ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

বাংলাদেশে সউদি উগ্র ওয়াহাবিজম ও আমেরিকান বন্দুক-কালচারের মিলন ঘটেছে - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

প্রকাশিত: ০৩:৪৯, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বাংলাদেশে সউদি উগ্র ওয়াহাবিজম ও আমেরিকান বন্দুক-কালচারের মিলন ঘটেছে   - আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

পঞ্চগড়ের হিন্দু মঠের অধ্যক্ষ যজ্ঞেশ্বর রায়ের গলা কেটে নির্মম হত্যাকা-টি সুদূর লন্ডনেও কোন কোন বাঙালী মহলে ভয় ও ক্ষোভের সঙ্গে আলোচিত হচ্ছে। বাইশ তারিখে এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে বাসায় ফেরার আগে একটি আড্ডায় বসেছিলাম। সেখানে দু’জন পশ্চিমবঙ্গের বাঙালীও ছিলেন। একজন বললেন, বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার দাপট ক্রমশই বাড়ছে। অন্যজন বললেন, হাসিনা সরকার এই সাম্প্রদায়িকতা ঠেকিয়ে রাখছেন বটে, কিন্তু কতদিন পারবেন, তা বলা মুশকিল। আড্ডার কেউ কেউ তাদের এই মন্তব্যের সঙ্গে একমত হয়েছেন। আমি সম্পূর্ণভাবে হইনি। যজ্ঞেশ্বর রায়ের মতো একজন নিরীহ হিন্দু ধর্মযাজকের (যিনি ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে ভালমন্দ কোন কিছু বলেননি বা লেখেননি) এই নৃশংস হত্যাকা- আমাকে অভিভূত করেছে; কিন্তু এটা সাম্প্রদায়িক হত্যাকা- বলে আমার মনে হয়নি। মোটরসাইকেলে চেপে হত্যাকারীদের মঠে আসা এবং বন্দুক সঙ্গে থাকা সত্ত্বেও চাপাতি দিয়ে গলা কেটে হত্যা করার ধরন দেখে এর আগের ব্লগার হত্যা, বিদেশী নাগরিক হত্যা এবং খ্রীস্টান যাজকের উপর হামলার সঙ্গে এর মিল খুঁজে পেয়েছি। এই হত্যকা-ের সঙ্গে সঙ্গে আইএসের নামে স্বীকারোক্তি প্রচার করা থেকেও আনসারুল্লা, হিজবুল্লা, জেএমবি বা এই জাতীয় ‘জিহাদিস্টদের’ তৎপরতাই ধরা পড়ে। জিহাদিস্টরা বাংলাদেশে সকল সম্প্রদায়ের লোকজনকেই হত্যা করছে। সুতরাং এটাকে সাম্প্রদায়িক হত্যাকা- বলে চিহ্নিত করা উচিত নয়। বাংলাদেশে অর্থনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা এখনও আছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জমিজমা, বিষয়-সম্পত্তি গ্রাসের লোভটি এখনও যায়নি। এই লোভটি ক্ষমতাশালী মহলে বেশি থাকায় সংখ্যালঘুদের ভয়ভীতি দেখানো এখনও বন্ধ হয়নি। কিন্তু সামাজিক ও রাজনৈতিক সাম্প্রদায়িকতা এখন অনেকটা লুপ্ত হওয়ার পথে। বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা এখন শক্তিহীন হলেও ভয়াবহভাবে যার দাপট বাড়ছে তা হলো ধর্মান্ধতা। এ জন্য সেক্যুলার রাজনৈতিক দল ও নেতারা কম দায়ী নন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা ধীরে ধীরে রাজনীতির ধর্মীয় কালচারের কাছে আত্মসমর্পণ করেছেন। পাকিস্তান আমলেও তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে বা বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও সমাজে সেক্যুলার কালচারের যে প্রভাব ছিল, ধর্মনিরপেক্ষতার নামে যে দেশটি