ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

এ কোন্ পৈশাচিক বর্বরতা! ॥ অভিমত -বিশ্বজিত রায় বিশ্ব

প্রকাশিত: ০৩:৪৮, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

এ কোন্ পৈশাচিক বর্বরতা! ॥ অভিমত    -বিশ্বজিত রায় বিশ্ব

শিশুহত্যা ও নির্যাতন সংশ্লিষ্ট সামাজিক অধঃপতনের ক্ষয়িষ্ণু রূপ এবার গুরুত্বসহকারে প্রচার হলো দেশের প্রতিটি সংবাদপত্রে। সংবাদের বিবরণে নয় শিরোনামেই ফুটে উঠেছে অমানবিক, নৃশংস, বর্বর, নির্মম, পাশবিক, দুর্ধর্ষ, পৈশাচিক ও বীভৎস বর্ণনা। শিরোনামগুলো আমাদের সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রীয় মর্যাদা, মানবিক মূল্যবোধ, বিচার ব্যবস্থা ও সামাজিক নিরাপত্তাকে চরমভাবে আঘাতপ্রাপ্ত করেছে। দেশব্যাপী শিশুদের ওপর যে নিষ্ঠুর বর্বরতা চলছে তা মধ্যযুগীয় নির্মমতাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার উপক্রম হচ্ছে বলেই প্রতীয়মান হয়। এহেন পরিস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ মনে বলতে ইচ্ছে করছেÑ বিচারহীনতাই উসকে দিচ্ছে এসব সামাজিক অপরাধ। শিশু শব্দটি অন্য যে কোন শব্দ থেকে একটু আলাদা অর্থ বহন করে। ছোট্ট এই শব্দটিকে ঘিরে রয়েছে দুরন্তপনা, হাসি-কান্না, আনন্দ-উল্লাস ও ¯েœহ-মমতায় ভরা একটি নির্মল প্রাণের উচ্ছল স্পন্দন। শিশু শব্দটি একটি উভয়লিঙ্গ শব্দ। ১৮ বছরের নিচে যাদের বয়স তাদেরকেই শিশু বলে ধরে নেয়া হয়। শিশুদের উদ্দেশে কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর এক কবিতায় বলেছেনÑ ‘‘এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি/নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’’ কবিতার পঙ্ক্তিমালায় সদ্য জন্ম নেয়া নিষ্পাপ শিশুর ভবিষ্যত পথচলা সত্য, সুন্দর ও কলঙ্কমুক্ত করতে গুরুত্বারোপ করা হয়। শিশুকে দেয়া কবির অঙ্গীকার কতটুকু রক্ষা করতে পারছে বর্তমান সমাজ ব্যবস্থা? একটি শিশুর জন্ম থেকে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার আগ পর্যন্ত যতটুকু সামাজিক নিরাপত্তা পাওয়া দরকার তার সামান্যটুকুও কি পাচ্ছে তারা? চারপাশের নিত্য ঘটনা চিৎকার দিয়ে বলছেÑ না-না-না। দেশব্যাপী শিশু নির্যাতনের অমানবিক ঘটনাপ্রবাহ মানবতাবোধকে পশুতুল্য করে পাঠিয়েছে নির্জন অরণ্যে। অমানবিক ঘটনাটি ঘটে সেই হবিগঞ্জের নবীগঞ্জে। সংবাদপত্রের টাকা চাইতে গিয়ে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয় ১৩ বছরের শিশু দবির। পত্রিকা বিক্রি করেই জীবিকা নির্বাহ করত সে। ১ ফেব্রুয়ারি নির্যাতনের ভিডিও দৃশ্য চোখে পড়লে সচেতন মহলে শুরু হয় তোলপাড়। এ যাত্রায় প্রাণে বেঁচে যায় শিশু দবির। কিন্তু দবির বাঁচলেও মনুষ্য অবিবেচকদের কবল থেকে রক্ষা পাচ্ছে না অন্যান্য শিশুপ্রাণ। বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে সিলেটে শিশু সামিউল আলম রাজন, বরগুনায় রবিউল, খুলনায় রাকিব হত্যাকা-ের কথা এখনও মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি কেউ। হবিগঞ্জে চার শিশুকে মেরে পুঁতে রাখা হলো মাটির নিচে। এমন বীভৎস ঘটনা একের পর এক ঘটিয়েই চলেছে মনুষ্য চরিত্রের নরপশুরা। প্রশ্ন উঠছে মানবিক মূল্যবোধ নিয়ে। দেশব্যাপী অমানবিকতার এই বর্বর চিত্র লেখক মনের মানবিক বোধকে প্রশ্ন করছেÑ মনোবৃত্তি ও পশুবৃত্তির মধ্যে পার্থক্য কোথায়? ব্যথিত মনকে বোঝানোর ব্যর্থ চেষ্টা। মানুষ সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করে বলে তার