ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

বিস্মৃতির অন্তরালে

প্রকাশিত: ০৩:৪৭, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৬

বিস্মৃতির অন্তরালে

ঢাকার রাজপথে উনিশ শ’ বায়ান্ন সালে যারা তপ্ত তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল, তারা মায়ের ভাষা বাংলা ভাষার জন্য দিয়েছিল প্রাণ বিসর্জন। এই ভাষার প্রতিটি বর্ণমালা লাল রক্তমাখা তাই। তারা বলে গিয়েছিলÑ ভাষাই ধর্ম, ভাষাই তাদের প্রাণ। যেই প্রাণ উৎসারী তারা সমুন্নত রেখেছিল আ-মরি বাংলা ভাষাকে। আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার, কি আশ্চর্য, কি বিষণœ নাম। একসার জ্বলন্ত নাম। বাঙালী ছাত্র-তরুণরা বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে রচনা করেছিল মাতৃভাষার অধিকারকে মৌলিক অধিকার হিসেবে প্রতিষ্ঠার পথ। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী পূর্ব বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালীকে তাদের অধীন করার পরিকল্পনা নেয়। প্রথমেই তারা বাঙালীর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ভুলিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের ভাষা বাংলার পরিবর্তে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার চক্রান্ত শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য ছিল বাঙালী জাতিসত্তাকে বিনষ্ট করা। ষড়যন্ত্রের শুরুতেই এ দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। জোরদার হয় বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠার আন্দোলন। বাংলাভাষার দাবিতে ১৯৪৮ সালে যে স্ফুরণ ঘটেছিল, ’৫২ সালে তা পরিণতি লাভ করে। উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রতিবাদের সেই দাবি ক্রমশ বাঙালীকে স্বাধীনতা ও স্বাধিকারের দাবির দিকে ধাবিত করেছিল। সেদিন ছাত্র সমাজ সাহসের পতাকা হাতে নিয়ে যে সেøাগান তুলেছিল ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’Ñ তা দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। বাঙালীর ঘরে ঘরে যত ভাই বোন সবাই ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল ভাষা প্রতিষ্ঠার দাবিতে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ ছাত্রছাত্রীরা এক কাতারে নেমে এসেছিল সেদিন। সম্মিলিতভাবে তারা রাজপথ জনপদ প্রকম্পিত করেছিল। বরণ করেছিল গণগ্রেফতার কিন্তু ছাত্ররা মাথা নত করেনি। আর তা করেনি বলেই বাংলাভাষা পেয়েছে প্রাণ। ভাষা আন্দোলনের সেই সব সংগ্রামী নেতার অধিকাংশ আজ আর আমাদের মাঝে নেই। অনেকেই বিস্মৃতির অতলে গিয়েছেন হারিয়ে। ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের কথা বর্তমান প্রজন্মের কাছে ধীরে ধীরে অজানাই হয়ে যাচ্ছে। ভাষার জন্য যাদের অবদান অপরিসীম, জীবদ্দশায় তাঁরা যথাযথভাবে যেমন সম্মানিত হননি, তেমনি মৃত্যুর পরও। সপরিভাবে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয় না। যেমন হয় না ভাষা শহীদদের প্রতিও। প্রভাতফেরির সেই কালে মিছিল সহকারে আজিমপুর কবরস্থানে ভাষা শহীদদের সমাধিতে পুষ্পস্তবক অর্পণ শেষে শহীদ মিনারে পুষ্পমাল্য প্রদান করা হতো। তাদের সমাধি আর ঢেকে যায় না ফুলে ফুলে। শহীদ মিনারে মানুষের ঢল নামে অথচ ভাষা সংগ্রামীদের সমাধি একটি ফুলেরও ছোঁয়া পায় না। বিস্মৃত জাতি হিসেবে খ্যাত বাঙালীর জীবনে একুশ ছিল শোকের প্রতীক। কাল পরিক্রমায় শোক থেকে শক্তিতে পরিণত হয়ে তা এখন রূপান্তরিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে। সারা বিশ্বে যা পাল করা হয় এখন। আর এই উৎসবের সেরেনাদের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছে ভাষা সংগ্রামীরা। রাষ্ট্র যেমন করে না স্মরণ তাদের, সরকারও নয়। তাই বিস্মৃতির অন্তরালে ঢাকা পড়ে আছে ভাষার ইতিহাস, ভাষা সংগ্রামীর সাহস। কেউ আর গায় না ভাষা শহীদ ও সংগ্রামীদের সমাধির সামনে দাঁড়িয়েÑ মরণ সাগর পাড়ে তোমরাই অমর তোমাদের স্মরি...। এই করুণ অবস্থা থেকে উত্তরণে এগিয়ে আসতেই হবে ছাত্র সমাজসহ সংস্কৃতি কর্মীদের। বিস্ময়ের আড়াল থেকে মুক্ত করতে হবে ভাষা শহীদ ও সংগ্রামীদের।
×