ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজার কাছে পত্র

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

রাজার কাছে পত্র

রবীন্দ্রনাথের ডাকঘর নাটকের কিশোর অমল প্রতিদিন অপেক্ষা করত রাজার চিঠির জন্য। কিন্তু সে চিঠি আর আসেনি। একালের অমল তথা বারো বছর বয়সী আহমেদ, রাজার চিঠির অপেক্ষায় নেই। বরং রাজাকেই চিঠি দিচ্ছে, তার এই স্বল্প বয়সের জীবন কাহিনী জানিয়ে। সেখানে রাজার সঙ্গে সাক্ষাত করে তার ফেলে আসা সুখের জীবন এবং পরবর্তী বিপর্যয়ের কাহিনী শোনাতে চায়। পত্রটি রাজার কাছে পৌঁছেছে কিনা জানা নেই তার, কিন্তু সংবাদ মাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের কল্যাণে সেই চিঠি এখন বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে গিয়েছে। যুদ্ধ যার জীবনকে তছনছ করে দিয়েছে। তাই সে পাড়ি দিয়েছে রাজার রাজ্যে। শরণার্থী জীবনের ভার বহিবার কঠিন কঠোর পথ পাড়ি দিতে হচ্ছে তাকে আজ। তুরস্কের সমুদ্র সৈকতের ছোট্ট আয়লান কুর্দির মৃতদেহের ছবিটি বিশ্ববাসীকে নাড়া দিয়েছিল সকরুণ আর্তনাদ জাগিয়ে। তার পিতা আবদুল্লাহ সিরিয়া থেকে পালিয়ে তুরস্ক এসেছিলেন নৌযানে। কিন্তু যানটি তীরের কাছে এসে ডুবে গিয়েছিল। আয়লানের মৃতদেহ ভাসতে ভাসতে সৈকতে এসে ঠেকে। কিন্তু আহমেদ ভাঙা নৌকায় পাড়ি দিয়ে ভাই ও বাবা-মার সঙ্গে এক সময় শরণার্থী হিসেবে পৌঁছে যায় সুইডেন। সুইডেনের মালমো শহরের স্কুলে ভর্তি হয় সে। সেই স্কুলের কাউন্সিলরকে একদিন সে তার ইচ্ছের কথা জানায়। গল্প শোনাতে চায় সে রাজাকে। কি সেই গল্প? যখন সে পরিবারের সঙ্গে পালিয়ে এসেছে ঘরবাড়ি ছেড়ে, সেই ভয়াবহ সময়গুলোর কথা শোনাতে চায় রাজা কার্ল গুস্তাস্ককে। তাই দেখা করতে তার ব্যাগে করে বাড়ি থেকে নিয়ে আসা নতুন জামা গায়ে দেয় সে। আহমেদের আরবী ভাষায় লেখা পত্রটি তার স্কুলের কাউন্সিলর ইংরেজীতে অনুবাদ করে তা প্রকাশ করেন। আর তা বিশ্ববাসীর অন্তরকে নাড়া দেয়। রাজার নজরে হয়ত এসেছে তা, কিংবা আসেনি। রাজাও তাকে ডাকেননি গল্প শুনতে। কিন্তু চিঠিতে সে তার ভয়াবহ সময়ের কাহিনী তুলে ধরেছে। নিজের কষ্ট-দুঃখ-বেদনা উপচে পড়েছে সে পত্রে। সিরিয়ার আলেপ্পোর বাসিন্দা তার পরিবার। বাবার একটা বড় কারখানা ও পোশাকের দোকান ছিল। খুব আনন্দে কেটেছে তার জন্ম-পরবর্তী দিনগুলো। বাবার উপহার দেয়া খেলনাগুলো ছিল তার সঙ্গী। কিন্তু যুদ্ধ এসে একদিন সব কেড়ে নিল তাদের। কারখানা পুড়িয়ে দেয়া হলো। কারখানার সঙ্গে সঙ্গে যেন উধাও হয়ে গেল তাদের আনন্দ ও খুশি। ইসলামিক স্টেটের সেনাদের বর্বরতা এমন ছিল যে, তার চোখের সামনেই তার শিক্ষককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যা সে ভুলতে পারে না। যেদিন কারখানা পুড়ে যায়, যেদিনই সিদ্ধান্ত নিতে হয় বাঁচতে হলে ছাড়তে হবে দেশ। সেই থেকেই তাদের জীবনের খারাপ দিনগুলোর শুরু। আহমেদ ভেবে কূলকিনারা পায়নি, কেন তাদের এমন হলো, কোথায় গেল তাদের বাড়ি-ঘর, বিছানা ও খেলনাগুলো। নিজেকেই নিজে প্রশ্ন করে জবাব পায় না। নৌকায় চড়ে একটি দ্বীপে এসে ঠাঁই নেয়। মন খারাপের দিনগুলো তাকে ছাড়ে না। এখন সুইডেনে এসে আশ্রয় মেলে শরণার্থী হিসেবে। সেই কষ্টকর অন্ধকারাচ্ছন্ন দিনগুলোর কাহিনী শোনানোর আগ্রহ দেশটির রাজাকে। সিরিয়াসহ যুদ্ধবিধ্বস্ত পশ্চিম এশিয়ার বহু আহমেদের জীবন কাহিনী এই পত্র। যুদ্ধ নামক নারকীয় বীভৎসতার ভেতর দিয়ে যারা পাড়ি দিয়ে ভিনদেশে আশ্রিত আজ। বিপন্ন মানুষদের বেঁচে থাকার আকুতি আকাশে-বাতাসে মিশে আছে। সিরিয়ায় কবে শান্তি আসবে কেউ জানে না। তারা আর কোনদিন নিজ দেশে ফিরতে পারবে কিনা তাও জানে না। শরণার্থী জীবনের নিষ্ঠুরতা তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে। এর থেকে যেন মুক্তি নেই। শান্তি সুদূরপরাহত যত হবে আহমেদদের সংখ্যা তত বাড়বে। এর থেকে পরিত্রাণের পথ জাতিসংঘ দ্রুত দেখাতে পারবে কিনা সেটাই দেখার অপেক্ষা।
×