ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

মাননীয় মহাপরিচালক

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে খোলা চিঠি

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালককে খোলা চিঠি

বিনতি জানবেন। কুশল সমস্তই, আশা করি। বিব্রত করছি, মার্জনাপ্রার্থী। নিশ্চয় ব্যস্ত নানা কাজে, নাওয়া-খাওয়ারও ফুরসত নেই হয়ত। সকাল থেকে রাত অবধি বইমেলার নানা দেখভাল, হরেক ঝুটঝামেলাও সামাল দেওয়া শিবের বাপেরও অসাধ্যি। আপনি দিচ্ছেন, আন্তরিক সাধুবাদ। মনে হলো, ফেব্রুয়ারি ফুরিয়ে আসার আগেই চিঠি লেখা জরুরি। বিষয়টি ফেব্রুয়ারি বইমেলা নিয়েই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বইমেলা দেখেছি, দেখার সুযোগ হয় প্রায় প্রতিবছরই, এ ছুঁতোয়-ও ছুঁতোয়। বলা অতিরিক্ত, আমন্ত্রণে। উপলক্ষ কখনো পাঠ, কখনো বক্তৃতা। বাংলাদেশে বইমেলা দেখিনি, অন্তত বাংলাদেশে যতদিন ছিলুম। ১৯৭৪ সালে দেশ থেকে নির্বাসিত। দেখিনি ঠিকই, শুনেছি লোকমুখে, পড়েছি পত্রপত্রিকায় ইলাহি কা-, জমজমাট ব্যাপারট্যাপার। ভালো লাগে, গৌরবে ধনী হই। এই নিয়ে আবার বিদেশে বলি। শ্রোতৃকুল রীতিমতন বিস্মিত, যে-দেশে এখনো শিক্ষিতের হার শতকরা চল্লিশও নয়, নানা রঙ্গের বঙ্গে এক মাসব্যাপী বইমেলা? পাঠক কত, কত বই প্রকাশিত, সারাবছরই কী বই প্রকাশিত, মূলত কী ধরনের তথা কী কী বিষয়ক বই? প্রশ্নমালার সহজ উত্তর, কেবল মেলা নয়, বই ঘিরে পাঠকের উৎসব। এই উৎসবই পাঠক তৈরি করছে। দুনিয়াজুড়ে বইয়ের পাঠক পড়তির দিকে। খোদ আমেরিকায় শতকরা ১৮ জন অশিক্ষিত। ৮২ জনের মধ্যে পাঁচজনও বই পড়ে না, বই কেনে না। সংবাদপত্রের অবস্থা আরো খারাপ। পড়ার দরকার কি। টিভির খবর আছে, টিভির সিরিয়াল আছে। আমেরিকায় কোন জাতীয় সংবাদপত্র নেই, সবই লোকাল। দ্য নিউইয়র্ক টাইমস, দ্য ওয়াশিংটন পোস্টও। নিউইয়র্কেই দুই-তিনটির বেশি ভালো বইয়ের দোকান নেই। আর বইমেলা? ওসব বালাই মার্কিন কালচারের ধাতে নেই। বাংলাদেশ নানাদিক থেকে বিশ্বে ব্যতিক্রম এবং পয়লাও। একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর শোকের নয়, উৎসবের। একুশ উপলক্ষে একমাসের বইমেলা। ফেব্রুয়ারি মাসেই ৯৯ ভাগ বই প্রকাশিত, ক্রেতাও ফেব্রুয়ারি মাসে (স্কুল-পড়ুয়ার পাঠ্যবই কেনা ছাড়া)। শুনেছি (দেখিনি) বইমেলায় যাওয়া ফ্যাশনে পরিণত হয়েছে। বই-কালচারে গিয়ে তরুণ-তরুণীর মেলামেশা, খুনসুটি, প্রেমের আকুতি, “আমি কী বলে করিব নিবেদন/আমার হৃদয় প্রাণ মন” (রবীন্দ্রনাথ)। মন্দ কি। ভয়ও যথেষ্ট। দিনদুপুরে চাপাতি দিয়ে খুন। খুনিরা বহাল তবিয়তে। নিরাপত্তার অভাব। পুলিশ দেখেও দ্যাখে না। এসব কিসের আলামত, কেন আঁধার ক্রমশ ঘনীভূত, কেন গোটা দেশ গর্জে উঠছে না, ভাবনার বৈ কী। যেহেতু একমাসের বইমেলা (পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নেই।), তাও আবার দেশের রাজধানী ঢাকায়, আয়োজক বাংলা একাডেমি। তো, দায়িত্ব ও করণীয় বিস্তর। ফেব্রুয়ারি মাসই যদি বইমেলার চাকচিক্য, বাংলা একাডেমির জায়গায় কেন। নয় কেন বাংলাদেশের জেলায়-শহরে-গঞ্জে। ঢাকায় আসা-যাওয়া-থাকা-খাওয়ার যে ঝক্কি, একজন বইপ্রেমীর (জেলা-শহর-মফস্বলের) পক্ষে ভয়ঙ্কর, প্রাণান্তকরও। প্রকাশকদের উপরে চাপ সৃষ্টি করা জরুরি, ঢাকায় অংশ নিক, তবে জেলা-শহরেও, ছোট করে হলেও অংশ নিতে হবে। এক্ষেত্রে আয়-ব্যয়ের সমস্যা আছে। বাংলা একাডেমি আর্থিক সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিক। প্রশ্ন করবেন হয়তো, বাংলা একাডেমির সঙ্গতি আছে কি? ধরে নিচ্ছি নেই। না-থাকার দোহাই দিয়ে তো সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি করা যায়। উদ্যোগ নিলে প্রকাশক এগিয়ে আসবেন, পাঠকও খুশি, পাঠকও তৈরি হবে। বইমেলা ঘিরে। দেখিনি, লোকমুখে শোনা, ঢাকায় যাতায়াত দুর্বিষহ। মিরপুর বা সূত্রাপুর থেকে বাংলা একাডেমিতে পৌঁছুতে নিদেনপক্ষে তিন ঘণ্টা। ফিরতেও কাহিল অবস্থা। যানজট, জনস্রোত ইত্যাদি। বইমেলা ঢাকার নানা অঞ্চলে অনায়াসেই ছড়িয়ে দেয়া যেতে পারে। বাংলা একাডেমি মূল কেন্দ্র থাক, আপত্তি নেই। উপকেন্দ্র হোক মহল্লার পাঠাগার, ক্লাব বা খোলা চত্বর। প্রকাশক বই সাজাবেন। পাঠক ভিড় করবেন। ধরা যাকÑ গুলশানে, বাড্ডায়, মিরপুরে, সূত্রাপুরে নানা জায়গায়। লেখকরা বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হবেন, রচনা পাঠ করবেন। পাঠকের সঙ্গে সরাসরি মিলন হবে। প্রশ্নোত্তর জমবে। যেমন হয় লাইপজিগে, লাইপজিগ বইমেলা উপলক্ষে। এক কোটির বেশি বাঙালী (বাংলাদেশের) বিশ্বের যত্রতত্র, অধিকাংশই আটলান্টিকের দুই পাড়ে। লন্ডন, নিউইয়র্ক, শিকাগো, ফ্লোরিডা, টরেন্টো, রোমে বাংলা একাডেমি কেন বইমেলার আয়োজন করছে না? অর্থের অভাব? সরকারকে চাপ দিতে আপত্তি কোথায়। সরকার গড়িমসি করলে প্রবাসীদের অনুরোধ করুন। গাঁট থেকে এক ডলার দিতে একজন কৃপণও আপত্তি করবে না। অবশ্য, উপযুক্ত কমিটি করতে হবে। লোক পাওয়া সমস্যা নয়। সার্বিক দেখভালে বাংলা একাডেমি। বাংলা বই, বাংলা সাহিত্য, বঙ্গসংস্কৃতি প্রচার করবেন বিশ্বে, কুয়োর মধ্যে বসে, তা হয় না। বাংলা একাডেমি থেকে কতটি ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত, অজানা। কয়েকটি সংগ্রহে আছে। অতিশয় অপাঠ্য অনুবাদ। দুই-একজন ভালো অনুবাদক আছেন বটে, তাঁদের কি ঘরোয়া করা যায় না, কাজে? কিংবা বিশেষজ্ঞ-অনুবাদ কমিটি? প্রয়োজনে বিদেশে বাংলাভাষী দক্ষ-প-িতকেও শামিল করা যেতে পারে। অর্থের বিনিময়। রাজি হবেন কিনা, আলাদা কথা। বাংলাদেশের দুই-একজন লেখকের লেখা ছাড়া সবই জঘন্য, অপাঠ্য। বাংলাও সঠিক লিখতে শেখেননি। আরো একটি বিষয় মগজে কামড়াচ্ছে। দুষ্ট লোকে কয়, বাংলা একাডেমির বই গুদামে পোকায় কাটে। প্রকাশিত হয় ঠিকই, পাঠকের চোখে পড়ে না, দেশের নানা অঞ্চলে যায় না, বিকোয় না। বিক্রি-বাট্টার ব্যবসায়িক বুদ্ধি, তোড়জোড়ও নেই। দরিয়া কা মাল, যাকগে ঢেউয়ে ভেসে। এও বাহ্য। বাংলা একাডেমি থেকে অনুবাদ বেরিয়েছিল স্বর্ণগর্দভ (আবদুল গনি হাজারী অনূদিত), ইবসেনের নাটক (আবদুল হক অনূদিত), ইলিয়াড (আবুল কালাম শামসুদ্দীন অনূদিত), কাব্যের স্বভাব (সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী অনূদিত), ইডিপাস (সৈয়দ আলী আহসান অনূদিত) মলিয়রের নাটক (শওকত ওসমান অনূদিত। খুব খারাপ অনুবাদ), ওভিদের মেটামরফসিস (এহতেশাম হায়দার চৌধুরী অনূদিত। জঘন্য অনুবাদ। বাংলা একাডেমি কি করে ছেপেছে, অবাক মানি।) নানা বিদেশি ক্লাসিক। বইগুলো কোথায়? পুনর্মুদ্রণ হয়েছে কী? এই প্রজন্মের পাঠক আদৌ জানে কী? জানানোর দায় বাংলা একাডেমির। একুশের বইমেলা নিয়ে, বুক ইজ আর্ট-অব লাভ, সোরগোল, মহাউল্লাস, আজকের দিনে বাহুল্য। চাই আরো বিশদ পরিকল্পনা, বিশদ ভাবনাচিন্তা, বিশদ উদ্যোগ, বিশ্বব্যাপী প্রচারণা, বিপ্লব। ইতি, নিত্যস্নেহার্থী দাউদ হায়দার বার্লিন, জার্মানি। ফধঁফ.যধরফবৎ২১@মসধরষ.পড়স
×