ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

ড. আর এম দেবনাথ

টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন ॥ যাতায়াত ব্যবস্থায় মাইলফলক

প্রকাশিত: ০৪:০৭, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

টঙ্গী-ভৈরববাজার ডাবল লাইন ॥ যাতায়াত ব্যবস্থায় মাইলফলক

ভীষণ ভাল একটা খবর পড়লাম কাগজে। ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের প্রায় অর্ধেকের ডাবল লাইনের কাজ শেষ হয়েছে। টঙ্গী-ভৈরব বাজারের ডাবল লাইনের উদ্বোধনের কথা ২৫ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার। এটা কত বড় গুরুত্বপূর্ণ খবর তা বুঝিয়ে বলার নয়। নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রামের জনসাধারণের জন্য এটা বিশাল খবর। শুধু তাদের কথা বলি কেন, এ খবর সারাদেশের জন্যই ভাল খবর। মানুষের যাতায়াতের সময় হ্রাস পাবে, ঢাকা-চট্টগ্রামের মধ্যে সব পরিবহনের সময় হ্রাস পাবে। এতে বাড়বে দক্ষতা এবং উপযোগিতা। কম কথা, ছয় ঘণ্টার মধ্যে এখন লাগবে মাত্র ৪ ঘণ্টা। কাগজে দেখলাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘ভিডিও’ কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে বৃহস্পতিবার এই ডাবল লাইনের শুভ উদ্বোধন করবেন। মোট রাস্তা মাত্র ৬৪ কিলোমিটার। এতে কাজের কাজ যা হয়েছে তা হচ্ছে ট্রেন চলবে ১০০-১২০ কিমি বেগে। এছাড়া স্টেশনে স্টেশনে ক্রসিংয়ের জন্য অপেক্ষা করার পালা আর থাকবে না। ভীষণ বিরক্তিকর এই অপেক্ষার পালা। কখন আসবে ওদিককার ট্রেন। ‘সিগন্যাল’ দেয়া হয়েছে কীনা- তার অপেক্ষা। মানুষের ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যায় অনেক সময় যখন বিপরীতগামী ট্রেনের খবর থাকে না। আশার কথা টঙ্গী-ভৈরব বাজার সেকশনে এই অপেক্ষার পালা শেষ। ঢাকা-চট্টগ্রামের প্যাসেঞ্জারদের বড় সুখবর। বলা হয়েছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম সেকশনের এই মুহূর্তে ‘সেকশনাল ক্যাপাসিটি’ ৪৪টি। বাস্তবে ট্রেন চলাচল করছে দুটো বেশি-৪৬টি। এর মধ্যে ২২টি আন্তঃনগর, ১৮টি মেইল/একপ্রেস ও ৬টি কনটেইনার ট্রেন। যেহেতু সেকশনাল ক্যাপাসিটি বৃদ্ধি পেয়েছে তাই এখন ট্রেন চলবে ৮৪টিÑ অর্থাৎ প্রায় দ্বিগুণ। এতে বাংলাদেশ রেলওয়ের আয় যে বাড়বে তা বলাই বাহুল্য। আয় আরও বাড়বে ঢাকা-চট্টগ্রাম রুটের বাকি ৭০ কিমি রেলওয়েকে ডাবল লাইনযুক্ত করা গেলে। খবরে দেখলাম দেশের সকল সিঙ্গেল লাইন আস্তে আস্তে ডাবল লাইনে রূপান্তর করা হবে। আর নতুন লাইন সব হবে ডুয়েল গেজ ও ডাবল লাইনের। এখানে উল্লেখ্য, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ শুধু দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ নয় এর সুবিধা পাবে আন্তর্জাতিক সংস্থাসহ ভারত, নেপাল ইত্যাদি দেশ। বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই আন্তর্জাতিক কানেকটিভিটির ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। অতএব এই রেলপথের উন্নয়নে কানেকটিভিটি গড়ে তুলতে ভীষণ সাহায্য করবে। টঙ্গী-ভৈরব বাজারের ডাবল লাইন উদ্বোধনে দেশের যাতায়াত ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক যোগ হবে। এ উপলক্ষে আমি যারপরনাই খুশি। আমার ধারণা কিশোরগঞ্জের লোকেরা খুশি হবে আরও বেশি। ছাত্রজীবনে যখন ঢাকা-কিশোরগঞ্জ যাতায়াত করেছি তখন বড়ই কষ্ট হতো। কিশোরগঞ্জ থেকে ভৈরব বাজার আসা, এসে ট্রেনের ইঞ্জিন বদল। অপেক্ষা আর অপেক্ষা। তারপর ঢাকার উদ্দেশ্যে যাত্রা আর স্টেশনে স্টেশনে ক্রসিংয়ের বিড়ম্বনা। কয়েক দশক পর সেই ক্রসিংয়ের বিড়ম্বনা থেকে সবাই মুক্ত হবে। এখন কিশোরগঞ্জের লোকদের যাতায়াতের অনেক সুবিধা। ঢাকা থেকে উত্তরা দিয়ে রাজেন্দ্রপুর পরে কাপাসিয়া। তারপর টোক-মঠখোলা-পাকুন্দিয়া হয়ে কিশোরগঞ্জ। আরেক রাস্তা নরসিংদী ইটাখোলা হয়ে শিবপুর-মনোহরদী। তারপর কটিয়াদী হয়ে কিশোরগঞ্জ। আগে ছিল শুধু ট্রেনে যাতায়াত। সারাদিন লাগত। সকাল ১০-১১টায় যাত্রা কিশোরগঞ্জ-মানিকখালী থেকে। সন্ধ্যায় পৌঁছা ঢাকা। ‘জান’ বেরিয়ে যেত। তবু উপায় ছিল না। মাঝে মাঝে থাকত কানেকটিং ট্রেন। আরও বিড়ম্বনার বিষয়। এখন সরাসরি ট্রেন আছে, কানেকটিং ট্রেন আছে, উপরন্তু হয়েছে দুটো রাস্তা। একটা কাপাসিয়া দিয়ে, আরেকটা নরসিংদী দিয়ে। অধিকন্তু যে কেউ ভৈরব নেমে এখন বাসে কটিয়াদী হয়ে কিশোরগঞ্জ যেতে পারে, মাঝে পড়বে বাজিতপুর। এই যে রাস্তাঘাট ও ট্রেনের উন্নয়নের খবর এখানে দিলাম তা কিন্তু সারা বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। বাংলাদেশের উপজেলায় উপজেলায় এখন রাস্তা আর রাস্তা। একটা অঞ্চল ছিল যাতায়াতে অনুন্নত। সেটা হচ্ছে বরিশাল-খুলনা এলাকা। পদ্মা সেতু সেই অভাব পূরণ করবে, করবে ভালভাবেই। পদ্মা সেতু দ্বারা বৃহত্তর বরিশাল ও খুলনা অঞ্চল রাস্তা ও রেল দ্বারা সংযুক্ত হলে বাংলাদেশের জিডিপি এক থেকে দেড় শতাংশ বেড়ে যাবে। এটা এখন স্বপ্নের সেতু, নিজের টাকায় গড়া সেতু। আনন্দই ভিন্ন রকমের। এর আগে দেশের উত্তরাঞ্চল-রংপুর, দিনাজপুর ইত্যাদি এলাকায় ভাল ভাল রাস্তাঘাট হয়েছে। ফলে ঐ অঞ্চলের লোক এখন ঢাকায় দেখা যায়। তারা অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হচ্ছে। ঐ অঞ্চলের ‘মঙ্গা’ দূরীকরণে বঙ্গবন্ধু সেতু ও রাস্তাঘাট দারুণ উপকারে লেগেছে। আমি খুশি কেবল কিশোরগঞ্জ অঞ্চলের লোকসহ ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চট্টগ্রাম অঞ্চলের লোক উপকৃত নয় বলে; খুশি বর্তমান সরকার ‘রেলওয়েকে’ যথাযথ গুরুত্ব দেয়াতে। দীর্ঘদিন মনে হয়েছিল রেলপথ আর থাকবে না। দেখলাম রেল মন্ত্রণালয় উঠে গেল। আগে রেলের জন্য আলাদা বাজেট হতো। তা ধীরে ধীরে তুলে দেয়া হলো। স্টেশনগুলো তুলে দেয়া হলো। রেললাইন তুলে ফেলা হলো। চোখের সামনে এসব দেখলাম। ভেবে পাই না, এসব কী হচ্ছে, কার স্বার্থে এই আত্মঘাতী কাজগুলো করা হচ্ছে। পাশাপাশি দেখা গেল রাস্তাঘাট হচ্ছে আর বাস নামানো হচ্ছে। অনেকেই বললেন, বাসওয়ালাদের স্বার্থেই ট্রেনকে জলাঞ্জলি দেয়া হচ্ছে। কেন বলবেন না? দেখা যায়, নতুন নতুন ট্রেন চালু হলে, আন্তঃজেলা ট্রেন চালু হলে বাসওয়ালারা প্রতিবন্ধকতা তৈরি করেন, বিআরটিসি সস্তায় বাস দিলে অন্য বাসওয়ালারা প্রতিবাদ করেন। এই ডামাডোলে রেললাইন যায় যায়। শুধু কী ‘রেলওয়ে’, জলপথও হয় নিশ্চিহ্ন। চোখের সামনে নদীগুলো শুকালো। নদী দখল হলো, নদীতে বাঁধ দিয়ে মাছ চাষ করা শুরু