ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ছয় বছর আজ

প্রকাশিত: ০৫:২৩, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পিলখানা হত্যাযজ্ঞের ছয় বছর আজ

গাফফার খান চৌধুরী ॥ আজ বিডিআর বিদ্রোহের নামে স্মরণকালের জঘন্যতম সেনা হত্যাযজ্ঞের সাত বছর। এদিন বিডিআর বিদ্রোহীরা তথাকথিত দাবি-দাওয়া আদায়ের নামে ৫৭ মেধাবী ও চৌকস সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। একসঙ্গে এত সেনা কর্মকর্তা প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধেও নিহত হওয়ার নজির নেই। বাংলাদেশে আর যাতে কোন বাহিনীতে এমন বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটতে পারে এজন্য সরকার নানা উদ্যোগ নিয়েছে। বিডিআর বিদ্রোহের পর বিডিআরের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে। বিডিআরের নাম বিজিবি রাখা হয়েছে। নতুন আইনে শাস্তি সর্বোচ্চ ৭ বছরের পরিবর্তে মৃত্যুদ- করা হয়েছে। নানা অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে স্মরণ করা হচ্ছে বিডিআর বিদ্রোহে শাহাদাতবরণকারীদের। ইতিহাসের জঘন্যতম সেই বিডিআর বিদ্রোহের সূচনা হয় ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি। সেদিন সকালে সাড়ে নয়টার দিকে বিডিআরের তৎকালীন মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের সভাপতিত্বে পিলখানায় বিডিআর দরবার হলে বার্ষিক দরবার শুরু হয়। এরই মধ্যে দরবার হলে উপস্থিত জওয়ানরা জাগো বলে হুংকার দিয়ে দরবার হল ত্যাগ করে। এরপর বিদ্রোহীরা অস্ত্রাগারের দায়িত্বে থাকা সেনা কর্মকর্তা মেজর রেজাউল করিমকেও টেনেহিঁচড়ে বের করে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে অস্ত্রাগার লুট করে। বিদ্রোহী সিপাহী মাঈন লুণ্ঠিত অস্ত্র নিয়ে দরবার হলে প্রবেশ করে মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের দিকে অস্ত্র তাক করে। এ সময় উপস্থিত অন্যান্য চৌকস সেনা কর্মকর্তা সিপাহী মাঈনকে নিরস্ত্র করে ফেলেন। কিন্তু শত শত বিদ্রোহী অস্ত্র হাতে প্রবেশ করে এলোপাতাড়ি গুলি করতে থাকে। গুলিতে পুরো দরবার হল ঝাঁঝরা হয়ে যায়। বিদ্রোহীদের সরাসরি মদদ দেয় সুবেদার মেজর গোফরান মল্লিক। বিদ্রোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের ওপর চালাতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। আর একে একে বাসা থেকে ধরে এনে হত্যা করতে থাকে। যা মহান স্বাধীনতা যুুদ্ধের সময় পাক বাহিনীর নির্মমতাকেও হার মানায়। পৈশাচিক সেই হত্যাকা-। আর নির্যাতনে আকাশ বাতাস ভারি হয়ে ওঠে। বেশ কয়েক সেনা কর্মকর্তা প্রাণ বাঁচাতে নিজের পোশাক খুলে বিডিআর জওয়ানের পোশাক পরেন। এক সেনা কর্মকর্তা সন্তানের স্কুলের বেতন দেয়ার জন্য বিডিআরের স্কুলে গিয়েছিলাম। সেখানেই তাকে হামলা করে উন্মত্ত বিদ্রোহীরা। সেই সেনা কর্মকর্তাকে স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা নিজের সেক্রেটারিয়েট টেবিলের নিচে লুকিয়ে রাখেন। তিন দিন সেখানেই তিনি লুকিয়ে ছিলেন। জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে সেই সেনা কর্মকর্তা আর প্রধান শিক্ষিকার কপালে খাবার হিসেবে জুটেছিল দেড় লিটার পানি। দেড় লিটার পানিতেই কোনমতে জীবন বাঁচে সেই সেনা কর্মকর্তার। পরে যখন তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করা হয় তিনি ক্ষুধার যন্ত্রণায় টেবিলের নিচ থেকে বের হতে পারছিলেন না। অত্যন্ত নির্মম আর পৈশাচিক সেই হত্যাকা-। অনেক সেনা কর্মকর্তাকে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো দৌড়ে পালানোর নির্দেশ দিয়ে পেছন থেকে গুলি করে হত্যা করেছে উন্মাদ বিডিআর বিদ্রোহীরা। বিদ্রোহীরা দরবার হলে উপস্থিতদের মধ্যে যাঁদের পেয়েছে তাঁদের নির্মমভাবে হত্যা করেছে। দরবার হল থেকে এক সেনা কর্মকর্তাকে ধরে টেনেহিঁচড়ে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। নেয়ার