ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে ধরা পড়ে এখন কপাল চাপড়াচ্ছে

পিটার প্রতারণা করে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

পিটার প্রতারণা করে প্রায় শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে

গাফফার খান চৌধুরী ॥ এটিএম কার্ড জালিয়াতির মাধ্যমে এখন পর্যন্ত কত টাকা তুলে নিয়েছে, তা নিজেই জানে না গ্রেফতারকৃত পোল্যান্ডের নাগিরক পিটার স্কেজেফান মাজুরেক। চক্রটির সঙ্গে সিটি ব্যাংকের গ্রেফতারকৃত তিন কর্মকর্তা ছাড়াও বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকের অনেক উর্ধতন কর্মকর্তাও জড়িত। মাজুরেক এখন পর্যন্ত কম করে হলেও দেশ বিদেশ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে শত কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। বিদেশে এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে ধরা পড়েনি। তবে বাংলাদেশে এসে শেষ পর্যন্ত ধরা পড়তে হল। রিমান্ডে এমন আফসোসের কথা জানিয়েছে ওই বিদেশী। বাংলাদেশে তার প্রতারণার কাজে হাত দেয়া বুদ্ধিমানের কাজ ছিল না বলে, এখন নিজেই কপাল চাপড়াচ্ছে মাজুরেক। শুধু ব্যাংকের এটিএম বুথ নয়, দেশ বিদেশের বহু চেনশপে কেনা কাটায় ব্যবহৃত কার্ড থেকেও কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রটি। গত ১২ ফেব্রুয়ারি বনানী মডেল থানায় ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেডের (ইবিএল) তরফ থেকে একটি মামলা দায়ের করা হয়। মামলার অভিযোগে বলা হয়, অন্তত ২১ জন গ্রাহকের এ্যাকাউন্ট থেকে এটিএম কার্ড ক্লোন করে অন্তত ১০ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এরপর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক লিমিটেড (ইউসিবিএল) একই থানায় এ ধরনের অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ের করে। মামলার অভিযোগে বলা হয়, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংকের (ইউসিবি) একটি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে গ্রাহকের এটিএম কার্ডের তথ্য চুরি করা হয়েছে। এরপর সেই তথ্য দিয়ে এটিএম কার্ড বানিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। এই মামলাটির সঙ্গে এটিএম বুথে থাকা সিসি ক্যামেরায় ধারণকৃত গ্রেফতারকৃত বিদেশীর ছবি দেয়া হয়। এ ছাড়া পল্লবী থানায় সিটি ব্যাংকের তরফ থেকে এমন অভিযোগে আরেকটি মামলা দায়ে হয়। এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র বলছে, ইউসিবিএল ছাড়াও ইস্টার্ন ব্যাংক লিমিটেড ও সিটি ব্যাংকের ছয়টি বুথে স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে তথ্য চুরি করে একইভাবে কার্ড বানিয়ে প্রায় ২১ লাখ টাকা তুলে নেয়ার ঘটনা ঘটেছে। স্কিমিং ডিভাইজটি অন্তত ১২শ’ এটিএম কার্ডের তথ্য সংগ্রহ করেছে। এর মধ্যে ৪০টি কার্ড তৈরি করে টাকা তুলে নিয়েছে চক্রটি। বাকি ১১শ’ ৬০টি কার্ড বানিয়ে টাকা তুলে নেয়ার প্রস্তুতি চলছিল। এমন ঘটনায় রীতিমতো হৈচৈ পড়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ দ্রুত এটিএম বুথগুলোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলোকে এক মাসের সময় সীমা বেঁধে দেয়। বুথগুলোতে নিরাপত্তা ডিভাইজ বসাতে কড়া নির্দেশনা দেয়। অন্যথায় ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে বলেও জানায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকটি। সেইসঙ্গে মামলাগুলোর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটকে। গত রবিবার সন্ধ্যায় মামলা তদন্তের সূত্র ধরে গ্রেফতার করা হয় পোল্যান্ডের নাগরিক মাজুরেক তার সিটি ব্যাংকের তিন কর্মকর্তা মোকসেদ আলী মাকসুদ, রেজাউল করিম শাহীন ও রেফাত আহমেদ রনিকে। তাদের ৬ দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। সিটি