হলো। নদীর ওপর দিয়ে রাস্তা করে জনবসতি গড়ে তোলা হলো। কেউ কিছু বলল না। আত্মঘাতী স্থানীয় রাজনীতিবিদরা কেন্দ্রীয় রাজনীতিবিদদের সহায়তায় এভাবে জায়গায় জায়গায় নদীপথগুলো নষ্ট করল। এসবের ফল কী? ফল পরিষ্কার। রেল ভ্রমণ সস্তা, বাসের তুলনায় ভীষণ সস্তা, আরামদায়ক এবং নিরাপদ। বাস ‘জার্নির ফল’ আমরা প্রায় প্রতিদিন দেখি। এমন দিন যায় না যেদিন কমপক্ষে ডজনখানেক লোকের প্রাণ যায় না। কোন প্রতিকার নেই। দোষী লোকদের কোন শাস্তি নেই। প্রতিদিন প্রাণ যাচ্ছে যাত্রীদের। ভাড়া তো অসম্ভব রকম বটেই। পালা-পার্বণের সময় বাস ভাড়া নির্যাতনের পর্যায়ে উঠে। এদিকে জলপথও ছিল সস্তা। এতে আমাদের যাতায়াত খরচ পড়ত কম। মালের ‘পড়তা’ পড়ত কম। ঢাকা থেকে নৌকায় ‘দুই ’শ মণি’, ‘এক ’শ মণি’ নৌকায় মাল যেত কিশোরগঞ্জে, সিলেটে, ভৈরবে। ভৈরব থেকে নৌকায় মাল যেত বিস্তীর্ণ অঞ্চলে। সিলেটের ধান আসত বৃহত্তর ময়মনসিংহের বিভিন্ন অঞ্চলে। ময়মনসিংহ থেকে কাঁচাপাট আসত নারায়ণগঞ্জ। ঢাকা থেকে মাল যেত নওয়াবগঞ্জে। বিশাল বিশাল নৌকা। কত সস্তা তার ভাড়া। চোখের সামনে এসব ব্যবস্থা উঠে গেল। আমরা হয়ে পড়লাম বাস-ট্রাকের ওপর নির্ভরশীল- যা সময়সাপেক্ষ যাতায়াত ব্যবস্থা এবং ব্যয়বহুল। অবহেলিত হলো রেলপথ এবং জলপথ (নৌপথ)। আশার কথা এই আত্মঘাতী নীতির পরিবর্তন হচ্ছে। রেলওয়ের উন্নয়নে সরকার মনোযোগ দিয়েছে। দেখা যাচ্ছে পাশাপাশি যাত্রীসাধারণের মধ্যেও রেল ভ্রমণের প্রতি আকর্ষণ বাড়ছে। ট্রেনের টিকেটের জন্য এখন লাইন দিতে হয়। আন্তঃজেলা ট্রেনের টিকেট পাওয়া যায় না। এটা শুভ লক্ষণ। সহজেই আমরা একটা কাজ করতে পারি। রেলপথ ডুয়েল গেজ করা হচ্ছে, ডাবল লাইন করা হচ্ছে। শাটল ট্রেনও হচ্ছে স্বল্প দূরত্বের জন্য। ময়মনসিংহ-ঢাকা, ভৈরব-ঢাকা, এমনকী ব্রাহ্মণবাড়িয়া-ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ-ঢাকার মধ্যে ঘন ঘন ট্রেনের ব্যবস্থা করা যায়। এটা কোন কঠিন কাজ নয়। বস্তুত এসব অঞ্চল থেকে লোকজন ‘ডেইলি প্যাসেঞ্জারি’ করতে পারে। মানুষ এখন বাসে-ট্রাকে দৈনন্দিন যাত্রা নির্বাহ করছে। একে ট্রেনের আওতায় আনা যায় সহজে। বিনিয়োগের সমস্যা হওয়ার কথা নয়। মানুষকে সেটা দিতে পারলে, ট্রেন দিতে পারলে মানুষ এর উন্নয়নের বোঝাও বহন করবে। ট্রেনের ভাড়া ৫-১০ বছর পর পর না করে নিয়মিতভাবে করা যায়, করা যায় সহনশীলভাবে। আমাদের অভিজ্ঞতা খারাপ। একবারে মাত্রাতিরিক্ত ভাড়া বৃদ্ধি করাই আমাদের অভ্যাস। এটা ত্যাগ করা উচিত। আমি জোরালোভাবে মনে করি ঢাকার আশপাশ অঞ্চলের সঙ্গে ঢাকাকে ট্রেন সার্ভিস দিয়ে মুড়িয়ে ফেলা যায় এবং তা দরকারও। এতে ঢাকার ওপর লোকের বোঝাও কমছে। আশপাশের অঞ্চল উন্নত হবে। বস্তুত ঢাকা-ময়মনসিংহ রেলপথের প্রতিটি স্টেশন ছোট ছোট স্যাটেলাইট টাউনে পরিণত হতে পারবে এবং তা সবার ক্ষেত্রেই সত্যি। সরকার কী এভাবে ভাবছে? না, ঢাকাকে বড় আরও বড় একটা শহরে পরিণত করার কথা ভাবছে? ঢাকার যাতায়াত ব্যবস্থা, ওড়ালপুল, খাওয়ার পানি ইত্যাদি খাতের টাকা দিয়ে ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জের রেল যোগাযোগ উন্নয়ন করলে কেমন হয়? লেখক : ম্যানেজমেন্ট ইকোনমিস্ট, সাবেক শিক্ষক ঢাবি
×