ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ আইএমইডির

ভৈরবে দ্বিতীয় রেলসেতু নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ

প্রকাশিত: ০৫:৩৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

ভৈরবে দ্বিতীয় রেলসেতু নির্মাণে অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ

মশিউর রহমান খান ॥ কিশোরগঞ্জের ভৈরবে মেঘনা নদীর ওপর দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রেলসেতু নির্মাণে ব্যাপক অনিয়ম আর দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। আর এ অভিযোগ খোদ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগই (আইএমইডি) তুলেছে। শুধু তাই নয় সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করেছে সংস্থাটি। এছাড়া আইএমইডি বিষয়টি অতি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে আগামী ২ মাসের মধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেল মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে। আইএমইডির মতে, নিম্নমানের নির্মাণ সামগ্রী দিয়ে দুর্বল করে তৈরি করা হচ্ছে এ সেতু। ঢালাই কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে পলি মিশ্রিত বালি আর নিম্নমানের পাতলা ও ভঙ্গুর পাথর। ফলে দুর্বল হয়ে যাচ্ছে সেতুর ঢালাই কাজ। সেতুটির এক্সপানশন জয়েন্ট একই লেভেলের হয়নি। ফলে ভবিষ্যতে সেতুটির ওপর দিয়ে ট্রেন চলাচলে অসুবিধা ঘটবে। সেতুতে রিটেইনিং ওয়ালের ঢালাইয়ে স্টিল শাটারের পরিবর্তে কাঠের ঢালাই শিট দেয়া হয়েছে। অপরদিকে ভৈরব রেলসেতু নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক আবদুল হাইয়ের মতে দ্বিতীয় ভৈরব সেতু নির্মাণ কাজে কোন প্রকার অনিয়ম বা ত্রুটি হচ্ছে না। সেতু নির্মাণের সকল সামগ্রী বুয়েট কর্তৃক পরীক্ষাকৃত। তাই অনিয়মের সুযোগ নেই। চুক্তি অনুযায়ী ৩০ মাসে সেতুটির নির্মাণ কাজ শেষ করার কথা থাকলেও কাজ শুরুর ২৭ মাসে মাত্র ৫৫ ভাগ কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছে। ফলে ইতোমধ্যেই বাড়ানো হয়েছে সেতুটি নির্মাণের মেয়াদকাল। পরিকল্পনামন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল সেতু নির্মাণে অনিয়ম আর নির্মাণ কাজে ত্রুটি পরিলক্ষিত হওয়ায় এ বিষয়ে জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য রেলপথ মন্ত্রণালয়কে আধা সরকারী পত্র (ডিও লেটার) প্রেরণ করেছেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ও এ রেলসেতু নির্মাণে কোন অনিয়ম করলে বা তদন্ত সাপেক্ষে তা প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট সকলের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে জানা গেছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, আইএমইডির মহাপরিচালক ও উপপরিচালকের নেতৃত্বে একটি দল গত বছরের অক্টোবরে প্রকল্প এলাকা পরিদর্শনে যায়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি চলতি মাসের প্রথম দিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পাঠানো দুর্নীতির সচিত্র প্রতিবেদন পাঠায় এতেই অনিয়মের এসব চিত্র উঠে আসে। এরই ভিত্তিতে পরিকল্পনামন্ত্রী ডিও লেটার পাঠান বলে জানা গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিষয়টি যথাযথ তদন্তে রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি কমিটিও গঠন করেছে। বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে কমিটিকে প্রয়োজনীয় কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় এ বিষয়ে সুপারিশ করতে বলেছে রেলপথ মন্ত্রণালয়। আইএমইডির তথ্য মতে, দ্বিতীয় ভৈরব রেল সেতু নির্মাণে পাইলিং সম্পন্ন হয়েছে। ১৩টি পিলারের মধ্যে আটটির ক্যাপ নির্মাণ হয়ে গেছে। আর ৬০০ মিটার রিটেইনিং (ধারণকারী) ওয়ালের মধ্যে ৪৮৫ মিটার নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছে। প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ সংযোগ রেলপথে আরও আটটি ছোট (মাইনর) সেতু রয়েছে। এর মধ্যে পাঁচটি সেতুর পাইলিং সম্পন্ন হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ চলমান রয়েছে। সর্বশেষ তথ্যমতে, প্রকল্পটির ৫৫ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী রেল সেতুটির নির্মাণকাজে ব্যবহার করা হচ্ছে নিম্নমানের