এআইআইবি গঠনে যেসব দেশ স্বাক্ষর করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। তখনই ব্যাংকটি বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হিসেবে ঘোষণা দেয় এবং সকল কার্যক্রমে বাংলাদেশকে সম্পৃক্ত রাখে। কিন্তু বাংলাদেশ শেয়ারের অর্থ পরিশোধ না করলেও সদস্য পদ ঠিকই আছে। কারণ ব্যাংক থেকেই এখনও ২০১৬ সাল পুরোটাই এই অর্থ পরিশোধের সময়সীমা দেয়া আছে। তবে যেহেতু জাতীয় সংসদে আইনটি পাশ হয়েছে সেহেতু দ্রুতই শেয়ারের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের অতিরিক্ত সচিব ও এআইআইবির দায়িত্বপ্রাপ্ত আসিফ-উজ-জামানের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি। সূত্র জানায়, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক প্রকল্প প্রস্তুত করার ক্ষেত্রে প্রথম থেকেই তদারকি অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যেই ব্যাংকটির দুটি মিশন বাংলাদেশ সফর করেছে। তারা অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ এবং রেল, বিদ্যুত ও জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছে। কি ধরনের প্রকল্প হবে এবং প্রকল্প তৈরিতে কোন কোন বিষয়গুলোতে গুরুত্ব দিতে হবে সেসব বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছে। শীঘ্রই আরও একটি মিশন আসছে বাংলাদেশে। ব্যাংকটির মিশনের পরামর্শ অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলো এখন প্রকল্প তৈরির প্রাথমিক কাজ করছে। এরপরই সেগুলো চূড়ান্ত করে পাঠানো হবে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে। সেখান থেকে পাঠানো হবে এআইআইবিতে অনুমোদনের জন্য। অন্যদিকে এশিয়ান ইনফ্রাসট্রাকচার ব্যাংক (এআইআইবি) আইন ২০১৬ পাস করেছে সরকার। এ আইনের মাধ্যমে চীনের নেতৃত্বে গঠিত এ ব্যাংকে বাংলাদেশের নির্ধারিত শেয়ারের মূল্য পরিশোধসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। এজন্য জাতীয় সংসদে বিল আনা হলে সেটি সম্প্রতি অনুমোদন লাভ করে। এর আগে গত বছরের ২১ ডিসেম্বর এ আইনটি মন্ত্রিপরিষদ নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়। গত ১৯ জানুয়ারি আইন মন্ত্রণালয়ের লেজিস লেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগ থেকে ভেটিং সম্পন্ন হয়। জাতীয় সংসদের অনুমোদন পাওয়ায় পরবর্তী প্রক্রিয়া শেষ হলেই এআইআইবির শেয়ারমূল্য বাবদ ৬৬ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার দ্রুতই পরিশোধ করা হবে। উদ্বোধনী দিন পর্যন্ত ব্যাংকে অংশগ্রহণকারী ৫৭টি দেশের মধ্যে মাত্র ৩০টি দেশ নির্ধারিত শেয়ারমূল্য পরিশোধ করেছিল। বাকি ২৭টি দেশ এখন শেয়ারের মূল্য পরিশোধ করছে। ইআরডির দায়িত্বশীল একটি সূত্র জানায়, এ আইন পাস হওয়ায় এআইআইবির শর্ত প্রতিপালন করতে সহজ হবে। উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন যেমন ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যদি এআইআইবির অফিস হয় তাহলে সেখানে কর্মরতরা এদেশে কোন আয়কর দেবেন না। এটি অন্য সব উন্নয়নসহযোগী সংস্থার ক্ষেত্রেও রয়েছে। এছাড়া ভবিষ্যতে যদি এআইআইবি থেকে কোন অর্থ পাওয়া যায় তাহলে সে অর্থ কোথায় থাকবে। এজন্য এ আইনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংককে ডিপজিটরি ব্যাংক করা হয়েছে। এ রকম বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে এ আইনের মাধ্যমেই। এআইআইবির সদস্য হতে বাংলাদেশকে দিতে হবে ৬৬ কোটি ৫০ লাখ ডলার। এর মধ্যে পরিশোধিত মূলধন হিসেবে ১৩ কোটি ২১ লাখ ডলার এবং ৫২ কোটি ৮৪ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে অপরিশোধিত (কলেবল) মূলধন হিসেবে। গত জানুয়ারি মাসে এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের (এআইআইবি) আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ও প্রধানমন্ত্রী লি কে কিয়াং উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতও যোগ দেন ওই অনুষ্ঠানে। ব্যাংকের প্রথম প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করছেন চীনের সাবেক অর্থমন্ত্রী জিন লিকুয়ান। বেজিংয়ে সংস্থার সদর দফতরে ওই অনুষ্ঠানে ১২ জনকে পরিচালক হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। সূত্র জানায়, দশ হাজার কোটি ডলার মূলধন নিয়ে চীনের নেতৃত্বে এআইআইবি গঠিত হয় ২০১৪ সালের ২৪ অক্টোবর। এরপর ২০১৫ সালের জুনে বাংলাদেশসহ ৫০টি সদস্য দেশ চুক্তি সই করে। চীনের পাশাপাশি ভারত, রাশিয়া, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া এআইআইবির শেয়ারহোল্ডার। বাংলাদেশসহ এর সদস্য হচ্ছে ৫৭টি দেশ। এশীয় ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোকে অবকাঠামো উন্নয়ন ও সংযোগ স্থাপনে ঋণ ও অর্থ সহায়তা দেয়াই এআইআইবি গঠনের উদ্দেশ্য। শুরুর দিকে এশিয়ার পরিবহন, জ্বালানি, টেলিযোগাযোগ ও অন্যান্য অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগ করবে। সূত্র জানায়, এআইআইবির সদস্য ৩০টি দেশের মধ্যেই রয়েছে মোট মূলধনের ৯৩ দশমিক ৯৯ শতাংশ। ৬ দশমিক ৯৯ শতাংশ এখনও বাকি আছে। সবচেয়ে বেশি মূলধন চীনের ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ। এছাড়া ভারতের ৮ দশমিক ৪, পাকিস্তানের ১ দশমিক ২ ও বাংলাদেশের শূন্য দশমিক ৭ শতাংশ। দক্ষিণ এশিয়ার অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর বিশ্বব্যাংকের গত বছরের এক সমীক্ষায় বলা হয়, আগামী ১০ বছরের প্রতিটি বছরে বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগের দরকার ৭০০ থেকে এক হাজার কোটি ডলার। অর্থাৎ ১০ বছরে মোট দরকার পড়বে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার কোটি ডলার, যা স্থানীয় মুদ্রায় ৭ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। এ আইআইবি প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন এর আগে জনকণ্ঠকে বলেছিলেন, বাস্তবতা মানতে হবে। চীন যে এখন অর্থনৈতিক শক্তি, আইএমএফই তো সেই স্বীকৃতি দিয়েছে। একসময় যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল দুই পরাশক্তি। এখন সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই, সেই যুক্তরাষ্ট্রও নেই। তিনি বলেন, যে বিবেচনাতেই গঠিত হোক না, এআইআইবি বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদই হবে। কারণ অবকাঠামো খাতের উন্নয়নে বাংলাদেশের বিপুল বিনিয়োগ দরকার, যা বিশ্বব্যাংক, এডিবি বা আইডিবির অর্থায়নে চাহিদা মেটানো সম্ভব নয়।
×