ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

কয়া থেকে শিলাইদহ বাঘা যতীন ও রবীন্দ্রনাথ -পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

প্রকাশিত: ০৩:৫০, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

কয়া থেকে শিলাইদহ  বাঘা যতীন ও রবীন্দ্রনাথ     -পৃথ্বীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়

[গতকালের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী সংখ্যার (২৯পৃষ্ঠা) পর] তাদের বুটপরা সারি সারি পায়ের পিছনে- গাড়ির ভিতরে বসে থাকা কিছু ভারতীয় মহিলা এই পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে অপেক্ষা করছেন। যুবরাজের গাড়ি এসে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে যতীন হুকুম দিলেন গোরাদের নেমে আসতে। দেশী মানুষের এই স্পর্ধায় রুষ্ট হয়ে অশ্লীল ভাষায় সাহেবেরা আস্ফালন জানানো মাত্র তীরবেগে গাড়ির উপরে উঠে স্রেফ বাঙালি চপেটাঘাতে যতীন তাদের ফেলে দিলেন গাড়ি থেকে। দেশে ফিরে যুবরাজ তাঁর ভারত-সচিব মর্লিকে জিজ্ঞাসা করলেন এই পল্টনদের কথা এবং ক্ষোভ প্রকাশ করেন- দেশী মানুষদের প্রতি তাদের এই আচরণের নমুনা দেখে। ১৯০৮ সালের এপ্রিল মাসে দীর্ঘকালের মেয়াদে সপরিবারে যতীন দার্জিলিং যাচ্ছেন কর্মসূত্রে। চারটি গোরাসৈন্যের দুর্ব্যবহারে সহযাত্রীরা অতিষ্ঠ। এক অসুস্থ যাত্রীর জন্য শিলিগুড়ি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে নেমে যতীন জল আনতে যাচ্ছেন, বাঘের কামড়ের দরুন তখনো সামান্য পা টেনে টেনে; বদ রসিকতায় অভ্যস্ত এক গোরা তাঁর দুর্বল পায়ের উপর চাবুক মেরে বন্ধুদের বাহবা পাচ্ছে, এমন সময় কামরায় জল পৌঁছে দিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে দেখে বাড়তি মজা লোটবার সুযোগ নিতে সাহেবেরা যখন উদ্যত, সামনাসামনি তাদের চোখে চোখ রেখে যতীন প্রশ্ন করলেন : “আমায় মারলে কেন?” দেশী আদমির এই স্পর্ধার সমুচিত জবাবে চারজন মিলে তাঁকে তুলোধোনা করতে তৎপর। ততক্ষণে ক্ষিপ্রগতিতে ঘুঁষি আর চড় মারতে মারতে যতীন তাদের নাক দাঁত চোয়াল ভেঙে অনতিবিলম্বে ধরাশায়ী করলেন। এক পুলিশ অফিসার তাঁকে গ্রেফতার করতে গিয়ে পরিচিত মুখের দিকে তাকিয়ে সকৌতুক মন্তব্য করলেন : “আপনার এই কীর্তি?” পরদিন যতীনকে কাজে যোগ দিতে হবে শুনে তাঁকে ব্যক্তিগত জামিনে ছেড়ে দিলেন তিনি। সাহেব পুংগব মামলা ঠুকে দিল নেটিভের এই ঔদ্ধত্যের প্রতিবাদে। বিচারের সময় আদালতে ধিক্কার জাগল : কী করে চারজন ব্রিটিশ সামরিক কর্মচারীকে একাহাতে এক বাঙালী কেরানি পিটিয়ে ধরাশায়ী করে দিতে পারল দাঁতভাঙা রক্তাক্ত কলেবরে? সারা দেশের ইংরেজি ও বাংলা পত্রিকা সোচ্চার হল ঠাট্টা বিদ্রƒপে। তৎপরতার সঙ্গে মামলা তুলে নেওয়া হল সরকারের