বালি ও পাথর। বালিতে পলি মিশ্রিত রয়েছে আর পাতলা ও ভঙ্গুর পাথর ব্যবহার করা হয়েছে। আইএমইডির মতে এর ফলে এতে নির্মাণকাজ, বিশেষত ঢালাই কাজ দুর্বল হয়ে পড়ছে। ফলে ভবিষ্যতে সেতুটি ট্রেন চলাচল ঝুঁকিতে পড়তে পারে। তাই নির্মাণকাজের মান অক্ষুণœ রাখতে কম মানের সামগ্রীতে তৈরি স্থাপনাগুলো সরিয়ে ফেলার পরামর্শ দিয়েছে সংস্থাটি। পাশাপাশি এ বিষয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়। আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, রিটেইনিং ওয়ালের ঢালাইয়ে স্টিল শাটার ব্যবহার করার কথা থাকলেও এর পরিবর্তে কাঠের শাটার ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে খরচ অনেক কম হওয়ায় ঠিকাদার আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। আবার কাঠের শাটার বেয়ে সিমেন্টের পানি বের হয়ে যাচ্ছে। ফলে নির্মাণকাজের গুণগতমান তুলনামূলকভাবে ক্ষুণœ হচ্ছে। এছাড়া রিটেইনিং ওয়ালে হানিকম্ব দেখা গেছে। আর সেতুটির এক্সপানশন জয়েন্ট একই লেভেলের হয়নি। এতে ট্রেন চলাচলে অসুবিধা হতে পারে। এজন্য ঢালাইকাজে কাঠের শাটার বাদ দিয়ে স্টিলের শাটার ব্যবহারের সুপারিশ করে সংস্থাটি। হানিকম্ব অপসারণ ও এক্সপানশন জয়েন্ট লেভেলিংয়ের সুপারিশও করা হয়। আইএমইডির মতে ঠিকাদারের বিল পরিশোধের সময় উক্ত ব্যয় সমন্বয় করা দরকার। সেতুর কাজ সম্পর্কে রেলপথ মন্ত্রণালয়ে পরিকল্পনামন্ত্রীর পাঠানো উপআনুষ্ঠানিক পত্রে বলা হয়, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলওয়ে করিডর উন্নয়নে দ্বিতীয় ভৈরব সেতুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি স্থাপনা। তাই এ রুটে যাত্রী ও পণ্য পরিবহনসেবা সহজ ও দ্রুততর করতে এবং নির্মিত স্থাপনা টেকসই করতে আইএমইডির সুপারিশের আলোকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়া দরকার। যথাসময়ে নির্মাণ কাজ করা সম্ভব হচ্ছে না কেন? এর উত্তরে আইএমইডি প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল হাই আইএমইডি প্রতিনিধি দলকে জানান, প্রকল্পের আওতায় ভারত থেকে সংগৃহীত মালপত্রের কাস্টমস ক্লিয়ারেন্স পেতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন হয়। এ কারণে বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক বিলম্ব হচ্ছে। এক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপে দ্রুত প্রকল্পটি বাস্তবায়নের সুপারিশ করে আইএমইডি। রেলসূত্রে জানা গেছে, ভারতের রাষ্ট্রীয় ঋণের (এলওসি) আওতায় সেতুটি নির্মাণ করছে দেশটির ইরকন-এফকনস জেভি। এজন্য ব্যয় হবে ৫৬৭ কোটি ১৬ লাখ টাকা। তবে চুক্তি অনুযায়ী ৩০ মাসের মধ্যে রেল সেতুটির নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও এখনো সেতুটির পিলার নির্মাণকাজ শেষ হয়নি। এর পর গার্ডার স্থাপন করা হবে। তাই প্রকল্পটির মেয়াদ নতুন করে বাড়ানো হয়েছে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান প্রথম ভৈরব রেল সেতুর ৪০ মিটার ভাটিতে দ্বিতীয় সেতুটি নির্মাণ হবে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এটি কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়া জেলার মধ্যে রেল সংযোগ স্থাপন করবে। ঢাকা-চট্টগ্রাম ডবল লাইন রেলপথ নির্মাণে সেতুটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে দ্বিতীয় ভৈরব সেতু প্রকল্প পরিচালক মো. আবদুল হাই জনকণ্ঠকে বলেন, মূল সেতু নির্মাণে কোন প্রকার নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার কিংবা অনিয়ম করা হচ্ছে না। নিয়মিতই আমরা প্রকল্প কাজ তদারকি করছি। তবে আইএমইডির প্রতিবেদনে মূল সেতুর বাইরে রিটেইনিং ওয়ালের ঢালাইয়ে স্টিল শাটারের পরিবর্তে কাঠের ঢালাই শিট দেয়া হয়েছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা ঠিক নয়। কারণ চুক্তি অনুযায়ী কাঠের ঢালাই শিট ব্যবহার করা যাবে। তবে আইএমইডির সুপারিশের আলোকে প্রকল্পটির সুপারভিশন জোরদার করা হয়েছে। এছাড়া সুপারিশগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে রেলপথ মন্ত্রণালয় একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। অতি দ্রুতই কমিটির সদস্যরা অভিযোগ তদন্তে নির্মাণকাজ দেখতে আসবেন। আশা করা যায়, বর্ধিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পটির কাজ শেষ হবে।
×