স্বাধীন হয়েছে, সেই বাংলাদেশের সমাজে ও রাজনীতিতে সেই সেক্যুলার কালচার আর নেই। একটি অপ্রিয় সত্য কথা হলো, বাংলাদেশ হাজার বছর ধরে যে মিশ্র জাতিসত্তা, ধর্ম ও কালচারের দেশ ছিল, এখন তা নেই। এখন নামে ধর্মনিরপেক্ষ কিন্তু এক ধর্ম ও এক কালচারের দেশ হয়ে উঠছে। এবং এই এক ধর্ম ও এক কালচার হলো সংখ্যাগরিষ্ঠের ধর্ম ও কালচারটি। এক ধর্ম ও এক কালচারের একাধিপত্য থেকে সহজেই মৌলবাদের উত্থান ঘটে। আর রাজনৈতিক কারণে সেই মৌলবাদকে ব্যবহার করতে চাইলে সন্ত্রাস তার সঙ্গে যুক্ত হয়। পাকিস্তানে তা ঘটেছে এবং ধর্মভিত্তিক সিভিল-ওয়ারে দেশটি জর্জরিত হচ্ছে। বাংলাদেশে পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো পাকিস্তানের অনুকরণে একই কা- ঘটাতে চাচ্ছে। অক্সফোর্ডে অধ্যয়নরত বাংলাদেশের এক তরুণ সমাজ-বিজ্ঞানী (তিনি নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বলে নামটা প্রকাশ করছি না) একদিন কথা প্রসঙ্গে একটি চমৎকার কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশে জিহাদিস্টদের কর্মকা-ে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের উচ্চশিক্ষিত ছাত্রদের সম্পৃক্ততা দেখে মনে হয়, উগ্র মৌলবাদের সঙ্গে আমেরিকার গান-কালচারও (মঁহ পঁষঃঁৎব) এদের প্রভাবিত করছে। আমেরিকায় বন্দুক কালচারের প্রভাব এতটাই বেড়েছে যে, কথা নেই, বার্তা নেই, সহসা একজন সুস্থ মানসিকতার তরুণ অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং কোন স্কুলঘরে কিংবা পানশালায় ঢুকে নির্বিচার গুলি চালিয়ে অসংখ্য শিশু অথবা নিরীহ নর-নারীকে হত্যা করে। এটা এখন আমেরিকায় অহরহই ঘটছে। আর এসব বর্বরতাকে ভিত্তি করে হলিউড প্রতিবছর যে অসংখ্য ছায়াছবি নির্মাণ করে, বিশ্বময় তা প্রচার দ্বারা তরুণ মনে ভায়োলেন্সের প্রতি আকর্ষণ বাড়ায়। ব্রিটেনের জেমস বন্ড ছায়াছবিতে তো অবৈধ ও অকারণ হত্যাকা-কে রীতিমতো গ্লোরিফাই করা হয়েছে। স্বাধীনতার যুদ্ধের সময় বাংলাদেশে শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে তরুণেরা আগ্নেয়াস্ত্র চালাতে শিখেছিল। যুদ্ধের পর এমন কোন আদর্শবাদ ও শৃঙ্খলাবোধ দ্বারা তাদের উদ্বুদ্ধ করা হয়নি; যাতে তাদের মধ্যে অস্ত্র ব্যবহারের নৈতিকতাবোধ জন্মায়। ফলে শীঘ্রই তাদের মধ্যে একটি ষোড়শ বাহিনীর উদ্ভব ঘটেছিল, যাদের কাজ ছিল অস্ত্রের অবৈধ ব্যবহার দ্বারা লুটপাট ও নিরীহ মানুষজনকে নির্যাতন। দেশ স্বাধীন হয়েছিল সমাজতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শের ভিত্তিতে। কিন্তু বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সামরিক ও স্বৈরাচারী শাসকদের কৃপায় বাংলাদেশে একদিকে সউদি আরবের মধ্যযুগীয় ওয়াহাবি উগ্রবাদ এবং অন্যদিকে আমেরিকার হলিইড গান-কালচারের প্রভাব ছড়িয়ে পড়ে। জনজীবনে মৌলবাদকে শিকড় গাড়তে দেয়া হয়। তরুণদের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে গান-চালকার। জেনারেল এরশাদের আমলে তো বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলোতে ছাত্র নামধারী দুর্বৃত্ত ঢুকিয়ে তাদের অস্ত্র সরবরাহ করাও হয়। বাংলাদেশের রাজনীতিতে সউদি আরব ও আমেরিকার সঙ্গে অতি মাখামাখির ফলে মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার সঙ্গে আধুনিক গান-কালচারের দ্রুত মিলন ঘটে। তারই পরিণতিতে বাংলাদেশে আজ এই জঙ্গলযুগের আবির্ভাব। যজ্ঞেশ্বর রায়ের হত্যাকা-ের পর গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র থাকায় অক্সফোর্ডের তরুণ বাঙালী সমাজ-বিজ্ঞানীর বাংলাদেশের সন্ত্রাস সম্পর্কিত বিশ্লেষণটি আমার কাছে আরো যুক্তিগ্রাহ্য মনে হয়েছে। পর পর দু’বছর বাংলাদেশে যাওয়া আসার পর আমার নিজেরও একটি অভিজ্ঞতা অর্জিত হয়েছে। আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিজিক্সে বা ইকোনমিক্সে ডক্টরেট ডিগ্রীপ্রাপ্ত ঢাকার দু’তিনজন তরুণের সঙ্গে দেখা হয়েছে, যাদের দাড়ি এবং লম্বা কুর্তা দেখে প্রথমে বুঝতে পারিনি এরা বিদেশের উচ্চ ডিগ্রীধারী তরুণ। আলাপ শুরু হতেই তারা ইসলাম সম্পর্কে এমন সব কথাবার্তা বলতে শুরু করল, যা প্রকৃত ইসলামের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। বরং কট্টর ওয়াহাবিজম। আমার বুঝতে বাকি থাকেনি এই মুসলমান তরুণদের (বাঙালী-অবাঙালী নির্বিশেষে) মস্তিষ্ক ধোলাইয়ের কাজটি প্রথম শুরু হয়েছিল আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালগুলোতেই বহু আগে। উন্নয়নশীল বিশ্বের যেসব ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষার জন্য আমেরিকায় যায়, তখন তারা যাতে কম্যুনিজমের দিকে আকৃষ্ট হয়ে না পড়ে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে মার্কিন শিক্ষা কর্তৃপক্ষের অনুমোদনক্রমেই ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদকে আধুনিকতার আবরণে মুড়ে এদের মাথায় ঢোকানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। আজ থেকে তিন-চার দশক আগে যে বিষবৃক্ষের চারা রোপণ করা হয়েছিল আমরা এখন তারই মহীরুহ রূপ দেখছি। বাংলাদেশকে এই অবস্থা থেকে মুক্ত করা একটি কঠিন ব্যাপার। মুক্ত করতে হলে দরকার হবে একটি সমাজ বিপ্লবের। কোন গণতান্ত্রিক সরকারের পক্ষে তা করা সম্ভব হবে কিনা তা আমি জানি না। বাংলাদেশে কার্যকরভাবে সন্ত্রাস বন্ধ করতে হলে সউদি আরব ও আমেরিকার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক নতুনভাবে নির্ধারণ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে আমেরিকা সন্ত্রাস দমনের নামে যে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের বিস্তার ঘটাচ্ছে তা থেকে সতর্কতার সঙ্গে দূরে থাকতে হবে। সম্প্রতি সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের নামে সউদি আরবের নেতৃত্বে (পেছনে আমেরিকা) যে নতুন সামরিক জোট গঠিত হয়েছে তাতে বাংলাদেশ কোন কূটনৈতিক সুবিধার জন্য যোগ দিয়ে থাকলেও সন্ত্রাস দমনে তা বাংলাদেশকে কোন সাহায্য যোগাতে পারবে না। এবার ধর্মান্ধতা সম্পর্কে একটা কথা বলি। বাংলাদেশ বর্তমান আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে অবশ্যই উগ্র ধর্মান্ধতা দ্বারা আক্রান্ত। কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ধর্মভীরু হওয়া সত্ত্বেও ধর্মান্ধতা ও ধর্মান্ধতার রাজনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়নি। সে তুলনায় ভারত একটি বড় দেশ এবং দীর্ঘকালের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশ হওয়া সত্ত্বেও ধর্মান্ধতা সে দেশে সহজেই বিজয়ী শক্তি। এত অর্থ, এত প্রচারণা শক্তি এবং অফুরান পেট্রো ডলারের মদদ সত্ত্বেও পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলাদেশে উগ্রপন্থী জামায়াত এবং ইসলামপন্থী কোনো রাজনৈতিক দল জনগণের ভোটে ক্ষমতায় আসতে পারেনি। জামায়াতের ভোট সকল নির্বাচনেই গিয়ে দাঁড়ায় ছয় কি সাত শতাংশ। জামায়াত যে একবার ক্ষমতায় অংশীদার হয়েছে, তাও বিএনপির বদান্যতায়। নিজের ভোটের জোরে নয়। অন্যদিকে প্রায় ৭০ বছরের প্রতিষ্ঠিত গণতন্ত্রের দেশ ভারতে, যে দেশটির আদর্শ ধর্মনিরপেক্ষতা, সে দেশে বিজেপির মতো সাম্প্রদায়িক দল (যে দলের সহযোগী শিবসেনা, আরএসএসের সঙ্গে বাংলাদেশের আনসারুল্লা ও জেএমবির কোনো তফাত নেই) ভোট বিপ্লব সৃষ্টি করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে। বাংলাদেশের জন্য এখানেই আশার কথা। বাঙালী চরিত্রে (তা বাংলাদেশের বাঙালী বা পশ্চিমবঙ্গের বাঙালী যাই হোক) কোথায় যেন একটা সহজাত উদারতা ও সহিষ্ণুতায় কঠিন বর্ম আছে যা সকল উগ্রতা ও ধর্মান্ধতাকে প্রতিহত করে। তাই ভারতের গত সাধারণ নির্বাচনেও দেখা গেছে, প্রচ- মোদি ঝড় সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি সুবিধা করতে পারেননি। বাংলাদেশে হিংস্র ধর্মান্ধতার সন্ত্রাসী নখর আমরা দেখছি, তার অভ্যুত্থান এখনো দেখিনি। সেই অভ্যুত্থান হাসিনা সরকার ঠেকিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো কতকাল তারা ঠেকিয়ে রাখবেন? ঠেকাতে হলে জাগ্রত ও সংঘবদ্ধ জনমত গঠন দরকার। এই জনমত গঠনের কাজটি কে করবে? ভোট হারোনোর ভয়ে আওয়ামী লীগ আর ক্ষমতার ভাগিদার হওয়া থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় কয়েকটি বাম দল যেভাবে ব্যতিব্যস্ত, তাতে জনগণকে নিয়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার দল ও নেতা কোথায়? এককালে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে যেভাবে গণতান্ত্রিক দল ও সাংস্কৃতিক সংস্থাগুলো ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াইয়ের মাঠে নেমেছিলেন, সেভাবে এখন কেউ লড়াইয়ে নামতে চাচ্ছেন না কেন? একজন নিরীহ যজ্ঞেশ্বর রায় প্রাণ দিয়েছেন। আরও অনেক যজ্ঞেশ্বর রায় ভবিষ্যতে প্রাণ দেবেন, যদি আমরা উগ্র সউদি ওয়াবিজম ও আমেরিকান গান-কালচারের প্রভাব থেকে আমাদের তরুণ সমাজকে মুক্ত করার কোন কার্যকর পন্থা উদ্ভাবন করতে না পারি। কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় এই সন্ত্রাস সমূলে উৎখাত করা যাবে না। [লন্ডন ২৩ ফেব্রুয়ারি, মঙ্গলবার, ২০১৬]
×