সময় সেনা কর্মকর্তাকে খুনী বিডিআর বিদ্রোহীরা রাইফেলের নলের মুখে আমবাগান দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। দৌড়ে পালাতে পারলে তাকে আর হত্যা করা হবে না বলেও জানায় নিষ্ঠুর বিডিআর বিদ্রোহীরা। সেনা কর্মকর্তা সরল বিশ্বাসে জওয়ানদের এমন কথা শাস্তি হিসেবে ভেবে দৌড়ে পালাতে যান, ঠিক তখনই তাঁর পায়ে পর পর কয়েকটি গুলি করে বিদ্রোহীরা। এরপর আহত সেনা কর্মকর্তাকে টেনেহিঁচড়ে কোয়ার্টার গার্ডে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তাঁর ওপর চালানো হয় অমানুষিক নির্যাতন। এরপর ২৬ ফেব্রুয়ারি ওই সেনা কর্মকর্তাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করা হয়। এভাবেই চলতে থাকে পিলখানায় হত্যাযজ্ঞ। ২৫ ফেব্রুয়ারির রাতে সেনা কর্মকর্তাদের কোয়ার্টারে সার্চ করতে যায় বিদ্রোহীরা। যাদের পায় তাদের নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে। বিদ্রোহীরা বাসায় তছনছ করে। টাকা পয়সা, স্বর্ণালঙ্কারসহ মূল্যবান জিনিসপত্র লুটে নেয়। লুটের পর বাসায় এবং তাঁদের ব্যবহৃত গাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। পুরো পিলখানার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নির্বিচারে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতাকে হত্যা করতে থাকে বিদ্রোহীরা। লাখ লাখ রাউন্ড গুলি ছোড়ে বিদ্রোহীরা। বিডিআরের নিহত সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল শাকিল আহমেদের স্ত্রীকে বাসায় হামলা চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বিদ্রোহীরা ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে। সেনা কর্মকর্তাদের হত্যার পর বিদ্রোহীরা শুরু করে পৈশাচিক আচরণ। তারা মৃতদেহ ম্যানহোল দিয়ে বুড়িগঙ্গা নদীতে ভাসিয়ে দেয়। অনেকের মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলার চেষ্টা করে। গণকবর দেয়া হয় অনেক সেনা কর্মকর্তাকে। হত্যাযজ্ঞের পর দ্রুত লাশ গুম করতে মৃতদেহগুলো খুবই আপত্তিকর অবস্থায় যত্রতত্রভাবে গণকবরে পুঁতে ফেলে। মৃতদেহ ফেলে দেয়া হয় ড্রেনে, ম্যানহোলে, নর্দমায়। অনেক মৃতদেহ একসঙ্গে যাচ্ছেতাইভাবে গর্তে পুঁতে ফেলা হয়। বিডিআর বিদ্রোহের সময় ও পরে সারাদেশের সাতটি ইউনিট বা সাব ইউনিট ছাড়া ৬০ ইউনিটে বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনা ঘটে। সারাদেশের সংশ্লিষ্ট ইউনিটগুলোতে বিদ্রোহের ঘটনায় মামলা হয়। ২০০৯ সালের ৩১ মার্চ বহুল আলোচিত সেই দরবার হলেই বিডিআর বিদ্রোহ মামলার প্রথম বিচার শুরু হয়। সারাদেশে বিজিবির সেক্টরগুলোতে বিশেষ আদালত বসিয়ে বিচারকাজ শেষ করা হয়। ১৯৭২ সালের বিডিআর বিদ্রোহের আইনে আসামিদের বিচার সম্পন্ন হয়। বিচার কার্যক্রম সরাসরি মিডিয়ায় প্রচার ও মিডিয়ার সামনেই করা হয়। অভিযুক্ত ব্যক্তি নিজ মুখে অথবা নিজ খরচায় নিয়োগকৃত আইনজীবীর মাধ্যমে তার বক্তব্য আদালতে তুলে ধরতে পেরেছেন। যেসব বিদ্রোহী তা করেননি তাদের জন্য বিডিআরের তরফ থেকেই অভিযুক্তদের আইনী সহায়তা দিতে ফ্রেন্ড অব দ্য এ্যাকিউজড হিসেবে বিডিআরের উর্ধতন একাধিক কর্মকর্তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়েছিল। কোন অভিযুক্ত বিদ্রোহী নিজেকে দোষী দাবি করলে, আদালত তার শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ নমনীয়তা ও শৈথিল্যও প্রদর্শন করেছেন। আইন অনুযায়ী বিদ্রোহীরা যে ধরনের সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা কোন কোন ক্ষেত্রে তার চেয়েও বেশি পেয়েছে। অন্যদিকে বিদ্রোহের ঘটনায় রাজধানীর তৎকালীন লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নবজ্যোতি খীসা হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে লালবাগ থানায়ই পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন। মামলা