চাপে। যতীনের উপরওয়ালা হেনরি হুইলার স্বয়ং রাজশক্তির প্রতিনিধিরূপে তাঁর পক্ষ সমর্থন করেন। রহস্য করে একদিন হুইলার জানতে চান একাহাতে যতীনের পক্ষে কতজনকে ঘায়েল করা সম্ভব! সহাস্য যতীন জবাব দেন : “যদি ভাল লোক হয়, একজনের গায়েও আমি হাত তুলতে অপারগ। কিন্তু অসংখ্য দুর্জনকে আমি দমন করতে সমর্থ!” যতীনের কর্মদক্ষতা, চরিত্র-বল ও স্বভাব-মাধুর্যে হুইলার এমনই মুগ্ধ ছিলেন যে ১৯১০ সালে উগ্রপন্থী বিপ্লবীদের একচ্ছত্র নেতা সন্দেহে তাঁকে যখন গ্রেপ্তার করা হয়, প্রত্যয়ের সঙ্গে হুইলার রুখে উঠেছিলেন : “পুলিশে ভুল সংবাদের ভিত্তিতে এতসব ধানাই-পানাই করছে। এমন কাজ যতীন করতে পারেন না।” অরবিন্দ ঘোষ সম্পাদিত ইংরেজি “ইধহফব গধঃধৎধস”, ব্রহ্মবান্ধব সম্পাদিত “সন্ধ্যা” আর বারীণ ঘোষ তথা ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত সম্পাদিত “যুগান্তর” পত্রিকা ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশবিরোধী রচনার মাধ্যমে রাজদ্রোহের সাহস প্রবল করে তুলছিল। রবীন্দ্রনাথ প্রশংসা করতেন অরবিন্দের পাণ্ডিত্যের আর ইংরেজি রচনা শৈলীর। রাজনারায়ণ বসুর এই দৌহিত্রের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের ঘনিষ্ঠতা হয় জাতীয় শিক্ষা-পরিষদের পরিচালনার প্রয়োজনে। আমেরিকায় অধ্যয়নরত পুত্র রথীন্দ্রনাথকে ১৯০৭ সালের ২৬ আগস্ট তারিখের পত্রে তিনি জানান যে ঝঃধঃবংসধহ-এর চাঁদা ফুরিয়ে গেলে “ইধহফব গধঃধৎধস” পত্রিকাই পাঠাতে থাকবেন : “ওটা খুব ভাল কাগজ হয়েছে, কিন্তু অরবিন্দকে যদি জেলে দেয় তা হলে ও কাগজের কি দশা হবে জানিনে। বোধহয় জেল থেকে সে নিষ্কৃতি পাবে না।” পরবর্তী ৫ সেপ্টেম্বরে “বঙ্গদর্শন”এ ও ৭ সেপ্টেম্বরে “ইধহফব গধঃধৎধস” পত্রিকায় ছাপা হলো রবীন্দ্রনাথের দীর্ঘ কবিতা “অরবিন্দ, রবীন্দ্রের লহো নমস্কার!” প্রশান্ত কুমার পালের ধারণা, এই কবিতায় “দেশের নিরুদ্ধ আবেগ ও আশা বাণীমূর্তি লাভ করল ও” দ্বিধাহীন উল্লাস নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করলেন, “দেবতার দীপ হস্তে যে আসিল ভবে, সেই রুদ্রদূতে, বল, কোন রাজা কবে পারে শাস্তি দিতে...” বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সূচনাতেই পুলিশের খাতায় রবীন্দ্রনাথ শীর্ষস্থান অধিকার করেছিলেন রাজদ্রোহীদের তালিকায়। দুঃসাহসী এই কবিতা প্রকাশের পরে ব্রহ্মচর্যাশ্রমের প্রতি সরকারের কড়া নজর বিষয়ে কিছু তথ্য “রবিজীবনী” পঞ্চম খণ্ডের ৩৭৬ পৃষ্ঠায় পরিবেশিত হয়েছে। বঙ্গভঙ্গ আন্দোলন উপলক্ষে উচ্চারিত রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন উক্তির মধ্যে একটি বিশেষভাবে তাৎপর্য মণ্ডিত : “এবারের যে আন্দোলনে দেশের হৃদয় জাগ্রত হইয়াছে তাহাকে যাহারা ছলনা বলিয়া বিদ্রƒপ করিতে