ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মূল সমস্যা যোগ্য ও দক্ষ পিডি নিয়োগ;###;এখন থেকে নিয়োগ দেবে কমিটি;###;জারি হচ্ছে পরিপত্র

বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ ॥ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বিশেষ সতর্কতা

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাস্তবায়নই চ্যালেঞ্জ ॥ উন্নয়ন প্রকল্প নিয়ে বিশেষ সতর্কতা

হামিদ-উজ-জামান মামুন ॥ উন্নয়ন প্রকল্পের বাস্তবায়ন এখন সরকারের জন্য অন্যতম চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই লাফিয়ে বাড়ছে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচী (এডিপি)। যা বর্তমানে ১ লাখ কোটি টাকার উপরে। কিন্তু বাস্তবায়ন কাক্সিক্ষত পর্যায়ে হচ্ছে না। এ জন্য বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্তা ব্যক্তি প্রকল্প পরিচালকের (পিডি) বিষয়টি এখন আলোচিত হচ্ছে। এটিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের অন্যতম হাতিয়ার হিসেবে মনে করা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, একজন পিডির দক্ষতা ও অদক্ষতার উপরই নির্ভর করে পুরো প্রকল্প বাস্তবায়নের সফলতা ও ব্যর্থতা। তাই এ বিষয়ে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করছে সরকার। চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে এ বিষয়ে বিস্তারিত পরিপত্র জারি করেছে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, উন্নয়ন কর্মকা-ের পরিধি উত্তরোত্তর বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখার জন্য উন্নয়ন কর্মকা-ের ব্যবস্থাপনা সুষ্ঠু ও গতিশীল রাখা প্রয়োজন। এ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন কাজে সম্পৃক্ত মানবসম্পদের উপর বহুলাংশে নির্ভর করে। প্রকল্প অনুমোদনের পর বাস্তবায়ন অগ্রগতি মন্থর হয়ে পড়ার অন্যতম কারণ হলো দক্ষ ও অভিজ্ঞ প্রকল্প পরিচালকের অভাব। কাক্সিক্ষত উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে প্রকল্পের সুষ্ঠু ও যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য অভিজ্ঞ ও যোগ্য পিডি নিয়োগের বিকল্প নেই। তাই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে পরিপত্রের নির্দেশাবলী অনুসৃত হবে। পরিকল্পনা মন্ত্রী আহম মুস্তফা কামাল প্রকল্প পরিচালক বিষয়ে এর আগে বলেছিলেন, এখন থেকে প্রকল্প পরিচালকদের (পিডি) ব্যক্তিগত পারফরম্যান্স মূল্যায়ন করে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পে অথবা তাকে সেই প্রকলল্পের চেয়ে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ বা বড় প্রকল্পে দায়িত্ব দেয়া হবে। অনেকে প্রকল্পের গাড়ি ও সুযোগ সুবিধা নিতে দফায় দফায় প্রকল্প সংশোধন করেন। নতুন অঙ্গ যুক্ত করে প্রকল্পের অর্থ ও মেয়াদ বাড়ায়। এগুলো সবই ব্যক্তিগত উদ্দেশ্যে করা হয়। ধীরে ধীরে অদক্ষ প্রকল্প পরিচালকদের সরিয়ে দেবে সরকার। এজন্য আলাদা প্রকল্প পরিচালকদের পুল করা হতে পারে। সূত্র জানায়, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয় থেকে জারিকৃত পরিপত্রে যেসব নির্দেশনা দেয়া হয়েছে সেগুলো হলো, নতুন অনুমোদিত প্রকল্পের পরিচালক নিয়োগে একটি কমিটি গঠন করে সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে পিডি নিয়োগ করতে হবে। কমিটি গঠনের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা বিভাগের সিনিয়র সচিব বা সচিব হবেন সভাপতি ও সদস্য সচিব হবেন ওই মন্ত্রণালয় বা বিভাগের পরিকল্পনা অনুবিভাগের প্রধান এবং ছয় সদস্যের মধ্যে থাকবে পরিকল্পনা কমিশনের সংশ্লিষ্ট বিভাগের প্রতিনিধি, বাস্তবায়ন-পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সংশ্লিষ্ট সেক্টরে প্রতিনিধি, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি, অর্থ বিভাগের প্রতিনিধি, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) প্রতিনিধি এবং প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থার প্রধান। বৈদেশিক সহায়তাপুষ্ট প্রকল্পের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, কমিটি প্রকল্পের ব্যয় ৫০ কোটি বা তার উপরে হলে পূর্ণকালীন প্রকল্প নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা কর্তৃক সংযুক্ত ছকে পেশকৃত ন্যূনতম ৩ জন সম্ভাব্য প্রকল্প পরিচালকের বৃত্তান্ত বিবেচনা করবে। কমিটি পিডি নির্বাচনের জন্য মানদ- (যেমন শিক্ষাগত যোগ্যতা, কর্ম অভিজ্ঞতা, প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা, প্রকিউরমেন্ট সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ ইত্যাদি) বিবেচনা করবে এবং পরবর্তীতে সাক্ষাতকারও গ্রহণ করবে। ৫০ কোটি টাকার নিচে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের (পূর্ণ/খ-কালীন) বিষয়টি বিবেচনার জন্য মন্ত্রণালয় বা বিভাগ এই কমিটির সহায়তা গ্রহণ করতে পারবে। প্রকল্প মেয়াদ শেষ হওয়ার ৬ মাস পর্যন্ত যেসব কর্মকর্তার চাকরির মেয়াদ থাকবে না, সেসব কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেয়া যাবে না। জনস্বার্থে একান্ত অপরিহার্য না হলে প্রকল্প বাস্তবায়নকালে সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে নিয়োজিত প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত পিডি অথবা কর্মকর্তাকে অন্যত্র বদলি পরিহার করতে হবে। তবে পদোন্নতি বা শাস্তিপ্রাপ্ত কর্মকর্তার ক্ষেত্রে এ বিধান প্রযোজ্য হবে না। কিন্তু পদোন্নতিপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতির সখর সুযোগ-সুবিধা প্রদান করে প্রকল্প সমাপন পর্যন্ত পিডি পদে বহাল রাখার চেষ্টা করতে হবে। সকল প্রকল্পের ক্ষেত্রে অনুসরণীয় বিষয়গুলো হচ্ছে, উপযুক্ত কমিটির সুপারিশ ছাড়া কোন প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা যাবে না। পদাধিকার বলে কোন কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা যাবে না। একজন কর্মকর্তাকে একটিমাত্র প্রকল্পে পরিচালক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। তবে বিশেষ প্রয়োজনে সর্বোচ্চ দুটি প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা যেতে পারে, সেক্ষেত্রে কমিটির সুপারিশ প্রয়োজন হবে। ক্রয় সংক্রান্ত বিধানাবলী ও প্রকল্প ব্যবস্থাপনা বিষয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং প্রকল্প প্রণয়ন, প্রক্রিয়াকরণ ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজে অভিজ্ঞ (৫ম গ্রেডের নিচে নয়) কর্মকর্তাকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে অগ্রাধিকার দিতে হবে। প্রকল্প অনুমোদনের পরই প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করতে হবে। তকে কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের ক্ষেত্রে উন্নয়ন সহযোগী কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদনের আগে পিডি নিয়োগের শর্তারোপ করা হলে কমিটি পরিপত্রের শতাবলী মেনে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগের সুপারিশ করবে। প্রকল্প পরিচালক নিয়োগে বাস্তবায়নকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের অগ্রাধিকার দিতে হবে। ইতোমধ্যেই যারা একাধিক প্রকল্পের দায়িত্বে রয়েছেন তাদের দুটি প্রকল্পের বাইরে অধিক প্রকল্প পরিচালক থেকে অব্যাহতি দিতে হবে। অতিরিক্ত দায়িত্ব প্রদান করে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ পরিহার করতে হবে। যেসকল কর্মকর্তা দক্ষ নয় তাদের পিডি নিয়োগ দেয়া যাবে না। কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ চূড়ান্ত অনুমোদন দেবেন। এ বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, প্রকল্প পরিচালক বা প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির বদলি এডিপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে যেসব বড় বড় সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে অন্যতম। প্রকল্পের ক্ষেত্রে দেখা যায়, পিডি চলে গেলে মানুষ হয়ত বদল করা যায়, কিন্তু যে দক্ষতা ও জ্ঞান চলে যা তা বদল করা যায় না। কেননা একজন নতুন মানুষকে নিয়োগ দেয়া হলে তার শিখতে শিখতেই অনেকটা সময় চলে যায়। সূত্র জানায়, স্বাধীনতার পর ১৯৭১-৭২ অর্থবছরে বৈদেশিক সহায়তার পাইপলাইন ছিল মাত্র ৩৪ কোটি মার্কিন ডলার। যা এখন বেড়ে মহীরুহের আকার ধারণ করেছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত এর পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ২১ দশমিক ২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে। যা স্থানীয় মুদ্রায় প্রায় ১ লাখ ৭১ হাজার কোটি টাকা। দিন দিন বাড়ছেই চলছে এই পাইপ লাইন। বলা হচ্ছে, দাতাদের প্রতিশ্রুতি বৃদ্ধি পাওয়ায় দীর্ঘ হচ্ছে এর আকার। কিন্তু সে তুলনায় বাড়ছে না ব্যবহার। পরিকল্পনা কমিশন বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রকল্প দলিল প্রণয়ন, অনুমোদন, জমি অধিগ্রহণ, অর্থায়ন, পরিবেশ সংক্রান্ত অনুমোদন ও কারিগরি জটিলতায় বাস্তবায়ন দেরি হয়। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব, পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব, ত্রুটিপূর্ণ ক্রয় পরিকল্পনা ও প্রক্রিয়া, কার্যাদেশে বিলম্ব বৈদেশিক অর্থছাড় না হওয়া অন্যতম কারণ। এ ছাড়া ভূমি গ্রহণে জটিলতা, প্রকল্প পরিচালকের দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও অপর্যাপ্ত আর্থিক ক্ষমতা, ঘনগণ প্রকল্প পরিচালক বদলি এবং প্রকল্পের ত্রুটিপূর্ণ ব্যয় প্রাক্কলনসহ কয়েকটি কারণে থমকে গেছে অনেক প্রকল্পগুলো।
×