দুটি পরবর্তীতে আদালতের নির্দেশে নিউমার্কেট থানায় স্থানান্তর হয়। ফৌজদারি আইনে মামলা দুটির তদন্তভার পায় পুলিশের অপরাধ তথ্য বিভাগ (সিআইডি)। মামলাটির বিচার কাজ শেষ হয়েছে। আসামিদের মধ্যে ২০ জন পলাতক। তাদের গ্রেফতারে অভিযান অব্যাহত আছে। তদন্তে আরও বেরিয়ে আসে, বিডিআর হত্যাযজ্ঞে পিস্তল, এলএমজি, এসএমজি ও গ্রেনেডসহ বিভিন্ন ধরনের প্রায় ৩৭শ’ অস্ত্র ও অস্ত্র অনুযায়ী গোলাবারুদ ব্যবহৃত হওয়ার তথ্য। বিদ্রোহের সময় পিলখানা থেকে ১৯৯ গ্রেনেড, ৬৪ পিস্তল ও ৫ রাইফেলসহ প্রায় ৩শ’ অস্ত্র খোয়া গেছে। কিছু কিছু অস্ত্র গোলাবারুদ পরবর্তীতে উদ্ধার হয়েছে। বাকিগুলো উদ্ধারে অভিযান অব্যাহত আছে। বিদ্রোহে সম্পদ ও অর্থের অপূরণীয় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার হিসেব সঠিকভাবে নিরূপণ করা কঠিন। মামলায় বিএনপির সাবেক সংসদ সদস্য নাসির উদ্দিন আহমেদ পিন্টু, আওয়ামী লীগ নেতা তোরাব আলী, যুবলীগ নেতা লেদার লিটন, ডিএডি তৌহিদুল আলম ও নাসিরসহ ৮৫০ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছিল। অভিযুক্তদের মধ্যে ৩ জন পরে মারা যায়। তাদের অভিযোগ থেকে বাদ দেয়া হয়। আসামির সংখ্যা বেশি হওয়ায় পুরনো ঢাকার বকশীবাজার আলীয়া মাদ্রাসা ও ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার সংলগ্ন মাঠে ঢাকার জজ আদালতের অস্থায়ী এজলাস বসিয়ে হত্যাযজ্ঞ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে দায়ের পৃথক মামলার বিচার কাজ শেষ হয়। বিডিআরের মতো আর কোন বাহিনীতে যাতে বিদ্রোহের ঘটনা না ঘটতে পারে, এজন্য সরকারের তরফ থেকে বেশকিছু উদ্যোগ নেয়া হয়। এর মধ্যে ১৯৭২ সালের বিডিআর আইনে বিদ্রোহের সর্বোচ্চ শাস্তি ৭ বছরের পরিবর্তে নতুন আইন করে মৃত্যুদ- করা হয়। বিডিআরের নাম পরিবর্তিত হয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) রাখা হয়। বিডিআরের লোগোর পরিবর্তে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের লোগো প্রতিস্থাপিত করা হয়েছে। পোশাকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে। এক কথায় আমূল পরিবর্তন আনা হয়েছে বিডিআরে। বিডিআর বিদ্রোহের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বিডিআর বিদ্রোহীদের ক্ষমা করার আশ্বাস দিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হন। এরপর সরকারের পক্ষ থেকে আলোচনা শুরু হয়। টানা ২ দিনের বিদ্রোহের পর পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে থাকে। তবে ততক্ষণে ঘটে যায় ইতিহাসের বর্বরোচিত সেই জঘন্য হত্যাযজ্ঞ। দিনটি উপলক্ষে আজ বৃহস্পতিবার ও আগামীকাল শুক্রবার বিজিবি সদর দফতর পিলখানায় নিহতদের উদ্দেশে শাহাদতবার্ষিকী পালন করা হচ্ছে। দিনের কর্মসূচী অনুযায়ী শহীদদের রুহের মাগফিরাতের উদ্দেশ্যে পিলখানাসহ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সকল রিজিয়ন, সেক্টর, প্রতিষ্ঠান ও ইউনিটের ব্যবস্থাপনায় বাদ ফজর খতমে কোরআন এবং বিজিবির সকল মসজিদে এবং বিওপি পর্যায়ে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ব্যবস্থাপনায় আজ সকাল নয়টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি ছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিন বাহিনীর প্রধানগণ (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এবং বিজিবি মহাপরিচালক (একত্রে) শহীদদের স্মৃতিস্তম্ভে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার বাদ আসর বিকেল পৌনে পাঁচটায় পিলখানায় বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে বিশেষ দোয়া ও মিলাদ মাহফিল হবে। দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বিজিবি মহাপরিচালক, শহীদদের নিকটাত্মীয়রা, পিলখানায় কর্মরত সকল কর্মকর্তা, জেসিও, অন্যান্য পদবীর সৈনিক এবং বেসামরিক কর্মচারী অংশগ্রহণ করছেন।
×