ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

মানবরূপী দানব

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় ॥ শিশু কেন টার্গেট

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

সমাজ ভাবনা ॥ এবারের বিষয় ॥ শিশু কেন টার্গেট

খন্দকার মাহ্বুবুল আলম শিশুদের প্রতি নৃশংসতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। যা শুধু দুঃখজনক নয়, এর চেয়েও বেশিকিছু। মুক্তিপণ দাবি, পূর্ব শত্রুতার জেরস্বরূপ সব রাগ-ক্ষোভ-লোভ ইত্যাদি শিশুদের ওপরেই গিয়ে পড়ছে। এ সময়ে এমন ঘৃণ্যতম এবং অমানবিক কা-গুলো যে ঘটবে তা নিকট অতীতেও ভাবা যায়নি। দূর অতীতে তো এ রকম কারও কল্পনাতেও আসেনি। কিন্তু এখন কি দেখছি? সম্প্রতি হবিগঞ্জের বাহুবলে চার শিশুকে অপহরণ করে বালুর স্তূপে গর্ত খুঁড়ে মাটি চাপা দেয়ার ঘটনাটি আবারও দেশবাসীকে ব্যথিত এবং হতবাক করে তুলল। এর ক’দিন আগে কেরানীগঞ্জে ৫ম শ্রেণীর ছাত্র শিশু আবদুল্লাহ্কে অপহরণের পাঁচদিন পর গত ২ ফেব্রুয়ারিতে একটি ড্রামের ভেতর থেকে তার লাশ উদ্ধার করা হয়। শিশুটিকে অপহরণের পর তার মা-বাবার কাছে মুক্তিপণ হিসেবে সাড়ে ৫ লাখ টাকা দাবি করেছিল, এক ক্ষুদে বার্তা পাঠিয়ে। বিকাশের মাধ্যমে ২ লাখ টাকা পাঠিয়েও শিশু আবদুল্লাহ্র শেষ রক্ষা মিলেনি। এ অমানবিক ঘটনার একই সময়ে মির্জাপুরে এক প্রবাসীর দুই শিশুকেও অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি করা হয়। মুক্তিপণের কাক্সিক্ষত টাকা না পেয়ে এ দুই শিশুকেও নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। কি পরিমাণ সামাজিক অবক্ষয় ঘটলে এ রকম চরম অমানবিক ঘটনাগুলো ঘটে তা সহজেই অনুমেয়। একটি ঘটনা কোথাও ঘটে গেলে পর পর অন্যান্য স্থানেও একই রকম ঘটনা বা অপরাধ একের পর এক ঘটতে থাকে। এটিকে এক ধরনের ‘মনস্তাত্ত্বিক সংক্রমণ’ বলা যায়। ভাল কিছু যতটুকু সংক্রমিত হয় না, খারাপ কিছুর সংক্রমণ আরও বেশি এবং অতি দ্রুতই ঘটতে থাকে। অতি সম্প্রতি ঘটে যাওয়া এসব ঘটনার আগে ২০১৫-তে সিলেটের কুমার গাঁওয়ে শিশু রাজনকে চুরির অপবাদে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ওই ঘটনার পর গত ২০১৫-এর ৩ আগস্ট, খুলনার মোটরসাইকেল গ্যারেজের শিশুশ্রমিক রাকিবকে পায়ুপথে মেশিনের সাহায্যে বাতাস ঢুকিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিগত ২০১৫-এর ১৩ এপ্রিল রাজধানীর খিলক্ষেতে কিশোর নাজিমকে কবুতর চুরির অভিযোগ এনে হাত- পা বেঁধে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। পরে লাশ বালু নদীতে ফেলে দেয় খুনিরা। একই সম-সাময়িককালে বরগুনায় মাছ চুরির অভিযোগে রবিউল নামের ১০ বছরের আরেক শিশুকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। এ রকম বহু শিশু হত্যা-অপহরণের ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটছে। কিন্তু কেন? বিশেষজ্ঞ পর্যায়ে এ প্রশ্নের সঠিক উত্তর খুঁজে বের করা দরকার। শিশুদের প্রতি নৃশংসতা অসুস্থ সমাজের এক বীভৎস চিত্র। শিশু রাজন-রাকিবসহ অন্যান্য শিশুহত্যার আসামিদের গ্রেফতার ও বিচারকাজ চললেও কেন এই অপরাধ থামছে না? বিভিন্ন ধরনের নেশাগ্রস্ততা, লোভ, স্বার্থপরতা এবং আরও নানা কারণে এসব ঘটছে। যেহেতু কোন কোন ক্ষেত্রে নেশার টাকা যোগাড় করতে এ রকম ঘটনা ঘটানো হচ্ছে, সেহেতু যতক্ষণ না মাদক বা নেশামুক্ত মানবিক সমাজ গঠিত হবে; ততক্ষণ পর্যন্ত এসব নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হবে। শিশুরা কোমলমতি। বয়স্কদের তুলনায় শিশুদের মুক্তিপণ দাবিতে অপহরণ বা খুন ও গুম করা অপরাধীদের পক্ষে সহজ। যে শিশুদের মুখের দিকে তাকালে মায়া হয়, সেই শিশুদের যারা হত্যা করে তারা কি আদৌ মানুষ? নিশ্চয় না, এরা মনুষ্যরূপী দানব বৈকি! শিশুদের প্রতি অন্যায় আচরণের কোন শেষ নেই। প্রতিনিয়ত তাদের অমানুষিক শ্রমকাজে ব্যবহার করে এক শ্রেণীর স্বার্থান্বেষীরা সুবিধা গ্রহণ করছে। বিনিময়ে উপযুক্ত মজুরি তো দূরের কথা, পান থেকে চুন খসলেই বিপদ! নেমে আসে এই শিশুদের ওপর নির্যাতন। শিশুদের প্রতি নৃশংসতা বন্ধ করতে হলে নেশামুক্ত ও মানবিক সমাজ গঠন দরকার। এজন্য শিক্ষা- সাহিত্য ও সাংস্কৃতির বিস্তার ঘটাতে হবে। মানবিক ও নৈতিক মূল্যবোধ দ্বারা প্রত্যেকটা মানুষকে গড়ে তুলতে হবে। যেখানে সভ্য দুনিয়ার দেশে-দেশে শিশুদের অধিকার ও সার্বিক কল্যাণে কিছু মানুষ কাজ করে যাচ্ছে, তখন আমাদের দেশের শিশুরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। এ সঙ্কট নিরসনে সব মহলের যৌক্তিক পদক্ষেপ গ্রহণে এগিয়ে আসা দরকার। আনন্দবাজার, চট্টগ্রাম থেকে
×