রয়েছে সামাজিক মূল্যবোধ। আর মানুষ ও পশু দুটি দুই গোত্রের প্রাণী। পশু প্রজাতির কোন বিবেকবোধ নেই। নেই কোন আত্মসম্মানবোধও। মানুষের তা রয়েছে। কিন্তু সংবাদপত্রের পাতায় বর্ণিত ঘটনাগুলো যে ভিন্ন কথা বলছে। একজন মানুষ আরেকজন মানুষের প্রতি যে নির্মমতা চালাচ্ছে তা পশুত্বকে ছাড়িয়ে আক্রান্ত করছে আমাদের সমাজবদ্ধ সামাজিক রীতি, মানবিক মূল্যবোধ ও ভদ্রবেশী এক রাষ্ট্রকে। পত্রিকায় চোখ বুলালে ভেসে ওঠে শিশুহত্যার আশঙ্কাজনক নানা খবর। শিশুরা যে প্রতিহিংসা, অপহরণ ও মুক্তিপণ, জিঘাংসা, ধর্ষণ, পারিবারিক কলহ, লালসার সহজ শিকার হয় তা সম্প্রতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদই যথেষ্ট। মনুষ্যত্বহীন অমানুষদের দুর্বৃত্তপনায় কত মায়ের কোল যে খালি হচ্ছে তার কোন হিসাব নেই। পরম মমতায় আগলে রাখা শিশু সন্তানকে হারিয়ে অশ্রুনয়নে বাকরুদ্ধ আজ অসংখ্য পিতা-মাতা। কোন মা কি সহজেই ভুলতে পারবে তার নারীছেঁড়া ধন দুরন্তপনার অফুরন্ত চেহারাখানি? মা-মা বলে সোহাগপ্রিয় সন্তানের কোমল ডাক কোন মায়ের পক্ষে তার অনুভূতি থেকে কি মুছে ফেলা সম্ভব? ও-মা, মাÑ আহ্লাদি এই সুর শোনা সকল জননীর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ অনুভূতি। সেই অনুভবের জীবন্ত ছোঁয়া চিরতরে ডুবিয়ে দিচ্ছে মানুষ নামের কিছু পাপিষ্ঠ নরঘাতক। যাদের অমার্জনীয় অমানবিকতার প্রতিনিয়তই বলি হচ্ছে কোমলমতি শত শিশু। আর এই অসহ্য মর্মবেদনা নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে অচেনা অনেক পরিবার। পৃথিবীতে এমন মা নেই, যে মা তার জীবনের অতিপ্রিয় ধনটিকে হারিয়ে সুখে থাকতে পারে। না, সুখে নেই সন্তানহারা কোন জননী। মা-মা ডাকের অদৃশ্য শ্রবণ স্মৃতি যে আজও পিছু ডাকছে সন্তানহারা মায়েদের। বারবার চোখে ভাসছে মায়াবী মুখাবয়বের জীবন্ত ছবি। তাই খোকা খোকা বলে মূর্ছা যাচ্ছেন, অবচেতন মনে ডেকে উঠছেন কখনও কখনও। শূন্য বুকের এই গগনবিদারী আর্তনাদ আর কতদিন! কেন এই অমানবিক দস্যুপনা? এর দায়-দায়িত্ব কোথায় গিয়ে বর্তাবে? সংবাদপত্রে স্থান পাওয়া শিশুহত্যা ও নির্যাতনের নৃশংস ঘটনাগুলো সুস্থ মানসিকতায় সজোরে ধাক্কা দিয়ে বক্ষ বিদীর্ণ করে তোলে। নৃশংসতার বর্ণনায় শিউরে ওঠে গা, দুর্বল হয়ে পড়ে মানবিক বোধশক্তি। সম্প্রতি কিছু নির্মম ঘটনা হতাশাগ্রস্ত করেছে দেশবাসীকে। ১৪ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরের কাশিমপুর এলাকায় সোলায়মান নামে চার বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়। এনজিও থেকে ঋণ নেয়াকে কেন্দ্র করে বাবার ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় নির্মল রবিদাস নামে এক শিশুকে হত্যা করা হয়। গত ১০ ফেব্রুয়ারি কুড়িগ্রামের শিমুলবাড়ি উপজেলায় মাদ্রাসার এক শিশুকে অপহরণ করা হয়। ৮ ফেব্রুয়ারি সুনামগঞ্জের ছাতকে ১০ বছরের এক শিশুর গলাকাটা লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৫ ফেব্রুয়ারি সাভারের আশুলিয়ায় ইমন নামে এক স্কুলছাত্র নিখোঁজ হয়। ৩১ জানুয়ারি শেরপুরে নূর আলম নামে এক স্কুলছাত্রের লাশ পাওয়া যায়। গত ২ ফেব্রুয়ারি কেরানীগঞ্জে স্কুলছাত্র আবদুল্লাহর লাশ উদ্ধার করা হয়। চলতি বছরের ৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপার কবিরপুর মসজিদপাড়ায় তিন শিশুকে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। পারিবারিক কলহের জের ধরে ইকবাল হোসেন নামে এক ব্যক্তি নিজের ভাই ও বোনের তিন সন্তানকে