পারে, তাহারা শয়তানের চেলা। তোমার কছে আমার অনুরোধ এই যে তুমি যথাসম্ভব বিলাতী দ্রব্য পরিহার করিয়া দেশী জিনিস ব্যবহার করিয়ো।...” ব্রহ্মচর্যাশ্রম প্রতিষ্ঠার মূলে উপাধ্যায় ব্রহ্মবান্ধবের অবদান প্রসঙ্গ সুবিদিত। ‘বাংলার বিশ্বকবি’ আখ্যায় রবীন্দ্রনাথকে অভিহিত করে উপাধ্যায় তাঁর কবিতা সম্পর্কে যে সমালোচনা ছাপতেন, তা কবির মনে কৌতূহল ও শ্রদ্ধা জাগায়। আকস্মিকভাবে, কোন অজ্ঞাত কারণে উপাধ্যায় শান্তিনিকেতনের আওতা থেকে দূরে চলে যান। সম্ভবত, ভারতের রাজনৈতিক স্বাধীনতা চেয়ে, বিবেকানন্দের অকাল মৃত্যুতে বিচলিত হয়ে তাঁর অসমাপ্ত সাধনাকে পূর্ণতা দিতে চেয়েছিলেন উপাধ্যায়। অজ্ঞাত কারণেই গভীর এক অনীহা জাগে কবির মনে, বিশেষ করে যখন বৈদান্তিক সন্ন্যাসী ব্রহ্মবান্ধবের ‘সন্ধ্যা’ পত্রিকা গ্রাম্য ভাষায় তীব্র জ্বালা ধরানো শৈলী দিয়ে জনপ্রিয় হয়ে উঠল। উপাধ্যায় প্রসঙ্গে যুক্তির অতীত যে-উষ্মা রবীন্দ্রনাথকে তাঁর সহজাত আত্মসংযম থেকে বিচ্যুত করে, তার রেশ প্রায় ত্রিশ বছর পরেও ‘চার অধ্যায়’ উপন্যাস রচনা-কালে ঝংকৃত হয় : (উপাধ্যায়) “স্বয়ং বের করলেন ‘সন্ধ্যা’ কাগজ তীব্র ভাষায় যে মদির রস ঢালতে লাগলেন তাতে দেশের রক্তে অগ্নিজ্বালা বইয়ে দিলে ও” আভাসে ইংগিতে এই কাগজই প্রথম মূর্ত করল বাংলাদেশে বিভীষিকা-পন্থার সংকেত। রবীন্দ্রনাথ জানতেন, যতীন মুখোপাধ্যায়ের পৃষ্ঠপোষক সুরেন ঠাকুর ছিলেন গুপ্ত সমিতির অন্যতম কর্ণধার। তদনুসারে তাদের প্রয়োজনে তিনি অর্থসাহায্যও করতেন। ১৯০৬ সালে কয়াগ্রামের উপকণ্ঠে রীতিমতো ধস্তাধস্তি করে একটি বাঘ মেরে যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় তখন সারাদেশে পরিচিত হলেন বাঘা যতীন নামে, সে মুহূর্তে রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহ থেকে দূরে থাকলেও সুরেন ও ভাগ্নি সরলার মাধ্যমে নিয়মিত যতীনের খবর নিতেন, জানা যায় ভবভূষণ মিত্রের জবানে। দেবেন্দ্রনাথ ফরাসি বিপ্লব ভাল চোখে দেখেননি, সমাজবাদ পছন্দ করতেন না, বিপ্লবকে ভয় করতেন। জানা যায়, অজিতকুমার চক্রবর্তী লিখিত মহর্ষির জীবনী থেকে। মহাত্মা গাঁধীর মতো রবীন্দ্রনাথও রক্তপাতের বিরোধী ছিলেন। ১৯৩০ সালের আগস্ট মাসে সুইৎজারল্যান্ডে রোম্যাঁ রোলাঁর বাসভবনে রবীন্দ্রনাথ ঘৃণায় প্রতিবাদে কেঁপে উঠেছিলেন শৈশবে দেখা কলকাতার কালীমন্দিরের সামনে বয়ে যাওয়া রক্তস্রোতের বীভৎস বর্ণনা দিতে গিয়ে। তাঁর মতে কোন সুস্থ মস্তিষ্কের পক্ষেই কালীপূজার মতো জঘন্য উপাসনা বরদাস্ত করা সম্ভব নয়। রোম্যাঁ রোলাঁর মনে পড়ে যায় কালী-সাধক রামকৃষ্ণের শিষ্য বিবেকানন্দ তাঁর কন্যা-প্রতিম নিবেদিতার জ্ঞাতার্থে কী সুন্দর ভাষায় অভিব্যক্ত করেছিলেন কালীপূজার অন্তর্নিহিত আধ্যাত্মিক তাৎপর্য। চলবে...
×