ব্যাংকের তরফ থেকেও বিষয়টির তদন্ত চলছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষী সিটি ব্যাংকের কর্মকর্তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ব্যাংকটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) সোহেল আর কে হোসাইন। মামলাগুলোর তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গ্রেফতারকৃত বিদেশী আন্তর্জাতিক প্রতারক চক্রের সদস্য। সেই চক্র পূর্ব ইউরোপের রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, ইউক্রেন, এশিয়া ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও তৎপর। এটিএম কার্ড জালিয়াতির পরিকল্পনার সঙ্গে লন্ডন প্রবাসী একজন বাংলাদেশী, একজন বুলগেরিয়ান এবং একজন ইউক্রেনের নাগরিক জড়িত। তারাই প্রথম বাংলাদেশে এটিএম কার্ড জালিয়াতি করে অঢেল টাকা হাতিয়ে নেয়া সম্ভব বলে ধারণা দেয়। তাদের দেয়া ধারণা মোতাবেক মাজুরেক গত বছর বাংলাদেশ আসে। বসবাস শুরু করে একটি হোটেলে। বসবাসকালে বিয়ে করে ডিভোর্স হওয়া প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করা এক সন্তানের এক জননীকে। সেই স্ত্রীর ঘরে সাত দিনের এক সন্তান রয়েছে। তদন্তে স্কিমিং ডিভাইস বসানোর সিস্টেমটি পরবর্তীতে জানা যায়। মাজুরেক এটিএম বুথে গিয়ে দেখে, প্রতিটি বুথে এটিএম কার্ড প্রবেশ করানোর জায়গায় পর্যাপ্ত জায়গায় রয়েছে। যেখানে অনায়াসে আরেকটি কার্ড প্রবেশ করানো যায়। ফাঁকা জায়গায় স্কিমিং ডিভাইস বসিয়ে দেয়। এরপর যখনই কোন কার্ড এটিএম বুথে প্রবেশ করানো হয়, সঙ্গে সঙ্গে স্কিমিং ডিভাইস সেই কার্ডের সমস্ত তথ্য কপি করে রাখে। এরপর সেই তথ্য দিয়ে এটিএম কার্ড বানিয়ে শুরু হয় এটিএম বুথ থেকে টাকা তোলা। শুধু এটিএম কার্ড নয়, দেশ বিদেশে বিভিন্ন চেইন শপে কার্ডে জিনিসপত্র কেনাকাটার সুযোগটিকে কাজে লাগিয়ে তারা অনেক টাকা তুলে নিয়েছে। তদন্তকারী একজন উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, মাজুরেকের দাবি, এটিএম কার্ডের জালিয়াতির মাধ্যমে কত টাকা তুলে নিয়েছি, তা আমি নিজেই জানি না। বিদেশে এমন প্রতারণা করে ধরা পড়েনি। কিন্তু বাংলাদেশে এসে ধরা পড়ব, স্বপ্নেও ভাবিনি। আমাদের ধারণা ছিল, বাংলাদেশের প্রযুক্তি ব্যবস্থা দুর্বল। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বিষয়টি বুঝতেও পারবে না। আমিও চলে যেতে পারতাম কিন্তু সাত দিনের সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে আর যেতে পারিনি। ফলে ধরা পড়তে হলো। যদিও লন্ডন প্রবাসী বাংলাদেশী ও দুই বিদেশী বিষয়টি জানাজানি হওয়ার আগেই পালিয়ে গেছে। জানা গেছে. মাজুরেকের জন্ম ইউক্রেনে। পিটার থমসন নামের একজনের পাসপোর্ট চুরি করে সেই অনুযায়ী পাসপোর্ট তৈরি করে। তার কাছে জার্মান নাগরিকত্বের একটি পরিচয়পত্রও পাওয়া গেছে। গত বছর বিজনেস ভিসায় সে বাংলাদেশে এসে হোটেলে বসবাস শুরু করে। চক্রটি আদম ব্যবসার সঙ্গেও জড়িত ছিল। এ ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডিবির উত্তর বিভাগের উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বেশ কয়েকটি বেসরকারী ব্যাংকে এমন জালিয়াতির তথ্য পাওয়া গেছে। বেসরকারী ব্যাংকের মধ্যে সিটি ব্যাংকে সবচেয়ে বেশি প্রতারণার ঘটনাটি ঘটেছে। এ ছাড়া বেসরকারী ব্র্যাক ব্যাংক এমন চক্রের প্রতারণার শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে। পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে অনেক বেসরকারী ব্যাংকে উর্ধতন কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার বিষয়েও প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। তাদের গ্রেফতারের প্রক্রিয়া চলছে। তবে সরকারী ও রাষ্ট্রায়ত্ত কোন ব্যাংক এমন প্রতারণার শিকার হয়নি বলে এখন পর্যন্ত তদন্তে জানা গেছে।
×