পুড়িয়ে হত্যা করে। ৩০ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ সদরের মালির পাথর এলাকার একটি পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব (১১) নামে এক মাদ্রাসা ছাত্রের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ২৯ জানুয়ারি খেলার সময় সে নিখোঁজ হয়। ২৮ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে অপহরণের প্রায় দুই মাস পর রংপুর নগরের আদর্শপাড়া থেকে রাহিমুল ইসলাম রনক (১১) নামে এক শিশুর বস্তাবন্দী লাশ উদ্ধার করা হয়। ২৮ জানুয়ারি ঢাকার ধামরাইয়ের শাকিল (১২) ও ইমরান (১০) নামে দুই স্কুলছাত্রের লাশ উদ্ধার করা হয়। বিভিন্ন পরিসংখ্যানেও ফুটে ওঠে নৃশংস হত্যাকা-সহ নির্মম নির্যাতনের ভয়াবহ চিত্র। পুলিশ সদর দফতরের তথ্য অনুযায়ী ২০১৫ সালে শিশু নির্যাতনের মামলা হয়েছে ১ হাজার ৭২৭টি, গড়ে প্রতিমাসে প্রায় ১৪৪টি। ২০১৪ সালে এ সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৬৭৮টি ও ২০১৩ সালে ছিল ১ হাজার ৫১০টি। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যাকা-ের শিকার হয়েছে ৮৭ শিশু। এর মধ্যে খুন ২৯, ধর্ষণ ৩৩, ধর্ষণের চেষ্টা ৮ ও অপহরণের শিকার হয়েছে ১৭ শিশু। অপহৃত ১৭ জনের মধ্যে চারজনের লাশ উদ্ধার, সাতজনকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। এছাড়াও ২০১২ সালের জানুয়ারি থেকে এ বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ৪৯ মাসে হত্যাকা-ের শিকার ১ হাজার ৮৫ ও ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৬ শিশু। এর মধ্যে ২০১৫ সালে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ২ হাজার ৮৮১ শিশু। যার মধ্যে খুন ২৯২, ধর্ষণ ৫২১ ও অপহরণের শিকার ২৪৩ শিশু। ২০১৪ সালে শিশু খুন হয়েছে ৩৬৬, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯। ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে শিশু ধর্ষণ বেড়েছে ১৬১ দশমিক ৮১ শতাংশ, অপহরণ বেড়েছে ১৬ দশমিক ২৭ শতাংশ। তবে ২০১৪ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে অপহরণের পর উদ্ধারের হার বেড়েছে ৮১ দশমিক ৫২ শতাংশ। শিশুদের প্রতি যে বর্বর, নৃশংস, নির্মম, বীভৎস ও অমানসিক নির্যাতন চালানো হচ্ছে তা প্রশ্নবিদ্ধ করছে পুরো মানবসত্তাকে। সমাজে বসবাসরত মানুষরূপী কিছু দুর্বৃত্ত আছে যাদের লোভ-লালসা ও জিঘাংসার বলি হচ্ছে অবুঝ মনের কোমলমতি শিশুপ্রাণ। বেশিরভাগ ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পরিচিতজনরাই শিশুর জন্য বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। ঘাতক স্বজনদের তালিকায় রয়েছে মা-বাবার নামও। সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে সামাজিক ও পারিবারিক অবক্ষয়ের কারণে শিশুর প্রতি নৃশংসতার মাত্রা বাড়ছে। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে কিংবা প্রতিহিংসা মেটাতে শিশুকে পণ্য বানানো হচ্ছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি এসব অপরাধকে উসকে দিচ্ছে। এর জন্য প্রয়োজন সচেতনতা এবং আইনের সঠিক প্রয়োগ। দেশব্যাপী ঘটে যাওয়া এই নৃশংসতার জন্য দায়ীদের কেবল পশু প্রজাতির সঙ্গেই তুলনা করা যেতে পারে। অবশেষে শিশুদের সুরক্ষা সুনিশ্চিতে উপসংহার টানতে চাই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ কবিতার পঙ্ক্তি টেনেÑ ‘ধরায় উঠেছে ফুটি শুভ্র প্রাণগুলি, নন্দনের এনেছে সম্বাদ, ইহাদের করো আশীর্বাদ।’ নরংযধি৮৫@মসধরষ.পড়স
×